বুসিফেলাস

বুসিফেলাস ।। আলেকজান্ডারের ঘোড়া

পৃথিবীর ইতিহাসে সম্রাট আলেকজান্ডারের নাম সুবিদিত তাঁর শৌর্য, বীর্য এবং অকল্পনীয় সামরিক দক্ষতার জন্য সুবিদিত। আলেকজান্ডারের একটি অত্যন্ত প্রিয় ঘোড়া ছিল যার নাম ছিল ‘ বুসিফেলাস ‘ (Bucephalus)। প্রাচীন গ্রিক গাথা এবং প্রাচীন ঐতিহাসিক বিভিন্ন লেখাতে বুসিফেলাসের উল্লেখ যেভাবে বারে বারে উঠে এসেছে তাতে মনে করা যেতে পারে আলেকজান্ডারের অপ্রতিরোধ্য মানসিকতাকে আরও শক্তি জুগিয়েছিল তাঁর সবথেকে বিশ্বস্ত সঙ্গী তাঁর ঘোড়া বুসিফেলাস। আলেকজান্ডারের সাথে বুসিফেলাসের প্রথম সাক্ষাৎটিই ঠিক করে দেয় আলেকজান্ডার এবং তাঁর ঘোড়া কেউই সাধারণ নয়, তাঁরা দুজনেই ইতিহাস রচনা করতে এসেছেন।

ম্যাসিডনের রাজা তখন দ্বিতীয় ফিলিপ। রাজপ্রাসাদে রোজকার মত তিনি সভা বসিয়েছেন সবে এমন সময় একজন কর্মচারী এসে খবর দিলেন থেসালি থেকে এক ঘোড়া বিক্রেতা এসেছেন একটি ঘোড়া বিক্রি করতে। ফিলিপ খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না। তাঁর রাজ আস্তাবলে দক্ষ এবং সুঠাম চেহারার ঘোড়ার কোন অভাব নেই। কর্মচারীকে বলে পাঠালেন তিনি ঘোড়া কিনতে আগ্রহী নন। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে ওই কর্মচারী আবার ফিরে এলেন। ফিলিপ এবার একটু বিরক্তই হলেন। তিনি তো বলে পাঠালেন যে তিনি ঘোড়া কিনতে আগ্রহী নন। কর্মচারীটি তাঁকে বললেন ওই বিক্রেতা রাজা মশাইকে একটিবার তাঁর ঘোড়াটিকে দেখতে বললেন। বললেন তাঁর কাছে যে ঘোড়াটি আছে সেটির সমকক্ষ ঘোড়া সমগ্র ম্যাসিডনে আর একটিও নেই। রাজা ফিলিপ ভেবে দেখলেন এত করে যখন বলছে একবার দেখাই যাক না কি এমন পক্ষীরাজ ওই বিক্রেতা এনেছে। তিনি ওই কর্মচারীকে বললেন – যাও গিয়ে ওনাকে বল আমি আসছি। উনি যেন অপেক্ষা করেন।

রাজপ্রাসাদের যে প্রাঙ্গণে ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণ হয় সেখানে এসে পৌঁছলেন রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ। সঙ্গে রয়েছেন রাণী অলিম্পিয়া। এক ব্যাক্তি সুঠাম চেহারার কালো রঙের একটি ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রাজা কে দেখেই অভিবাদন জানিয়ে ওই ব্যক্তি নিজের পরিচয় দিলেন – মহারাজ আমি ফিলোনিকাস সুদূর থেসালি থেকে আসছি। আমার সাথে যে ঘোড়াটি রয়েছে তার নাম বুসিফেলাস। বুসিফেলসের মত শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান ঘোড়া এই ম্যাসিডনে যে আর একটাও নেই এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। রাজা ফিলিপ ভালো করে দেখতে লাগলেন বুসিফেলাসকে – কুচকুচে কালো গায়ের রং। ঘাড়ের কেশরগুলোও কালো। গায়ের লোম এতই চকচক করছে সূর্যালোকে যেন মনে হয় ঘোড়াটিকে তেল মালিশ করে আনা হয়েছে সবে। তবে ঘোড়াটির একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হল – ঘোড়াটির মাথার মাঝখানে শিংয়ের মত দেখতে সাদা একটি অংশ আছে যে কারণে তার নাম বুসিফেলাস অর্থাৎ শিংওলা ষাঁড়। থিসালীয় প্রজাতির ঘোড়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ঘোড়া বলা যেতে পারে এই বুসি ফেলাসকে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

রাজা দাম জিজ্ঞেস করলেন কিন্তু দাম শুনে তো চক্ষু চড়কগাছ! তেরো ট্যালেন্ট (তৎকালীন ম্যাসিডনের মুদ্রা)! বলে কি লোকটা! এতো প্রায় চারগুণ দাম চাইছে ! রাজা বললেন দাম কমাতে! কিন্তু ঘোড়া বিক্রেতা কিছুতেই রাজি হলেন না! এই দরদাম করতে করতে হঠাৎ ঘোড়াটি দু পা তুলে প্রবল একটি ডাক ছাড়লো। ঘোড়া বিক্রেতা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলেন কিন্তু বাগ মানাতে পারলেন না কিছুতেই। প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলেন কিন্তু পারছেন না কিছুতেই। ঘোড়াটি প্রায় ছিটকে ফেলে দেয় আরকি সেই বিক্রেতাকে। বেগতিক দেখে রাজা তাঁর রাজপ্রাসাদের সেরা ঘোড়সওয়ারদের ডেকে পাঠালেন। বুসিফেলাস যেন অপ্রতিরোধ্য। ম্যাসিডনের সেরা সেরা ঘোড়সওয়াররা নাস্তানাবুদ হয়ে গেল কিন্তু ঘোড়াকে বাগে আনা গেল না। মাঠ জুড়ে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বুসিফেলাস আর তা দেখতে রাজ প্রাসাদের সমস্ত কর্মচারী ভিড় করে দাঁড়িয়ে পড়েছে । রাজা ফিলিপ তো প্রচণ্ড বিরক্ত ঘোড়ার এই কান্ড দেখে। ঘোড়া বিক্রেতাকে ডেকে তিনি কড়া ভাষায় বললেন – তোমার এই ঘোড়া তুমি নিয়ে যাও। এমন বদমেজাজি ঘোড়ার আমার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ঘোড়াকে বাগ মানাতে পারলে তবেই না তাকে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে!

এই যখন অবস্থা হঠাৎ দোতলার বারান্দা থেকে কারও একজন কণ্ঠস্বর শোনা গেল – “এমন সুন্দর তেজী একটা ঘোড়াকে কেউ বাগে আনতে পারছে না কারণ এখানে উপস্থিত কারও সেই ক্ষমতা বা দক্ষতাই নেই এই ঘোড়াকে বাগ মানানোর।” কৌতূহলী সবার চোখ গিয়ে পড়ল দোতলার বারান্দায়। সেখানে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে চোদ্দ বছরের আলেকজান্ডার। বাবা ফিলিপ পাত্তা দিলেন না বালক আলেকজান্ডারের কথায়। এদিকে বুসিফেলাসের তাণ্ডবের বিরতির কোন লক্ষণ নেই। আলেকজান্ডার কিন্তু ওপর থেকে চিৎকার করে বলেই যাচ্ছেন একই কথা – “এমন ঘোড়াকে কেউ তাড়িয়ে দেয়! কাপুরুষ বলেই কেউ একে বশ করতে পারছে না।” রাজা ফিলিপ আলেকজান্ডারের এই সদম্ভ ঘোষণায় বিরক্ত হয়ে তাকে ডেকে পাঠালেন। “তুমি কি ভাব নিজেকে! তুমি বলতে চাও এখানে উপস্থিত সমস্ত অভিজ্ঞ ঘোড়সওয়ারদের থেকে তুমি বেশি দক্ষ ! “জিজ্ঞেস করলেন তিনি আলেকজান্ডারকে। “হ্যাঁ আমি এঁদের থেকে বেশি দক্ষ” – শান্ত গলায় আলেকজান্ডারের মুখ থেকে এই উত্তর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন রাজা ফিলিপ। “তুমি পারবে একে বশ করতে?” বাবার করা প্রশ্নের উত্তরে আলেকজান্ডার আবারও শান্ত স্বরে বললেন – “পারবো।” ফিলিপ জিজ্ঞেস করলেন – “যদি না পারো তবে কি শাস্তি নেবে বলো ?” আলেকজান্ডার বললেন – “ঘোড়াটির সম্পূর্ণ দাম আমি মিটিয়ে দেব।” চোদ্দ বছরের এক বালকের এত দম্ভ দেখে সভায় উপস্থিত সকলে হেসে উঠলেন। কৈশোরের অপরিণত তেজ ছাড়া এ আর কিছুই নয়।

আলেকজান্ডার, চোদ্দ বছর বয়সী এক সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া এক বালক যখন মাঠে নামলেন চারপাশে মাঠ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা তখন তামাশা দেখার নেশায় হাসিতে ফেটে পড়ছে। আলেকজান্ডার কিন্তু অবিচল। কোনদিকে না তাকিয়ে তিনি সোজা ঘোড়াটির কাছে গিয়ে তার লাগামটা ধরে ঘোড়াটিকে সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। দাঁড় করে দিতেই ঘোড়ার উন্মাদনা কমতে শুরু করলো। মাঠ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার হাসি থেমে গেছে এই দৃশ্য দেখে। আলেকজান্ডার যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘোড়াটিকে দেখছিলেন তখনই লক্ষ্য করছিলেন ঘোড়াটি তাঁর চোখের সামনে নিজের ছায়া দেখে বারবার ভয় পেয়ে যাচ্ছে আর ভয় থেকেই সে ক্রমাগত অস্থির হয়ে পড়ছে। সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়ানোর ফলে এবার আর তার নিজের ছায়া দেখতে পেলনা ঘোড়াটি। আলেকজান্ডার এবার মৃদু স্বরে ডাকতে লাগলেন – বুসিফেলাস… বুসিফেলাস! বলতে বলতেই ঘোড়াটির পেটের কাছে ঝুলতে থাকা পা দানীতে পা দিয়ে এক লাফে বুসিফেলাসের পিঠে চেপে বসলেন। মাঠের সমস্ত দর্শক প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। তারা সোচ্চারে এবার তালি দিয়ে আলেকজান্ডারের নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগলো। আলেকজান্ডার ঘোড়ার লাগামটা শক্ত করে ধরে আলতো একটা টান দিতেই ঘোড়াটি বাঁদিকে মোড় ঘুরে অল্প অল্প করে এগোতে লাগলো। আলেকজান্ডার ঘোড়ার পিঠে চেপেই হতবাক ফিলিপ এবং মা অলিম্পিয়ার সামনে এসে ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়াতেই রাজা ফিলিপ ছেলের অভাবনীয় সাফল্যে আনন্দে কেঁদে ফেললেন। কান্নাভেজা চোখেই তিনি আলেকজান্ডারের কপালে চুম্বন করে ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন – ” তোমার যোগ্য একটি সাম্রাজ্য এখন থেকে খুঁজতে শুরু কর কারণ এই ম্যাসিডন তোমার পক্ষে আর যথেষ্ট নয়।”

পরবর্তীকালে বুসিফেলাসের সাথে আলেকজান্ডারের এমনই এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে যে আলেকজান্ডার ছাড়া বুসিফেলাস তার পিঠে কাউকে বসতে দিত না। ৩২৬ খ্রি:পূ: হিদাস্পিসের যুদ্ধে বুসিফেলাসের মৃত্যু হয়। আলেকজান্ডার বুসিফেলাসের সম্মানে ‘আলেকজান্দ্রিয়া বুসিফেলাস’ নামে একটি শহরের পত্তন করেন।

তথ্যসূত্র


  1. Bucephalas and His Legend: Andrew Runni Anderson,The American Journal of Philology,Vol. 51, No. 1 (1930), pp. 1-21
  2. https://people.stfx.ca/
  3. https://en.wikipedia.org/
  4. https://www.thoughtco.com/

আপনার মতামত জানান