কার্ল সাগান

কার্ল সাগান

আমেরিকার একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী, মহাকাশবিজ্ঞানী এবং গ্রহবিশারদ কার্ল সাগান (Carl Sagan)। পৃথিবীর বাইরের মহাজাগতিক পরিবেশে প্রাণের অস্তিত্ব আছে বলে বিশ্বাস করতেন তিনি এবং সেই প্রসঙ্গে বিকিরণের মাধ্যমে কীভাবে প্রাথমিক কিছু রাসায়নিক পদার্থ থেকে অ্যামিনো অ্যাসিড উৎপন্ন হতে পারে তার পরীক্ষামূলক প্রদর্শনীও করেন তিনি। তিনিই প্রথম পাইওনিয়ার প্লেক ও ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড মহাকাশযানের মধ্য দিয়ে মহাজাগতিক প্রাণীদের উদ্দেশ্যে কিছু ভৌত বার্তা মহাকাশে পাঠান। তাঁর বিশ্বাস ছিল এই মহাকাশের অন্য কোথাও উন্নত প্রাণী থাকলে তারা সেই বার্তা বুঝে উত্তর পাঠাতে পারে। জনপ্রিয় বিজ্ঞানের কাহিনী লেখার জগতেও তিনি বিশ্বসেরা। তাঁর লেখা ‘কসমস’, ‘দ্য ড্রাগনস অফ ইডেন’, ‘পেল ব্লু ডট’ ইত্যাদি বইগুলি বিশ্বে বহুল চর্চিত ও জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৮০ সালের বিখ্যাত পুরস্কারপ্রাপ্ত টেলিভিশন ধারাবাহিক ‘কসমস : এ পার্সোনাল ভয়েজ’-এর সহ-রচয়িতা ছিলেন কার্ল সাগান। শুধুই আমেরিকাবাসী নয়, বিশ্বের মোট ৬০টি দেশের প্রায় ৫০ কোটি মানুষ এই টেলিভিশন ধারাবাহিকটি দেখেছিলেন সেই সময়। তাঁর মতো এত গভীর এবং প্রাঞ্জলভাবে মহাকাশের নানা ঘটনা সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে কেউ এর আগে বোঝাতে সক্ষম হননি। কর্ণওয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপনা, কখনো নাসা-র রোবোটিক অভিযানে সামিল হওয়ার পাশাপাশি গ্রহবিজ্ঞানের একেবারে আধুনিক একটি রূপ তৈরি করেছিলেন কার্ল সাগান। তাঁর লেখা ‘দ্য ড্রাগনস অফ দ্য ইডেন’ বইটির জন্য কার্ল সাগান পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

১৯৩৪ সালের ৯ নভেম্বর নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন শহরের একটি ইহুদি শ্রমিক পাড়ায় কার্ল সাগানের জন্ম হয়। তাঁর বাবা স্যামুয়েল সাগান বালক বয়সেই ইউক্রেন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে এসেছিলেন। তাঁর মা মলি গ্রুবার সাগান কার্লের জীবনে এক অন্যতম অনুপ্রেরণাদাত্রী ছিলেন। ছোটোবেলা থেকেই আকাশের তারা নিয়ে খুবই উৎসাহিত ছিলেন সাগান। মাত্র নয় বছর বয়স থেকেই বিজ্ঞানের নানা গল্প পড়ার অভ্যাস তৈরি হয় তাঁর মধ্যে এবং সেই সময় থেকেই তিনি ভাবতে থাকেন যে এই পৃথিবীর বাইরে কোথাও নিশ্চিত এই পৃথিবীরই মত প্রাণ রয়েছে। জীববিজ্ঞান এবং মানুষের সৃষ্টির ইতিহাস বরাবর তাঁকে আকর্ষণ করতো। পরবর্তীকালে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা চলাকালীনই ১৯৫৭ সালে জীববিজ্ঞানী লিন মার্গুলিসকে বিয়ে করেন কার্ল সাগান। তাঁদের দুই পুত্রের মধ্যে একজন কল্পবিজ্ঞানের লেখক ডোরিয়ান সাগান এবং অপরজন সফটওয়্যার নির্মাতা জেরেমি সাগান।

১৯৫১ সালে নিউ জার্সিতে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে সাগান শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হন। বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ ও ভালোবাসা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৬০ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই জেরার্ড পি কুইপারের তত্ত্বাবধানে জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর গবেষণা সম্পন্ন করেন তিনি। এই গবেষণার মধ্য দিয়ে তাত্ত্বিকভাবে তিনি দেখিয়েছিলেন যে শুক্র গ্রহের তাপমাত্রা অনেক বেশি হওয়ার মূলে আছে গ্রহের বায়ুস্তরে পুরু কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি এবং গ্রিন হাউস এফেক্টজনিত কারণে ভূপতিত সূর্যালোক বায়ুমণ্ডলে ফেরৎ যেতে না পারা। তিনি আরো দেখান যে, সাধারণভাবে শুক্র গ্রহের ভূমির তাপমাত্রা খুবই শীতল এবং প্রাণের অস্তিত্ব তাতে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে ১৯৬১ সাল নাগাদ এই ধারনার বদল ঘটান সাগান এবং দেখান যে শুধুমাত্র গ্রিন হাউস এফেক্টের জন্য শুক্রের ভূমির তাপমাত্রা প্রায় ৩০০ ডিগ্রিতে পরিণত হয়েছে যাতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। ১৯৬৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পাঠানো একটি মহাকাশযানের প্রেরিত তথ্যে এই ধারণা প্রমাণিত হয়। জীববিজ্ঞানের প্রতি অমোঘ আকর্ষণের কারণে কার্ল সাগান স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যালিফোর্ণিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে সাগানের প্রথম বই প্রকাশিত হয় ‘ইন্টেলিজেন্ট লাইফ ইন দ্য ইউনিভার্স’ নামে। রাশিয়ান পদার্থবিদ আই.এস স্লোভাস্কির একই শিরোনামে একটি বই ছিল কিন্তু সাগানের বইটি এর থেকে আয়তনে দ্বিগুণ এবং বিষয়ের ক্ষেত্রেও সাগান নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৬৩ সালে কার্ল সাগান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। হার্ভার্ডে থাকাকালীন সাগানের প্রখর মেধাবী ব্যক্তিত্ব, তাঁর সুললিত বক্তব্য শুনে ছাত্র, শিক্ষক সকলেই মুগ্ধ হতো। কিন্তু প্রথাগত জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চার বাইরে তিনি বেশ কিছু বিষয় উত্থাপন করতেন যা সেখানকার প্রবীণ অধ্যাপকদের মনঃপূত হয়নি। ১৯৬৮ সালে কর্নওয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন সাগান। এখানে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ডেভিড ডানকান অধ্যাপকের পদে আসীন ছিলেন তিনি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল উর্ধ্বতন ব্যক্তিরা সাগানের প্রথাবিরোধী চিন্তাভাবনাকে সমাদর করতেন। কর্ণওয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরই উদ্যোগে গ্রহবিজ্ঞান এবং বহির্জাগতিক জীববিদ্যার বিষয়ে দুটি পৃথক পাঠক্রম চালু করেন সাগান। মেরিনার ৪ ও মেরিনার ৯ নামে দুটি মঙ্গল অভিযানে সামিল হন তিনি। ‘আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’র ডিভিশন ফর প্ল্যানেটরি সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করেন কার্ল সাগান। ১৯৭০ এবং ১৯৮০ সাল নাগাদ গ্রহবিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা ‘ইকারাস’ সম্পাদনা করতেন তিনি। এই সময় কর্নওয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি ফর প্ল্যানেটরি সাটিজ-এর ডিরেক্টর পদে উন্নীত হন সাগান। বিখ্যাত মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা-র সঙ্গে সাগান একজন পরামর্শদাতা ও উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত ছিলেন। মঙ্গল, শুক্র, বৃহস্পতি এবং শনি গ্রহে মহাকাশযান পাঠানোর অভিযানে নাসা-র বিজ্ঞানীদের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন সাগান। ১৯৬৯ সালে ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স’ সংস্থা আয়োজিত একটি বিতর্কসভায় ইউএফও (UFO)র সত্যিকারের অস্তিস্ত্ব আছে কিনা তা বিষয়ে আলোচনা চলার সময় কার্ল সাগান বিশেষ একটি বক্তব্যের মাধ্যমে ভিনগ্রহের প্রাণীর উপস্থিতির সম্ভাব্যতার কথা তুলে ধরেন। এমনকি নাসা-র পাঠানো প্রথম চারটি মহাকাশযান পাইওনিয়ার ১০ ও ১১ এবং ভয়েজার ১ ও২-এর মধ্যে ভিন গ্রহের প্রাণীদের কাছে মানুষের পক্ষ থেকে বিশেষ সংকেত পাঠান এবং তার সঙ্গে জুড়ে দেন পৃথিবীর নানাবিধ শব্দ, মানুষের কণ্ঠস্বর ইত্যাদি এবং আবশ্যিকভাবে কিছু ছবি। তাঁর বিশ্বাস ছিল এই মহাকাশের অন্য কোথাও উন্নত প্রাণী থাকলে তারা সেই বার্তা বুঝে উত্তর পাঠাতে পারে। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘মার্মারস অফ দ্য আর্থ’-এ এই ঘটনাটির বর্ণনা দিয়েছেন সাগান। ১৯৭৩ সালে তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানের বইটি প্রকাশ পায় যার নাম ‘কসমিক কানেকশন : অ্যান এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল পারস্পেক্টিভ’ এবং তারপরে সাগান লেখেন একটি জনপ্রিয় বই ‘দ্য ড্রাগনস অফ দ্য ইডেন’। এই বইটির জন্য ১৯৭৭ সালে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন কার্ল সাগান। নানাবিধ বৈজ্ঞানিক ধারণা ও আবিষ্কারের তথ্যকে জনপ্রিয় করতে তুলতে কার্ল সাগান ছিলেন অগ্রণীদের মধ্য একজন। ১৯৭৮ সালে লস অ্যাঞ্জেলসে বৃহস্পতি ও শনি গ্রহে ভয়েজার মহাকাশযান পাঠানোর ব্যাপারে কাজ করতে যান কার্ল সাগান। টেলিভিশনের জন্য একটি ১৩ ঘণ্টার অনুষ্ঠান করেন সাগান এই সময়। ‘কসমস’ নামের এই অনুষ্ঠান মার্কিন অধিবাসীরা ছাড়াও বিশ্বে আরো ৬০টি দেশের প্রায় ৫০ কোটি মানুষ দেখেছিলেন। এই বিষয়ে ‘কসমস’ (১৯৮০) নামেই সাগানের একটি বইও প্রকাশিত হয় যা ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার বিচারে ৭০ সপ্তাহ ধরে বেস্টসেলারের পর্যায়ে ছিল। এই বইটিই বলা যায় সাগানকে একাধারে ধনী ও বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলে। তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘পেল ব্লু ডট : এ ভিশন অফ দ্য হিউম্যান ফিউচার ইন স্পেস’ যা প্রকাশ পায় ১৯৯৫ সালে। এও বইতেই তিনি দ্রুতগতিতে ধাবমান মহাকাশযান থেকে সৌরমণ্ডলের প্রান্ত ছাড়িয়ে যাওয়ার মুহূর্তে তোলা পৃথিবীর নিষ্প্রভ নীল বিন্দুর মতো ছবির এক অনবদ্য ভাষ্যবর্ণনা দিয়েছেন।

পৃথিবীর বাইরের মহাজাগতিক পরিবেশে প্রাণের অস্তিত্ব আছে বলে বিশ্বাস করতেন তিনি এবং সেই প্রসঙ্গে বিকিরণের মাধ্যমে কীভাবে প্রাথমিক কিছু রাসায়নিক পদার্থ থেকে অ্যামিনো অ্যাসিড উৎপন্ন হতে পারে তার পরীক্ষামূলক প্রদর্শনীও করেন তিনি। ১৯৮৩ সালে কিছু সহকারীদের সঙ্গে একত্রে সাগান প্রকাশ করেন একটি গুরুত্বপূর্ণ বই ‘নিউক্লিয়ার উইন্টার : গ্লোবাল কনসিকোয়েন্সেস অফ মাল্টিপল নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশানস’। এই বইতে সাগান ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে সম্ভাব্য এক নিউক্লীয় যুদ্ধের কথা বলেন যার ফলে প্রভূত ধুলোয় ঢেকে যাবে পৃথিবীর একটি অর্ধ। ফলে সূর্যালোক মাটিতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং প্রাণীদের বেঁচে থাকা ও অস্তিত্বরক্ষা দুষ্কর হয়ে পড়বে বলে ধারণা দিয়েছেন সাগান।

১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে মার্স পাথফাইন্ডার ল্যাণ্ডার যখন মঙ্গলের মাটি ছোঁয় তখন কার্ল সাগানের স্মৃতিতে ঐ ল্যাণ্ডারের নামকরণ করা হয় ড. কার্ল সাগান মেমোরিয়াল স্টেশন।

বহু ব্যাপ্ত কাজের জন্য তিনি নানাসময় নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৭ সালে নাসা ডিস্টিঙ্গুইশড পাবলিক সার্ভিস মেডেল, ‘কসমস’ বইটির জন্য ১৯৮১ সালে হুগো পুরস্কার, ১৯৯৪ সালে আইজ্যাক আসিমভ পুরস্কার ইত্যাদি সম্মানীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন কার্ল সাগান।

১৯৯৬ সালের ২০ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনের সিয়াটেলে কার্ল সাগানের মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান