ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমার কাজ করে কীভাবে

ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমার কাজ করে কীভাবে

ট্রেনে করে যেতে যেতে কোনো স্টেশনে ঢোকার আগে অনেকেই দেখে থাকবেন অনেকটা জায়গা জুড়ে পাওয়ার গ্রিড রয়েছে – সেখানে বড়ো বড়ো টাওয়ার, ইলেক্ট্রিকের তার আর উচ্চ বিভব তড়িতের সতর্কবার্তা লাল কালিতে লেখা। কিন্তু কখনোই সেভাবে হয়তো বুঝতে পারেননি যে ঐ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আসলে কী হয়? আবার অনেকে দেখেছেন, রাস্তার কোথাও কোথাও ইলেকট্রিক পোলে লাগানো ধাতব বাক্স। অনেকে জানেন ওগুলি ইলেকট্রিক ট্রান্সফর্মার নাম কিন্তু ধারণা নেই ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমার কাজ করে কীভাবে! তাহলে আর দেরি কেন? চলুন জেনে নিই ট্রান্সফর্মার আসলে কী? আর ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমার কাজ করে কীভাবে?

ইংরেজি ‘ট্রান্সফরম’ (Transform) শব্দটির অর্থ হল রূপান্তর করা। আর যে যন্ত্র কোনো কিছুকে রূপান্তর করে তাকে বলা হয় ট্রান্সফরমার (Transformer)। আমরা এখানে যে ট্রান্সফরমারের কথা বলছি সেটিকে বলা হয় ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমার এবং এটি এমন এক বৈদ্যুতিক যন্ত্র যা সমগ্র ভোল্টেজ ও কারেন্টকে রূপান্তরিত করে আমাদের পক্ষে ব্যবহার-উপযোগী করে তোলে। ট্রান্সফর্মার ইনপুট হিসেবে তড়িৎশক্তি নেয় এবং সেই তড়িৎশক্তিই আউটপুট হিসেবে ফিরিয়ে দিলেও এই ইনপুট ও আউটপুটের মধ্যে কোনো তারের সংযোগ থাকে না। পাওয়ার স্টেশন থেকে আমাদের বাড়িতে প্রয়োজনীয় ভোল্টেজ পেতে এক বো একাধিক ট্রান্সফরমারের সাহায্য প্রয়োজন। আবার নিশ্চয় খেয়াল করে থাকবেন যে বাড়িতে এসি লাইন বা পরিবর্তী তড়িৎপ্রবাহ দিয়ে সরাসরি সার্কিট কিংবা টিভি, ডিভিডি ইত্যাদি বৈদ্যুতিন যন্ত্রগুলিকে কখনোই আমরা চালাতে পারি না। সেক্ষেত্রে প্রথমে আমাদের মেইন লাইনের ভোল্টেজকে কমিয়ে ব্যবহার্য সার্কিট বা যন্ত্রের জন্য উপযুক্ত করে নিতে হয় আর এই কাজটি করে থাকে ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমার। অর্থাৎ, এই ট্রান্সফরমার তড়িতের সাপেক্ষে এসি (AC) সাপ্লাই-এর ভোল্টেজ বাড়ায় বা কমায় এবং পরিবর্তী তড়িৎপ্রবাহের এক ভোল্টেজকে আরেক ভোল্টেজে রূপান্তরিত করে।

এখন এই ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমার দুরকমের হয়ে থাকে – স্টেপ-আপ ট্রান্সফরমার এবং স্টেপ-ডাউন ট্রান্সফরমার। বিষয়টা সংক্ষেপ বুঝে নেওয়া যাক। কম ভোল্টেজ থেকে বেশি ভোল্টেজে তড়িৎকে রূপান্তরিত করে স্টেপ-আপ ট্রান্সফরমার এবং এর বিপরীত পন্থায় কাজ করে অর্থাৎ বেশি ভোল্টেজ থেকে কম ভোল্টেজে রূপান্তরিত করে স্টেপ-ডাউন ট্রান্সফরমার। স্টেপ-আপ ট্রান্সফরমার সাধারণত ইউপিএস, আইপিএস, ইনভার্টার প্রভৃতি যন্ত্রপাতিতে ব্যবহৃত হয় এবং স্টেপ-ডাউন ট্রান্সফরমার ঘরের সাধারণ বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ট্রান্সফরমার গুলি সাধারণত কীরকম দেখতে হয় তার বাহ্যিক (চিত্র ১) ও আভ্যন্তরীণ গঠন (চিত্র ২) দেখা যাচ্ছে নীচের ছবিগুলিতে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

মূলত এই ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমার ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডের তড়িৎ আবেশের সূত্র অনুযায়ী কাজ করে। কিন্তু তাই বলে ট্রান্সফরমার তৈরির ইতিহাসের একক কৃতিত্বের দাবিদার নন ফ্যারাডে। তাঁর নীতিকে কাজে লাগিয়ে ১৮৩৬ সালে রেভারেণ্ড নিকোলাস কালান প্রথম একটি ইণ্ডাকশন কয়েল ট্রান্সফরমার তৈরি করেন যা অতি উচ্চ ভোল্টেজ তৈরিতে সহায়তা করত। ১৮৭৬ সালে রাশিয়ান প্রকৌশলী পাভেল ইয়াবলোশকভ এই তড়িৎ-চুম্বকীয় আবেশ নীতির সাহায্যে একটি আলোকব্যবস্থা তৈরি করেন যার মূল উৎস ছিল পরিবর্তী তড়িৎপ্রবাহ। কিন্তু সর্বসম্মতিক্রমে ১৮৮৫ সালে ওয়েস্টিংহাউজের উৎসাহে ও সুপারিশে উইলিয়াম স্ট্যানলি আবিষ্কৃত ট্রান্সফরমারের মডেলটিকেই প্রথম ট্রান্সফরমার বলে ধরা হয়। তবে মনে রাখতে হবে, তাঁর আগেও কিন্তু হাঙ্গেরির তিন প্রকৌশলী ক্যারোলি জিপারনওস্কি, ওত্তো ব্ল্যাথি এবং মিস্কা ডেরি নভেল ট্রান্সফরমার তৈরি করে পেটেন্ট নিয়েছিলেন এবং তাঁদের আবিষ্কৃত ট্রান্সফরমারগুলি তখন ‘জেডবিডি ট্রান্সফর্মার’ নামে অভিহিত হতো। এভাবে ইতিহাসে নানা সময় বহু বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীরা ট্রান্সফরমার তৈরির চেষ্টা করে এসেছেন।

এখন যে কোনো প্রকার ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমারের মধ্যে মূলত তিনটে জিনিস থাকে – ১) প্রাইমারি কয়েল, ২) সেকেণ্ডারি কয়েল এবং ৩) ম্যাগনেটিক কোর যা কিনা ফেরো-ম্যাগনেটিক আয়রন দিয়ে তৈরি। এই যন্ত্র মিউচুয়াল ইন্ডাকশনের মাধ্যমে কাজ করে অর্থাৎ প্রাইমারি থেকে সেকেন্ডারিতে পাওয়ার ট্রান্সফার করে থাকে। ব্যাপারটা হল এইরকম যে, প্রাইমারি কয়েলে বিদ্যুৎ বা কারেন্ট প্রবাহিত হলে তার চারপাশে এক তড়িৎ-চুম্বকীয় আবেশ বা ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয় যেখান থেকে সেকেণ্ডারি কয়েল ফ্লাক্স সংগ্রহ করে। কী এই ফ্লাক্স? ধনাত্মক আধান থেকে বাইরের দিকে প্রবাহিত বৈদ্যুতিক বলরেখাকে তড়িৎ বিজ্ঞানের ভাষায় ফ্লাক্স বলা হয়। এই ঘটনার ফলে প্রাইমারি কয়েল আর সেকেণ্ডারি কয়েলের মধ্যে একটা মিউচুয়াল ইন্ডাকশন তৈরি হয়। এই মিউচুয়াল ইন্ডাকশনের ফলেই সেকেন্ডারি কয়েলে তড়িৎ প্রবাহিত হয় যার মান নির্ভর করে সেকেন্ডারি ও প্রাইমারি কয়েলে ব্যবহার করা প্যাঁচের সংখ্যার উপর। কয়েলে প্যাঁচের সংখ্যাকে বলে ট্রান্সফরমেশন অনুপাত। তড়িৎপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাইমারি কয়েল থেকে সেকেণ্ডারি কয়েলে ভোল্টেজ চলে আসে আর এই দুই কয়েলের মধ্যে ভোল্টেজের পরিবর্তন ঘটে। এই যে ভোল্টেজের পরিবর্তন তা ওই কয়েলের প্যাঁচের সংখ্যার উপরে নির্ভরশীল। দেখা গেছে যে স্টেপ-আপ ট্রান্সফর্মারে সেকেণ্ডারি অপেক্ষা প্রাইমারি কয়েলের প্যাঁচের সংখ্যা বেশি থাকে, কিন্তু অন্যদিকে স্টেপ-ডাউন ট্রান্সফর্মারে ঠিক এর উল্টোটা দেখা যায়। অর্থাৎ তাতে সেকেণ্ডারি কয়েলের প্যাঁচ অনেক বেশি থাকে। কীভাবে এই তড়িৎ-চুম্বকীয় আবেশ তৈরি হয় তা একটা চিত্রের মাধ্যমে দেখে নেওয়া যাক – (চিত্র – ৩)

(চিত্র – ৩)

ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমারের প্রাইমারি ভোল্টেজ, তড়িৎ এবং কয়েলের প্যাঁচের সংখ্যার সঙ্গে সেকেন্ডারি ভোল্টেজ, তড়িৎ এবং কয়েলের প্যাঁচের সংখ্যার যে সম্পর্ক তা প্রকাশ করে নিম্নলিখিত সূত্রটি –

Vp/Vs = Np/Ns ………(1)
যেখানে, Vp = প্রাইমারী ভোল্টেজ,
Vs = সেকেন্ডারী ভোল্টেজ,
Np = প্রাইমারী কয়েলের প্যাঁচের সংখ্যা
Ns = সেকেন্ডারী কয়েলের প্যাঁচের সংখ্যা

শক্তির নিত্যতা সূত্রানুসারে, আমরা পাই Vp.Ip = Vs.Is
অর্থাৎ, Vp/Vs = Is/Ip …………(2)
যেখানে, Ip = প্রাইমারী কয়েলে প্রবাহিত তড়িৎ,
Is = সেকেন্ডারী কয়েলে প্রবাহিত তড়িৎ।

তাহলে (1) আর (2) সমীকরণ থেকে পাই,
Vp/Vs = Np/Ns = Is/Ip …….(3)

এই Np/Ns অনুপাতকে ট্রান্সফর্মারের টার্ন্‌স-রেশিও (Turns Ratio) বলে।

এই অনুপাতের উপরই আসলে নির্ভর করে কোনো ট্রান্সফর্মার স্টেপ-আপ হবে নাকি স্টেপ-ডাউন হবে। এই অনুপাত নিয়ন্ত্রণ করেই ট্রান্সফর্মারের প্রয়োগও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, এই ট্রান্সফর্মারগুলি ঠিক কোথায় কোথায় থাকে? বা পাওয়ার স্টেশন থেকে কি সরাসরি এই ট্রান্সফর্মারের মাধ্যমে আমাদের বাড়িতে তড়িৎ প্রবাহিত হয়? ব্যাপারটা খুবই সহজ। মূলত তড়িৎ উৎপাদিত হয় পাওয়ার স্টেশনে তারপর তা একটি পাওয়ার ট্রান্সফর্মারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে প্রধান বিদ্যুৎ সঞ্চালন নেটওয়ার্কের মধ্যে এবং সেখান থেকে দুটি সাবস্টেশনে পৌঁছায় তড়িৎ-প্রবাহ। প্রথমত ট্রান্সমিশন সাবস্টেশন এবং তারপরে ডিস্ট্রিবিউশন সাবস্টেশন। এই প্রত্যেক সাবস্টেশনের মধ্যে একাধিক ট্রান্সফর্মার থাকে। ডিস্ট্রিবিউশন ট্রান্সফর্মার ঠিক করে কোথায় তড়িৎপ্রবাহিত করতে হবে এবং তা কত ভোল্টেজের হবে। এখান থেকেই পৃথক পৃথক ভোল্টেজের তড়িৎ কখনো কারখানায় বা কখনো বাড়িতে পরিবাহিত হয়। ডিস্ট্রিবিউশন সাবস্টেশন আর বাড়ি বা কারখানার মধ্যেও অনেকগুলি ট্রান্সফর্মার থাকতে পারে। দূরবর্তী স্থানে তড়িৎ সঞ্চালনের জন্য এই কারণে হাই ভোল্টেজ ট্রান্সফর্মার ব্যবহার করা হয়।

আপনার মতামত জানান