প্রচলিত মতে বাংলা তথা বিশ্বের প্রথম দুর্গাপূজা হল মেধস আশ্রমের দুর্গাপূজা। প্রচলিত গল্প অনুযায়ী রাজা সুরথ বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। মেধস মুনির কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে মেধসাশ্রমে তিনি এবং বৈশ্য সমাধি দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন। সেই থেকে এই পুজো আজও হয়ে আসছে।
বলা হয়ে থাকে দেবী দুর্গা মর্তে সর্ব প্রথম মেধস ঋষির আশ্রমে অবতীর্ণ হন। মেধস মুনি, রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধিকে প্রথম দুর্গোৎসবের পাঠ দিয়েছিলেন। কোল ভিল দের দ্বারা পরাজিত, রাজ্যহারা রাজা সুরথ ও স্বজন পরিত্যক্ত সমাধি বৈশ্য উপস্থিত হয়েছিলেন মেধা মুনির আশ্রমে। মেধাশ্রমে মুনিপদে তাঁদের দুঃখের কথা ব্যক্ত করেন। মেধা ঋষি সুরথ ও সমাধি বৈশ্যের জাগতিক দুঃখ-দুর্গতির কথা শুনে মুনি তাঁদের শোনালেন, ‘মধুময়ী চন্ডী’। রাজা ও বৈশ্য নিজেদের দুরবস্থা থেকে মুক্ত হতে মেধসের আশ্রমে মাটি দিয়ে দুর্গা প্রতিমা নির্মাণ করেছিলেন। তাদের হাত ধরেই মর্তলোকে প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা। সেই থেকে আজ অবধি, এখানে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে।
অবশ্য মেধসের আশ্রম কোথায় সে নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। এর একটি মত অনুযায়ী, বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় করলডেঙ্গা পাহাড়ে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের হিন্দু বাঙালিদের অন্যতম বৃহৎ তীর্থস্থান। বলা হয়ে থাকে, এই স্থান থেকেই সমগ্র বঙ্গদেশে বাঙালিদের মধ্যে ও পরে সমগ্র ভারতে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দুর্গাপুজো বিশাল জনপ্রিয়তা লাভ করে। পুরাকালের এই আশ্রমের কথা শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে তার প্রচার বেশি ছিল না। কথিত আছে দৈববলে পাহাড়-পর্বত পরিভ্রমণ বেদানন্দ স্বামী এই তীর্থভূমি আবিষ্কার করেন। সেই থেকে মানুষের মধ্যে এর প্রচার বাড়তে থাকে। বর্তমানে জায়গাটি ভক্তদের মধ্যে খুবই প্রসিদ্ধ। প্রতিবছর মহালয়ার মাধ্যমে দেবী পক্ষের সূচনা হয়। ভোর থেকে চণ্ডীর আরাধনার মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে আহ্বান করা হয়। প্রায় ৬৮ একর জায়গাজুড়ে স্থাপিত এই মন্দিরে রয়েছে চণ্ডী মন্দির, শিব মন্দির, সীতা মন্দির, তারা কালী মন্দিরসহ ১০টি মন্দির। আশ্রমের প্রধান ফটক দিয়ে প্রায় আধ কিলোমিটার যাওয়ার সিঁড়ি। সেই সিঁড়ির ১৪০টি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলে মেধস মুনির মন্দির । এই মন্দিরের পরই দেবী চণ্ডীর মূল মন্দির। এর একপাশে সীতার পুকুর, পেছনে রয়েছে ঝরনা।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ মন্দিরের ওপর চলেছিল ধ্বংসযজ্ঞ। পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ এপ্রিল আশ্রমটি জ্বালিয়ে দেয়, কামানের গোলা দিয়ে আশ্রমের কাঠামো নষ্ট করে দেয়। তারপর ধ্বংসাবশেষ থেকে লুটে নেয় মূল্যবান প্রতিমা। সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার দরুন মন্দিরে দেবতাদের আরাধনা প্রায় সাত বছর বন্ধ ছিল । ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে পাথরের মূর্তি দিয়ে পুনঃস্থাপন করা হয় মন্দিরটি।
অপর একটি মত অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরের অদূরে গড়জঙ্গল বলে এক স্থানে এই মেধস আশ্রম। যোগীরাজ ব্রহ্মানন্দগিরি মহারাজ ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে বোলপুরে থাকাকালীন জঙ্গলের খুব গভীরে এক মন্দিরের কথা শোনেন এবং ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে গড়জঙ্গলের বর্তমান স্থানে পৌঁছান যেখানে উইঢিপি ঢাকা প্রাচীন মন্দির, অশ্বত্থ, পাকুড় গাছ দেখতে পান। পরবর্তীকালে এখানে খোঁড়াখুঁড়ির ফলে মন্দির ও তার ভগ্নাংশ মেলে। মারকন্ডেয় পুরাণ এর শ্লোক অনুযায়ী এই মন্দির ও এখানে প্রাপ্ত মাটির দুর্গাকেই সুরথ রাজার পুজো করা প্রথম দুর্গা বলে মনে করা হয় এবং মন্দির ও তৎ সংলগ্ন আশ্রমকে মেধস মুনির আশ্রম বলে মনে করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গড়জঙ্গলের দুর্গা পুজার শেষে ‘বন্দে মাতরম’ বলা হয় যার কারণ প্রচলিত ধারণা এখানে দেবী চৌধুরানী পুজা দিতেন। তবে মন্দিরের ভগ্নাবশেষ থেকে মন্দিরের প্রাচীনত্ব নির্ণয় ঐতিহাসিক গবেষণার দাবী রাখে।
লেখাটি শুনতে হলে এখানে শুনতে পারেন
2 comments