২০১৯ সালের শেষ লগ্নে শুরু হয়ে ২০২০ সালে নোভেল করোনা ভাইরাস সারা বিশ্বে এক ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। সকলের মুখে মুখে শুধু করোনা ‘সংক্রমণ’ এর কথা। পাশাপাশি উঠে আসছে এরকম ভয়াবহ মহামারী বা অতিমারী এর আগে কবে হয়েছিল। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু সংক্রমণের কথা উঠে আসছে তুলনা হিসেবে। পাশাপাশি, প্লেগের সংক্রমণ, কলেরা সংক্রমণ ইত্যাদি নানা সংক্রমণের কথাও উঠে আসছে। রোগগুলোর নাম, সময়, প্রকৃতি সব আলাদা আলাদা কিন্তু একটা শব্দ সবক্ষেত্রেই এক, তা হল সংক্রমণ। তবে শুধু বড় বড় রোগ নয়, সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশিও সংক্রমণ এর ফল। এখানে সংক্রমণ কি, কিভাবে হয় ইত্যাদি ব্যাখ্যা করব।
আমরা প্রথমেই জেনে নেব – সংক্রমণ কাকে বলে। সহজ ভাষায় বললে – যখন কোন জীবদেহে বা জীব কোষে কোন জীবানু প্রবেশ ক’রে সেই জীবদেহে বা কোষের ক্ষতি করে তখন তাকে সংক্রমণ (Infection) বলে। এই জীবাণুগুলি জীবদেহটিকে আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ও বিষক্রিয়া ঘটায় যার ফলে জীবদেহে রোগ সৃষ্টি হয়। যেকোনো সজীব কোষের মধ্যেই সংক্রমণ হতে পারে – উদ্ভিদ, প্রাণী কেউই সংক্রমণের ঊর্ধ্বে নয়। রোগ সৃষ্টিকারী জীবানুদের প্যাথোজেন (pathogen) বলে। প্যাথোজেন নানা ধরণের হতে পারে যেমন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, প্যারাসাইট এমনকি ভিরয়েডস (Virioids)অর্থাৎ ক্ষুদ্রতম ক্ষতিকারক কণা এবং প্রায়ন (Prion) অর্থাৎ ক্ষতিকারক প্রোটিন কণাও হতে পারে।
আমাদের স্বাভাবিক অনাক্রম্যতা বা ইমিউনিটি (Immunity) পরিবেশের এই জীবানুদের আক্রমনকে প্রতিহত করে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে চলেছে। আমাদের ইমিউনিটি কিভাবে সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং টিকা (vaccine) কিভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় জানার জন্য এখানে ক্লিক করে দেখুন।
প্রতি বছর প্রায় দেড় কোটি মানুষ যে কোনো রকমের সংক্রমণের শিকার হন। সংক্রমণ সাধারণত দুই রকমের হয় – লক্ষণযুক্ত এবং লক্ষণবিহীন । লক্ষণযুক্ত সংক্রমণের ক্ষেত্রে শরীরে সংক্রমণ ঘটলেই তার উপসর্গ প্রকাশ পায় ধাপে ধাপে। প্রথমে আপাতভাবে অর্থাৎ অ্যাপারেন্ট (Apparent) সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ক্লিনিক্যাল (Clinical)অর্থাৎ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কোন জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলে সমগ্র শরীরে বিস্তার লাভ করতে তার যে সময় লাগে এর মধ্যেই প্রকাশ পায় লক্ষণ। লক্ষণবিহীন সংক্রমণের ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক জীবাণু শরীরে বাসা বাঁধলেও প্রকাশ পায় না কোনো উপসর্গ। ফলে সম্ভব হয় না সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করাও। তখন কঠিন হয়ে পড়ে চিকিৎসা। এ ধরনের উপসর্গ গুলিকে বলে ল্যাটেন্ট (Latent) বা ইনআ্যাপারেন্ট(Inapparent)।
এছাড়াও সংক্রমণ কি ধরণের জীবাণু আক্রমণের ফলে ঘটেছে সেই ভিত্তি করেও বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন –
ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণ (viral infection): করোনা ভাইরাস, নিপা ভাইরাস, জিকা ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সাধারণ সর্দি-কাশি, এইডস ইত্যাদি।
ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণ (bacterial infection): কলেরা, ডিপথেরিয়া, টিউবারকুলেসিস, টাইফয়েড ইত্যাদি।
ছত্রাক ঘটিত সংক্রমণ (Fungal Infection): দাদ (ringworm), হিস্টোপ্লাসমোসিস (Histoplasmosis), ফাঙ্গাল ম্যানিনজাইটিস, কিছু চর্মরোগ ইত্যাদি।
এই সমস্ত রোগসংক্রমণ বিভিন্নভাবে হতে পারে। কিছু কিছু রোগ খুব সহজেই এক শরীর থেকে অন্য শরীরে সংক্রামিত হয়। রোগ সংক্রমণের কিছু সাধারণ পদ্ধতি হলঃ
১। শারীরিক স্পর্শ
২। রক্ত, লালারস ইত্যাদির মাধ্যমে
৩। যৌনসংযোগ
৪। রোগীর বর্জ্যপদার্থের সঙ্গে সংস্পর্শ
৫। সংক্রামিত খাদ্য বা পানীয় থেকে
৬। সংক্রামিত ড্রপলেট শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে
৭। মশা বা পোকার কামড়ে
৮। বিভিন্ন প্রাণীর থেকে – কামড় বা তাদের মাংস খেয়ে
সংক্রামক রোগ কি কি ভাবে ছড়াতে পারে জানা থাকলে সেই ভাবে সতর্কতা অবলম্বন জরুরী। যেমন মশাবাহিত রোগের ক্ষেত্রে মশার কামড় থেকে সুরক্ষা এবং মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করা দরকার। একইভাবে করোনা রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যাতে শ্বাসযন্ত্রে কোনভাবেই ভাইরাস না যেতে পারে তাই নাক, মুখ, চোখ ঢেকে রাখা দরকার এবং সবসময় হাতকে জীবনু মুক্ত রাখা দরকার।
বেশ কিছু সংক্রামক রোগ আছে যেগুলি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং মাহামারী বা অতিমারীতে পর্যন্ত পরিণত হতে পারে। কিছু সংক্রামক রোগ আবার দুরারোগ্য অর্থাৎ সেইসব রোগের ওষুধ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তাই সেই সব রোগ থেকে বাঁচার এক এবং একমাত্র উপায় সংক্রমণ ছড়াতে না দেওয়া – তার জন্য বিশেষ সতর্কতা সবসময় প্রয়োজনীয়।
One comment