চরক

চরক

ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্রের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করলে সেই প্রাচীনকালের যেসব ঋষিতুল্য মানুষের অবদান প্রথমেই বর্ণনা করা প্রয়োজন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম চরক (Charaka)। ভারতবর্ষের প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র আয়ুর্বেদে চরকের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। তিনি ‘চরক সংহিতা’ নামক একটি প্রাচীন প্রামাণিক চিকিৎসাগ্রন্থের সম্পাদক ছিলেন। তাঁকে অনেকেই ‘ভারতীয় ঔষধের জনক’ বলে অভিহিত করতে চান। রোগের প্রতিকারের চেয়েও রোগ প্রতিরোধই হল অধিক উত্তম এবং গুরুত্বপূর্ণ, চরকই এই মতবাদের প্রাথমিক প্রবক্তা। রোগ নির্ণয়ের উপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন তিনি। তিনি মনে করতেন, মানুষের প্রচেষ্টা এবং জীবনযাপনের প্রতি মনোযোগ বিশেষত ছয়টি ঋতুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবনধারার পুনর্গঠন করতে পারলে দীর্ঘজীবন লাভ করা সম্ভব। কফ, পিত্ত, বায়ু —মানবদেহের এই তিনটি উপাদান বা ‘দোষ’-এর মধ্যে ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে অসুস্থতা সৃষ্টি হয়, এই ছিল তাঁর মত। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন সংস্থান অধ্যয়ন করেছিলেন তিনি। মানবশরীরে ৩৬০টি হাড়ের অস্তিত্বের কথাও বলেছিলেন চরক। তাঁর সম্পাদিত ‘চরক সংহিতা’ গ্রন্থটি আরবি, লাতিন-সহ বিভিন্ন বিদেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছিল।

চরকের জন্মের সময়কাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ বলেন আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাঁর জন্ম, আবার কেউ বলেন ১৫০-২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পরে এবং ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে চরকের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। কেউ বা বলেন, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে চরকের আবির্ভাব। কোনও কোনও গবেষক অনেক তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম থেকে দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যেই চরকের সময়সীমা। সম্ভবত কাশ্মীরে চরকের জন্ম হয়। ‘চরক সংহিতা’য় চন্দ্রভাগা নদীটির উল্লেখ থেকেও চরকের ভৌগোলিক অবস্থানের একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। চরকের পরিচয় সংক্রান্ত আলাদা আলাদা বেশ কয়েকটি তথ্য পাওয়া যায়। বৈদিক যুগে কৃষ্ণ যজুর্বেদের একটি শাখা ‘চরক’ নামে পরিচিত ছিল। আবার বৌদ্ধ গ্রন্থের চিনা অনুবাদ ‘সম্যুক্ত রত্ন পীঠক সূত্র’ অনুসারে চরক ছিলেন রাজা কনিষ্কের একজন দরবারী চিকিৎসক। অনেকে আবার বলে থাকেন, চরক তাঁর প্রকৃত নাম নয়, সেটি উপাধি। আবার, যে সকল চিকিৎসক জনগণকে চিকিৎসা প্রদানের জন্য নানা স্থানে ঘুরে বেড়াতেন, তাদেরকেও চরক বলা হত। এই তথ্যটিকে সমর্থন করে ‘চরক সংহিতা’। তাতে এমন অনেক স্থাননাম পাওয়া যায়, যেখানে চরক আয়ুর্বেদ প্রচার ও অনুশীলন করতেন। আরেকটি আয়ুর্বেদিক সংকলন ‘ভবপ্রকাশ’-এ বর্ণনা করা হয়েছে যে, চরক একজন ঋষি যিনি সর্প রাজা এবং বিষ্ণুর দাস শেষনাগের অবতার হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেকারণে ‘চরক জয়ন্তী’ নাগপঞ্চমী হিসেবেও পালিত হয়। চরকের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তথ্য খুব বেশি পাওয়া যায় না। এমনকি তাঁর পিতা-মাতা সম্বন্ধেও জানা যায়নি কিছুই।

প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদশাস্ত্রের অনুশীলন করতেন চরক এবং সেই শাস্ত্র অনুযায়ী একটি প্রায় বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অবলম্বন করেই চিকিৎসাকার্য করতেন তিনি। রোগের প্রতিকার করবার চেয়ে প্রতিরোধ করা উত্তম, চরক সম্ভবত এই মতবাদের প্রাথমিক প্রবক্তা ছিলেন। চরকের মতে, যে চিকিৎসক রোগীর শরীরে জ্ঞান এবং বোধের প্রদীপ নিয়ে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হন, তিনি কখনওই রোগের চিকিৎসা করতে পারেন না। তাঁর মতে, প্রথমে রোগীর পরিবেশ-সহ আনুষঙ্গিক আরও অনেক তথ্য জানা এবং রোগের কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করা উচিত চিকিৎসকের। নিরাময়ের চেয়ে রোগের উপস্থিতি রোধ করা তাঁর কাছে খুবই জরুরি বিষয় ছিল।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

চরক অনুযায়ী, স্বাস্থ্য ও রোগ পূর্বনির্ধারিত নয়। মানুষের প্রচেষ্টা এবং জীবনযাত্রার প্রতি মনোযোগ ও যত্নশীলতা, দীর্ঘজীবন লাভের একটি উৎকৃষ্ট উপায় বলে তাঁর মত। ভারতীয় ঐতিহ্য এবং আয়ুর্বেদিক ব্যবস্থা অনুসারে, সমস্ত রোগ প্রতিরোধের জন্য ঔষধ প্রয়োগে চিকিৎসার চেয়ে বরং যদি ছয়টি ঋতুর সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে জীবনযাপনের অভ্যাসকে পুনর্গঠন করে নেওয়া যায়, তবেই যথেষ্ট পরিমাণে সুফল লাভ করা সম্ভব। চিকিৎসার সময়ে চরক পেশাদার আচরণ এবং নৈতিক আদর্শ অনুসরণ করতেন এবং তেমনটা করার পরামর্শও দিতেন। চরক বলেছিলেন মানবশরীরের তিনটি দোষ বা নীতি রয়েছে। সেগুলি হল কফ, বাত (বায়ু) ও পিত্ত। এই শ্রেণিবিভাগের সঙ্গে পাশ্চাত্য চিকিৎসক হিপোক্রেটিসের ফোর হিউমার তত্ত্বের বেশ মিল রয়েছে৷ চরকের মতে, মানবদেহের উক্ত তিন দশার ভারসাম্য যদি বিঘ্নিত হয়, তবেই দেহে অসুস্থতার সৃষ্টি হয়। এই ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের জন্য ঔষধের পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও শরীরে জীবাণুর অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলেও তাকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি চরক। চরকই প্রথম চিকিৎসক যিনি হজম, বিপাক এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটির ধারণা উপস্থাপন করেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, চরক জেনেটিক্স তথা বংশগতিবিদ্যার মৌলিক বিষয়গুলি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। যে কারণগুলির ওপর একটি শিশু কোন লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হবে তা নির্ভর করে, চরক সেই কারণগুলিও জানতেন। জন্মের পর কোনও কোনও শিশু অন্ধত্ব বা পঙ্গুত্বের শিকার হয় মাঝে মাঝে। চরকের মতে, এটি  তাঁর মাতা বা পিতার কোনও ত্রুটির কারণে নয় বরং তাঁদের ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুর সমস্যার কারণে ঘটে।

এখানে উল্লেখ্য যে মানবশরীর সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞানলাভ করেছিলেন চরক। মানবদেহ এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অ্যানাটমি বা শারীরসংস্থান অধ্যয়ন করেছিলেন তিনি মনোযোগ সহকারে। তিনি জানিয়েছিলেন যে, দাঁতসহ শরীরে উপস্থিত হাড়ের সংখ্যা ৩৬০। তাঁর একটি ভুল ধারণা এই ছিল যে, হৃৎপিণ্ডে বুঝি কোনও গহ্বর আছে। কিন্তু পরবর্তীকালে সঠিকভাবেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, হৃৎপিণ্ড হল মানবদেহের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। তাঁর দাবি ছিল তেরোটি প্রধান চ্যানেলের সাহায্যে গোটা মানবশরীরের সঙ্গে হৃৎপিণ্ডের যোগাযোগ রয়েছে। এছাড়াও ছোট-বড় নানা আকারের অনেকগুলি এমন চ্যানেলের অস্তিত্বের কথাও তিনি বলেছিলেন, যেগুলি কেবলমাত্র পুষ্টি সরবরাহই করে না, বর্জ্যপদার্থগুলির নিঃসরণেও সাহায্য করে থাকে। এও দাবি করেছিলেন তিনি যে, এই প্রধান চ্যানেলগুলিতে কোনও বাধার সৃষ্টি হলে রোগের জন্ম হয়।

চরকের একটি অন্যতম কৃতিত্ব হল রোগের সংঘটন এবং তাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রাচীনকালের অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কার থেকে চিকিৎসাবিদ্যাকে মুক্ত করা। তিনি রোগ নিরাময়ে যৌক্তিক চিকিৎসাপদ্ধতির প্রবর্তন করেছিলেন। চরক দেহ-মন-আত্মার ত্রিগুণ প্রক্রিয়াটি উত্থাপন করেন। তাঁর মতে, মানবজীবন মন, আত্মা এবং শরীর এই ত্রিপদের উপর ভিত্তি করে চলে। তাঁর এই তত্ত্ব পরবর্তীকালে সাইকোসোমাটিক (Psycho-somatic) বা মানসিক সমস্যাজনিত রোগের একটি ধারণা গঠনে সাহায্য করেছিল। আয়ুর্বেদশাস্ত্রের তিন মহাগ্রন্থের মধ্যে অন্যতম একটি হল ‘চরক সংহিতা’। চরকের নামাঙ্কিত হলেও পণ্ডিতেরা দেখিয়েছেন, আসলে তা চরকের রচনা নয়। এই গ্রন্থ প্রথম শতাব্দীতে উদ্ভুত বলে মনে করেন অনেকে। প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসার ওপর লিখিত এই প্রামাণ্য গ্রন্থটি খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে আয়ুর্বেদিক পণ্ডিত পুনর্বসু আত্রেয়ার ছয় শিষ্যের মধ্যে অগ্নিবেশ নামক এক শিষ্যের লেখা। এই শিষ্যদের প্রত্যেকেই আত্রেয়ার চিন্তাধারার পাশাপাশি নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তাধারাকে রেখে একটি করে সংহিতা রচনার কাজে হাত দিয়েছিলেন। সেগুলির মধ্যে এই ‘অগ্নিবেশ-সংহিতা’ গভীরতা এবং বিষয়বস্তুতে ছিল অনন্য। বহু বছর পরে এই গ্রন্থটিকেই চরক পরিমার্জন করেন, অগ্নিবেশের কাজের সংক্ষিপ্ত সূত্র, শৈলী সংকলন ও সংশোধন করেন ও এর টীকা রচনা করেন এবং গ্রন্থটি ‘চরক সংহিতা’ নামেই পরিচিতি লাভ করে। মোট আটটি ভাগ বা অষ্টাঙ্গ স্থানে এই গ্রন্থটি বিভক্ত। যথা, সূত্র, নিদান, বিমান, শরীর, ইন্দ্রিয়, চিকিৎসা, কল্প এবং সিদ্ধ। মোট ১২০টি অধ্যায় আছে এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থের শেষের এক-তৃতীয়াংশ চিকিৎসক দ্রিধাবালা দ্বারা সংকলিত হয়েছিল। এই গ্রন্থে চরক বিভিন্ন রোগের কারণ, প্যাথোলজি এবং ব্যবস্থাপনা ব্যাপকভাবে বর্ণনা করেছিলেন। এই গ্রন্থে চরক যে ‘নিদান পঞ্চক’ নামক রোগ-নির্ণয় কৌশলের বর্ণনা করেছেন আয়ুর্বেদ চর্চাকারীর দল তা আজ সফলভাবে অনুশীলন করে। এছাড়াও মহামারী সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি বিশদে। মহামারীর কারণ, প্রভাব এবং কী কী করণীয়, সবই বিস্তারিত লিখেছিলেন তিনি। ‘চরক সংহিতা’ মানুষের দীর্ঘায়ুর সন্ধান করেছিল। ‘নিদান পরিবর্জন’ নীতিটির উল্লেখ রয়েছে চরক চিকিৎসায়। এই নীতির মূল হল, প্রতিরোধমূলক ঔষধি। চরক সংহিতায় হাজার হাজার ভেষজ উদ্ভিদের গুণাগুণ এবং থেরাপিউটিক ক্রিয়ার বর্ণনা রয়েছে। চ্যবনপ্রাশ, চিত্রকদি বটি, কংস হরিতকী, সিতোপলাদি চুর্ণ, তালিশাদি বটি, নবায়স চুর্ণ, পুষ্যানুগ চূর্ণ ইত্যাদির মতো জনপ্রিয় আয়ুর্বেদিক সূত্রগুলি আচার্য চরকের অবদান। ভারতীয় চিকিৎসাকে বলা ভাল আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাকে, কায়চিকিৎসা, বালাচিকিৎসা (শিশুচিকিৎসা), ভূতবিদ্যা বা দানবীয় রোগের চিকিৎসা, শল্যতন্ত্র বা আয়ুর্বেদিক সার্জারি, আগদতন্ত্র বা বিষবিদ্যা ইত্যাদি মোট আটটি শাখায় বিভক্ত করা হয়েছে ‘চরক সংহিতা’য়। ফিজিওলজি (Physiology), ইটিওলজি (Eateology), ভ্রুণবিদ্যা ইত্যাদি সম্পর্কেও বিশদ আলোচনা পাওয়া যায় গ্রন্থটিতে।

এই জনপ্রিয় গ্রন্থটি আরবি এবং লাতিন ভাষা ছাড়াও অন্যান্য অনেক ভাষাতেই অনুদিত হয়েছিল। চরককে খুব সঙ্গত কারণেই ‘ভারতীয় ঔষধের জনক’ বলা হয়ে থাকে।

অনেক পণ্ডিত বলেন, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে চরকের মৃত্যু হয়েছিল৷ এই নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে।

তথ্যসূত্র


  1. জীবনীকোষ (ভারতীয়-ঐতিহাসিক), তৃতীয় খন্ড, শশীভূষণ বিদ্যালঙ্কার, ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ
  2. https://en.wikipedia.org/
  3. https://www.britannica.com/
  4. https://www.yousigma.com/
  5. https://www.ediblewildfood.com/
  6. https://www.dailyexcelsior.com/

আপনার মতামত জানান