আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা একটি অন্যতম উৎকৃষ্ট ভাষা, এর শব্দ ও সাহিত্য ভান্ডার অপরিসীম। যেকোনো উৎকৃষ্ট ভাষার একটি প্রধান সম্পদ হলো প্রবাদ, ইংরেজিতে যাকে বলে proverb। বাংলা ভাষায় প্রাচীনকাল থেকেই অনেক প্রবাদ লোকমুখে বা সাহিত্যে প্রচলিত আছে। এই রকমই একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হলো “অন্ধের হাতি দেখা”। এই প্রবাদটির অর্থ হলো কোনো বিষয় বা বস্তু সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান না থাকা। অর্থাৎ অন্ধ ব্যক্তির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা না থাকায় তার হাতিকে দেখার মানে হল অন্ধকারে হাতড়িয়ে কোনো বস্তু সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করা। বর্তমান ক্ষেত্রে দৈনন্দিন জীবনে ঘটনা বিশেষে অনেক ক্ষেত্রে আমরা এই প্রবাদটির প্রয়োগ করে থাকি।
প্রাচীন কালে রাজাদের হাতিশালে হাতি রাখা থাকত। হাতির মালিকরা হাতির পরিচর্যা করে হাতিদের বড় থাম্বায় বেঁধে রাখতেন। একবার কয়েকজন অন্ধের হাতি দেখার শখ হলো। তারা হাতিশালে এসে হাতিকে স্পর্শ করে হাতির আকার-আকৃতি বোঝার চেষ্টা করল। একজন অন্ধ হাতির পা স্পর্শ করে বলে উঠল হাতি হল বড় স্তম্ভ বা পিলারের মতো। অন্য একজন হাতির কান স্পর্শ করে বলল হাতি হচ্ছে কুলোর মতো। আরেক অন্ধ হাতির লেজ ধরে লেজকে নাড়িয়ে দুলিয়ে বললো হাতি আসলে গরুর লেজের মতো। আর একজন অন্ধ হাতির শুঁড় ধরে শুঁড়ের আকার মেপে বলে উঠলো হাতি হল বড় অজগর সাপের মতন।
এখানে উপস্থিত সবাই হাতির নানা অঙ্গ স্পর্শ করে হাতির ব্যাপারে একটা সামগ্রিক ধারণা পেতে চেয়েছে। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি না থাকায় তারা কেউই হাতির বিষয়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়নি। প্রাচীন কালে মহর্ষি গৌতম গৌতম-সংহিতা নামে দর্শন শাস্ত্রের রচনা করেছিলেন। তারই একটি অংশ হল তর্কশাস্ত্র বা যুক্তিবিদ্যা। উপরে উল্লিখিত সমস্ত অনুমানগুলোই এই তর্কশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। এখানে ভিন্ন ব্যক্তি তাদের নিজস্ব তথ্য ও অনুমানের উপর ভিত্তি ক’রে একটি যুক্তিসহ তাদের মতামত পোষণ করেছেন। এখানে উল্লিখিত সমস্ত যুক্তি মহর্ষি গৌতমের অন্ধহস্তি ন্যায় বা অন্ধের হস্তি দর্শন যুক্তির অন্তর্ভুক্ত। অন্ধের হাতি দেখা এই বাগভঙ্গিটির প্রকৃত অর্থ বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় কোনো বিষয় সম্পর্কে সঠিক বা পরিষ্কার ধারণা না থাকলেও ভাঙা ভাঙা কিছু তথ্য বা অংশবিশেষ পর্যালোচনা করে সমগ্র বিষয়ের উপর মতামত প্রদান করা।
উদাহরণ – আজকাল সামাজিক মাধ্যমগুলোয় কোনও ঘটনার সামান্য কিছু জেনেই লোকজন নিজেদের মতামত জাহির করেন – অন্ধের হাতি দেখা একেই বলে।
তথ্যসূত্র
- প্রবাদের উৎস সন্ধান - সমর পাল, শোভা প্রকাশ / ঢাকা ; ৩০ পৃঃ