বিশিষ্ট পিয়ানোবাদক, বাদ্যযন্ত্রী এবং সঙ্গীত আয়োজক ভি বালসারা (V Balsara) পার্সি হয়েও ভারতের সঙ্গীতের ইতিহাসে এক কিংবদন্তী হয়ে আছেন। বাংলা ও হিন্দি ভাষায় বহু চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনাও করেছেন তিনি। তাছাড়া মঞ্চে নাটকের জন্য এবং টেলিভিশন ধারাবাহিক কিংবা অন্য অনুষ্ঠানের জন্যেও সঙ্গীত নির্মাণের দায়িত্ব ছিল তাঁর। ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীতের উপর গভীর জ্ঞান বালসারাকে পিয়ানোর মতো পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত বাজিয়ে কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন। অর্কেস্ট্রা পরিচালক এবং বাদক হিসেবেও যথেষ্ট সুনাম ছিল বালসারার। পিয়ানোর পাশাপাশি অ্যাকর্ডিয়ান, মাউথ অর্গ্যান, হারমোনিয়াম, মেলোডিকা ইত্যাদি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর দক্ষতা তাঁর ছিল এবং রেকর্ডিং স্টুডিওতে তাঁর হাত ধরেই এই বাদ্যযন্ত্রগুলি জনপ্রিয়তা পায়। দুই শতাধিক অ্যালবামের স্রষ্টা ভি বালসারা মোট ১২টি হিন্দি ছবি এবং মোট ৩২টি বাংলা ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি তাঁর অমোঘ আকর্ষণের কাহিনী আজও সঙ্গীতপ্রিয় বাঙালির মুখে মুখে ফেরে।
১৯২২ সালের ২২ জুন বম্বেতে এক গুজরাতি পার্সি পরিবারে ভি বালসারার জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম ভিয়েস্তাপ আর্দেশির বালসারা। তাঁর নামের অর্থ ছিল তেজি ঘোড়া। তাঁর বাবা ছিলেন পেশায় টিউটোরিয়াল স্কুলের একজন শিক্ষক এবং তাঁর মা নাজমায়ে ছিলেন প্রকৃতই বালসারার সঙ্গীতের শিক্ষক। বলা যায় সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয় তাঁর মায়ের কাছেই। তাঁর মা নিজেও লঘুসঙ্গীত গাইতেন। বাবার স্কুলে বেহালা, ম্যাণ্ডোলিন, পিয়ানো শেখানোর ক্লাসে জোর করে তাঁর মা বালসারাকে পাঠিয়ে দিতেন। প্রত্যেক ক্লাসে বসে বসে মনোযোগ সহকারে সেইসব বাজনা শুনতেন বালসারা আর সেই থেকেই এইসব বাজনার প্রতি তাঁর আগ্রহ বেড়ে যায়। এইভাবেই নানা রকমের গ্লাস, শিশি, পাথর, ঘন্টা, সাইকেলের বেল, টাইপরাইটারের তাল রাখার মধ্য দিয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন তিনি। তবে মায়ের কাছেই হারমোনিয়াম নিয়ে প্রথাগত গানের তালিম নিয়েছিলেন বালসারা। মাত্র ছয় বছর বয়সেই বম্বের কাওয়াসাজি জাহাঙ্গীর হলে দর্শকের সামনে প্রথম পেডাল হারমোনিয়াম বাজান ভি বালসারা। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি প্রবলভাবে অনুরক্ত বালসারা জার্মান সঙ্গীত বিশারদ হিলদাফিল্ডের কাছে পিয়ানো বাজানো শিখেছিলেন।
ছোটোবেলা থেকেই পড়াশোনায় মন ছিল না তাঁর। কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে লেখাপড়ার যাত্রাপথে সেখানেই ইতি টেনেছিলেন বালসারা। আত্মজীবনীতে তিনি জানিয়েছেন যে কলেজে পড়াশোনা করার বদলে সোশ্যালে বিভিন্ন রকমের অর্কেস্ট্রা তৈরির কথা সবসময় তাঁর মাথায় ঘুরত। এই সময়ই গ্লাস, শিশি, ধাতু, পাথর, সাইকেলের বেল ইত্যাদি দিয়ে নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেছিলেন তিনি। খালি শিশি দিয়ে ‘বটলফোন’ ছাড়াও গ্লাসোফোন, স্টিলোফোন, বেলোফোন ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রও তৈরি করেছিলেন তিনি। মিষ্টি সুরের খোঁজেই যেন তিনি পাগলের মত হন্যে হয়ে ঘুরতেন। বিখ্যাত কোনো গানের সুর বাজানো হলে সেই সুরের একই লয়ে টাইপরাইটারে টাইপ করে ফেলতেন বালসারা পুরো গানটা। তাঁর এই দক্ষতা সত্যই ছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত।
ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার কিছুদিন পরেই বাড়ি থেকে পালিয়ে পুনে চলে এসেছিলেন বালসারা। সারাদিন সেখানে কাজের সন্ধান, রেলের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে পুলিশের তাড়া খাওয়া, কার্কি স্টেশনের কাঠের বেঞ্চে শুয়ে মশাদের উপদ্রব সহ্য করে রাত কাটানোর কষ্টদীর্ণ অভিজ্ঞতার পরে মিলিটারি ক্যাম্পে ঘোড়াদের স্নান করানোর একটা কাজ জুটে যায় তাঁর। পরে যদিও বাড়ি ফিরে এসেছিলেন তিনি। সেই সময় পার্সি বিয়েবাড়িতে জ্যাজ সঙ্গীত বাজানোর কাজ জুটে গেল বালসারার। এছাড়াও কলেজের পড়া শেষ করেই বম্বের উচ্চ আদালতে একটি সহকারী তথা টাইপিস্টের কাজে যুক্ত ছিলেন তিনি। এরপরে পার্সি সমাজের অগ্নিমন্দির ট্রাস্টের সভাপতিও হয়েছেন বালসারা আর এক মহিলা সমাজসেবিকার অধীনে হিতকারী নানাবিধ কাজও সামলেছেন তিনি। ততদিনে বম্বেতে বিয়েও করে ফেলেছেন। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সংসারজীবন চলছে তাঁর। তাঁরই মধ্যে একত্রিশ বছর বয়সে মোটামুটি সচ্ছ্বল আয়ের কাজ ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন ভি বালসারা। সময়টা ১৯৫৪ সাল। এখানে এসেই ভিয়েস্তাপ আর্দেশিন বালসারা থেকেই তিনি ‘ভি বালসারা’ নামে পরিচিত হন। কাগজের মধ্যে একটা শার্ট, একটা প্যান্ট আর পকেটে মাত্র তিন টাকা নিয়ে কলকাতায় এসে পার্সি গেস্ট হাউসে থাকতে শুরু করেন অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের আশায়। সেই সময় কলকাতার বো স্ট্রিটে (অধুনা সুইনহো স্ট্রিটে) থাকতেন তিনি। কলকাতায় আসার আগে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে সাবধান করেছিল এই বলে যে সেখানকার বাঙালিরা নাকি তাঁকে টিকতে দেবে না। দমে যাবার পাত্র ছিলেন না বালসারা, তাই একপ্রকার জেদ ধরেই কলকাতায় চলে আসা তাঁর। এর আগে ১৯৫৩ সালে অনিল বিশ্বাসের আমন্ত্রণে কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বালসারা আর সেখানেই ‘নিউ থিয়েটার্স’ স্টুডিওর নামজাদা সব শিল্পীরা এসেছিলেন সঙ্গীত সমাবেশে। পঙ্কজ কুমার মল্লিক, যূথিকা রায়, কানন দেবী, সুরকার কমল দাশগুপ্ত প্রমুখদের সঙ্গে সেখানেই সাক্ষাৎ ঘটে তাঁর। কলকাতায় এসে প্রথমেই পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের খোঁজ করতে করতে তিনি এসে পড়েন ন্যাশনাল অর্কেস্ট্রায়। সেখানে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবির একটি গানের রেকর্ডিং চলছিল আর জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের নির্দেশে সেই রেকর্ডিংয়ের সময়েই পিয়ানো বাজাতে বসে যান বালসারা। পরে কলকাতার ১৬ নং অক্রূর দত্ত লেনের বাসিন্দা পঙ্কজ কুমার মল্লিকের বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় সঙ্গীত সাধনা করতেন তিনি। পঙ্কজবাবুর সান্নিধ্যেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হন ভি বালসারা। বম্বের এইচএমভি থেকে পঙ্কজ মল্লিকের একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বেরিয়েছিল যেখানে দুটি গানেরই সুর শুনে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। বাংলা ভাষা পুরোপুরি তখনও বুঝতে পারেন না তিনি, কিন্তু তারই মধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার হল শুরু’ গানের রেকর্ডিং-এ পিয়ানো বাজাতে বসেন বালসারা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর লতা মঙ্গেশকরের জুটিতে সেই গানে পিয়ানো বাজানো শুনে হেমন্তবাবু তাঁকে ধমক দিয়ে নোটেশন অনুসরণ করে বাজাতে বলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীতে কারুকার্য করার জন্য জেলে যাবার ভয়ও দেখিয়েছিলেন বালসারাকে। অক্রূর দত্ত লেনের বাড়িতে থাকার সময় সকালে ঘুম থেকে উঠে আর রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে দুটি বাঁধাধরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে শোনা যেত বালসারাকে – ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’ আর ‘বড়ো আশা করে এসেছি গো কাছে ডেকে লও’। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতাটি প্রায় আশি জনের একটা অর্কেস্ট্রা নিয়ে মঞ্চে পরিবেশন করেছিলেন বালসারা। বিখ্যাত সুরকার সলিল চৌধুরীকেও বড়ো শ্রদ্ধা করতেন তিনি। তাঁর ঘরের পিয়ানোর উপরে রাখা সলিল চৌধুরীর ছবিটা রোজই রুমাল দিয়ে মুছে সঙ্গীত সাধনায় বসতেন বালসারা।
১৯৪২ সালে হিন্দি ছবি ‘বাদল’-এ সঙ্গীত পরিচালক ওস্তাদ মুস্তাক হোসেনের সহকারী হিসেবে কাজ করেন ভি বালসারা। বলা যায় এই ছবিতে কাজের মধ্য দিয়েই চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপরে মাস্টার গোলাম হায়দার এবং খেমচাঁদ প্রকাশকেও সহায়তা করেছিলেন। ১৯৪৩ সালে ‘সার্কাস গার্ল’ ছবিতে প্রথম স্বাধীনভাবে সঙ্গীত পরিচালক বসন্ত কুমারের সঙ্গে গান তৈরি করেন ভি বালসারা। ১৯৪০ এবং ১৯৫০-এর দশকের শুরুতে মুক্তিপ্রাপ্ত ১২টি হিন্দি ছবি এবং মোট ৩২টি বাংলা ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তিনি। হিন্দি ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ও পঞ্ছি’, ‘মদমস্ত’, ‘রঙমহল’, ‘তালাশ’, ‘চার দোস্ত’, ‘বিদ্যাপতি’, প্যায়ার, ‘যোগী অউর জওয়ানি’, ‘মধুশ্রাবণী’, ‘জয় বাবা বৈদ্যনাথ’ ইত্যাদি। বাংলাতে মা, চলাচল, পঞ্চতপা, পথে হল দেখা ইত্যাদি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। এছাড়া সন্ন্যাসী রাজা, জয়দেব, চিরকুমার সভা, পলাতক, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, ধন্যি মেয়ে ইত্যাদি মোট ১১২টি ছবিতে সঙ্গীত আয়োজকের ভূমিকা ছিল বালসারার। রূপোলি পর্দার জগত ছাড়াও যাত্রা, নাটকের মঞ্চেও সঙ্গীত আয়োজন এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ভি বালসারা। ‘কঙ্কাল কথা কও’ নামের একটি যাত্রা ছাড়া ‘কাচের পুতুল’, ‘মুচিরাম গুড়’, ‘আগন্তুক’, ‘সোনালি আগুন’ ইত্যাদি বাংলা নাটক, ‘খোঁজ’ নামের একটি হিন্দি নাটক এবং বহু নৃত্যনাট্য আর পুতুল নাচের সঙ্গীত সংযোজন করেছেন তিনি।
১৯৪০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য ইরান এবং ইরাকে ভ্রমণ করেছিলেন ভি বালসারা। এছাড়া ফিনল্যাণ্ডের হেলসিঙ্কিতে বিশ্ব যুব উৎসবে, রাশিয়ায়, তাসখন্দে এবং হল্যাণ্ড, ইংল্যাণ্ড, দক্ষিণ আমেরিকা, ওয়েস্ট ইণ্ডিজ, জাপান প্রভৃতি নানা দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাঁকে নানাবিধ সঙ্গীতের জ্ঞান অর্জনে আরো সমৃদ্ধ করেছে।
সঙ্গীতজগতে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য ‘সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার’ এবং ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হন ভি বালসারা।
২০০৫ সালের ২৪ মার্চ ভি বালসারার মৃত্যু হয়।
One comment