দান্তে

দান্তে আলিগিয়েরি

মধ্যযুগের এক খ্যাতনামা ইতালিয়ান কবি হলেন দান্তে আলিগিয়েরি(Dante Alighieri)৷ তিনি মূলত গদ্য রচয়িতা হিসেবে বিখ্যাত হলেও তিনি একাধারে ভাষাতাত্ত্বিক, দার্শনিক এবং রাজনৈতিক চিন্তাবিদ হিসেবেও পরিচিত৷ তিনি বিশ্ব সাহিত্যে খ্যাত হয়ে আছেন তাঁর মহাকাব্যিক রচনা ‘লা কমেডিয়া'(La commedia)’র জন্য পরবর্তীকালে যার নাম হয় ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’৷

দান্তে আলিগিয়েরির জন্মের সঠিক তারিখ বা সময়কাল নিয়ে সংশয় আছে। অনুমান করা হয় ১২৬৫ সালের ২১ মে থেকে ২০ জুনের মধ্যে কোন একসময়ে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে তাঁর জন্ম হয়৷ তাঁর বাবার নাম ছিল আলিয়াগিয়েরো (Alighiero di Bellincione) আর মায়ের নাম ছিল বেল্লা। ধারনা করা হয় তাঁর দাদু দুরান্তের নাম অনুসারেই দান্তে আলিগিয়েরির নামের একটি অংশ ‘দান্তে’ এবং অপর অংশটি নেওয়া হয়েছিল তাঁর বাবা আলিয়াগিয়েরোর নামানুসারে।  দান্তের যখন মাত্র দশ বছর বয়স তখন তাঁর মা মারা গেলে তাঁর বাবা আলিয়াগিয়ারো দ্বিতীয় বিবাহ করেন।

দান্তে আলিগিয়েরির প্রাথমিক পড়াশোনা বা শিক্ষা সম্পর্কিত কোন তথ্য জানা যায় না৷ অনুমান করা হয় তিনি বাড়িতে বা ফ্লোরেন্সের একটি গির্জা বা মঠের সাথে সংযুক্ত কোন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা  করেছিলেন। তিনি টুসকান(Tuscan) কবিতার ওপর পড়াশোনা করেছেন। তাঁর অন্যতম প্রিয় কবি ছিলেন গুইডো গুইনিজেলি (Guido Guinizelli)৷ প্রভেনকাল ( Provencal) ভাষায় লেখা চারণ কবিতাতাঁকে আকৃষ্ট করত। আর্নৌট ড্যানিয়েল, সিসেরো, ওভিড এবং বিশেষত ভার্জিলের মতন লাতিন লেখকদের লেখা তিনি পড়তে পছন্দ করতেন। 

দান্তে আলিগিয়েরির সবথেকে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের মধ্যে পড়ে তাঁর সাহিত্য কর্ম। দান্তের শুরুর দিকের কবিতাগুলি মূলত প্রেমের কবিতা। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘লা ভিতা নুওভা’- ( La Vita Nuova)  ১৩০১ সালে প্রকাশিত হয়।একত্রিশটি কবিতার সংকলন এই বইটি প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।এই বইটি ছিল লিরিকাল সনেটের উপর৷ তাঁর প্রিয়তমা বিয়েত্রিচ( Beatrice Portinari) এর কথা এতে লিখেছেন। গুইদো কাভালকান্তিকেই তিনি তাঁর প্রথম বই ‘লা ভিতা নুওভা’ উৎসর্গ করেছিলেন। ইতালিয়ান কবি গুইদো কাভালকান্তি ছিলেন দান্তের প্রিয় বন্ধু যাঁর প্রভাব দান্তের সাহিত্যচর্চায় ভীষণভাবে পড়েছিল। দান্তের লেখা শেষ বই ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’। এটির মূল নাম ছিল ‘ ‘লা কমেডিয়া’। বইটি লেখা হয়েছিল ফ্লোরেন্সের স্থানীয় ভেনেশিয়ান ভাষায়। বইটি তিন খন্ডে বিভক্ত। এতে তৎকালীন চার্চের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সমসাময়িক রাজনীতির ব্যাঙ্গাত্মক রূপ তুলে ধরা হয়েছে। ডিভাইন কমেডিতে দান্তে নরক থেকে স্বর্গ পর্যন্ত  যাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন৷ বাংলা ভাষা সহ পৃথিবীর অসংখ্য ভাষায় এই মহাকাব্য অনুবাদ করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ইতালীয় সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এটি৷ এই কাব্যকে মহাকাব্যিক আখ্যা দেওয়া হয়৷ এই কাব্যে পরকাল অর্থাৎ  মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের কাল্পনিক কাহিনী উপস্থাপন করা হয়েছে। মধ্যযুগে পাশ্চাত্য গির্জাগুলোর জীবনযাপন দান্তের কবিতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। খ্রিস্টান ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে দান্তের নরক ভ্রমণ ও স্বর্গ যাত্রার কাহিনী এই মহাকাব্যের মূল বিষয়। এছাড়াও তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে ইল কনভিভিও, দে ভুলগারি এলোকুয়েন্তিয়া, দে মনার্কিয়া, অন মোনার্কি ইকলোইউজে, রিমি, অপেরি, দ্য পোর্টেব্‌ল দান্তে, দান্তে’স লিরিক পোয়েট্রি ইত্যাদি।

এই মহান কবির জীবন কিন্তু সুখের ছিল না৷ তিনি ছিলেন নির্বাসিত কবি। দান্তে ছিলেন পোপের অন্যায় কাজকর্মের একজন কড়া সমালোচক। ফ্লোরেন্সে তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ১৩০২ সালের ২৭ জানুয়ারি দান্তের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাঁর বিচার করা হয় এবং রায়ে শাস্তি হিসেবে পাঁচ হাজার ফ্লোরিন জরিমানা করা হয় সাথে আগামী দুই বছরের জন্য ফ্লোরেন্সে প্রবেশ তাঁর জন্য নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। দান্তে জরিমানা জমা করেন নি৷  প্রায় বারো বছর পর তাঁর আত্মীয় স্বজনরা তাঁকে বলেন ক্ষমা প্রার্থনা করে নিতে তাতে হয়ত শহরে ফেরার ব্যবস্থা করা যাবে৷ কিন্তু দান্তে মানসম্মান-খ্যাতি সব বিসর্জন দিতে ফিরতে রাজী হননি৷ চির নির্বাসন থেকে দান্তে আর কখনোই তাঁর জন্মশহর ফ্লোরেন্সে ফিরে যেতে পারেননি। সারাটা জীবন তিনি ঘুরে বেড়িয়েছিলেন নানা স্থানে৷ তাঁর নিজ অভিজ্ঞতা গদ্যে কবিতায় দর্শনে তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। 

১৩৪৮ সালে জিওভানি বোকাচিয়ো (Giovanni Boccaccio)’ ভিটা দি দান্তে ‘ (Vita di Dante) নামে দান্তের জীবনী রচনা করেন৷ ইতালির প্রথম রণতরী ১৯১৩ সালে সম্পূর্ণ হয়। দান্তের প্রতি সম্মান দেখিয়ে এর নাম রাখা হয় দান্তে আলিগিয়েরি। জাহাজটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়েছিল। 

১৩২১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর দান্তে আলিগিয়েরিরর মৃত্যু হয়৷  ২০০৮ সালে ফ্লোরেন্সের মিউনিসিপ্যালিটি জীবদ্দশায় দান্তের প্রতি হওয়া অবিচার অন্যায়ের প্রতি সরকারী ভাবে ক্ষমা চেয়ে নেন৷ 

One comment

আপনার মতামত জানান