জেসি ওয়েন্স

জেসি ওয়েন্স

জেসি ওয়েন্স (Jesse Owens) একজন বিশ্বখ্যাত আমেরিকান ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড অ্যাথলিট যিনি ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে চারটি স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। বার্লিন অলিম্পিকে লং জাম্পের যে রেকর্ড তিনি গড়েছিলেন পরবর্তী দীর্ঘ পঁচিশ বছর তা অক্ষত ছিল। কোন একটি বছরে আমেরিকার ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড বিভাগে শ্রেষ্ঠ কীর্তি স্থাপনকারীকে দেওয়া হয় জেসি ওয়েন্স পুরস্কার। ‘বুকি বুলেট’ (Buckeye Bullet) নামে খ্যাত জেসি ওয়েন্স ১৯৯৯ সালে বিবিসি চ্যানেলের বিচারে শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের তালিকায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেছেন।তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে অলিম্পিকের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অ্যাথলিট হিসেবে গণ্য করা হত।

১৯১৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আলাবামার ওকভিলে জেসি ওয়েন্সের জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম জেমস ক্লিভল্যাণ্ড ওয়েন্স। তাঁর বাবা হেনরি ক্লিভল্যাণ্ড ওয়েন্স এবং মা মেরি এমা ফিৎজেরাল্ডের সাতটি পুত্র ও তিনটি কন্যার মধ্যে দশম সন্তান ছিলেন জেসি ওয়েন্স। ওয়েন্সের নয় বছর বয়সে তাঁর পরিবার ওহিওর ক্লিভল্যাণ্ডে বাসস্থান বদল করে চলে আসেন। তাঁর নাম নিয়ে বেশ মজার একটি কাহিনি আছে। আসলে তাঁর নাম ছিল জেমস ক্লিভল্যাণ্ড অর্থাৎ সংক্ষেপে জে.সি। স্কুলে এক শিক্ষিকা তাঁকে নাম জিজ্ঞেস করায় সে যখন বলে জে.সি, শিক্ষিকা সেটি ভুল শুনে লেখেন জেসি। সেই থেকেই আজীবন জেমস ক্লিভল্যাণ্ড ওয়েন্স  থেকে তিনি পরিচিত হন জেসি ওয়েন্স নামে।

ক্লিভল্যান্ডের ফেয়ারমাউন্ট জুনিয়র হাই স্কুলে জেসি ওয়েন্সের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। তারপর তিনি ভর্তি হন ইস্ট টেকনিক্যাল হাই স্কুলে। স্কুলে পড়াকালীনই জেসি ওয়েন্স বুঝতে পারেন যে দৌড়ের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ রয়েছে। ফেয়ারমাউন্ট জুনিয়র হাই স্কুলে ট্র্যাক প্রশিক্ষক চার্লস রিলের সান্নিধ্যে এসে তিনি অ্যাথলেটিক্সে মনোনিবেশ করেন। তবে শুধুই পড়াশোনা নয়, তার পাশাপাশি কখনো স্টিলের কারখানায়, কখনো জুতো সারাইয়ের দোকানে, কখনো আবার মুদির দোকানের মালপত্র বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কাজও করতে হয়েছে তাঁকে। চার্লস রিলে স্কুলের পরে আলাদা করে তাঁকে প্রশিক্ষণ দিতেন। ইস্ট টেকনিক্যাল হাই স্কুলে পড়ার সময় প্রথম জেসি ওয়েন্স শিকাগোর ন্যাশনাল হাই স্কুলে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় একশো গজ দৌড় মাত্র ৯.৪ সেকেন্ডে শেষ করে এবং লং জাম্পের ক্ষেত্রে ৭.৫৬ মিটার দৈর্ঘ্যের লাফ দিয়ে রেকর্ড করেন। এর ফলে ক্রমেই জাতীয় স্তরে অ্যাথলিট হিসেবে তিনি পরিচিত হতে থাকেন। স্নাতক উত্তীর্ণ হয়ে জেসি ওয়েন্স ভর্তি হন ওহিও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ল্যারি সিণ্ডারের প্রশিক্ষণে আরো দক্ষ অ্যাথলিট হয়ে ওঠেন তিনি। এই সময়েই ১৯৩৫ আর ১৯৩৬ সালে পরপর বিশ্বসেরা রেকর্ডগুলি গড়ে তোলেন ওয়েন্স।

ক্রীড়ায় যুক্ত থাকার জন্য বা সেরা অ্যাথলিট হওয়ার জন্য কোনোরূপ স্কলারশিপ না পাওয়ায় জেসি ওয়েন্সকে নানা সময় আংশিক সময়ের চাকরিতে যুক্ত থাকতে হয়েছে। ১৯৩৫ সালের ২৫ মে জেসি ওয়েন্স অ্যাথলেটিক্সে চারটি বিশ্ব-রেকর্ড করেন। আমেরিকার মিশিগানের অ্যান আরবারে ফেরি ফিল্ড স্টেডিয়ামে আয়োজিত ‘বিগ টেন’ অর্থাৎ দশটি বড়ো বড়ো দেশের মধ্যে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় যথাক্রমে ১০০ গজের দৌড়, ২২০ গজের স্প্রিন্ট, ২২০ গজের লো-হার্ডলস, লং জাম্প ইত্যাদিতে পরপর চারটি বিশ্ব-রেকর্ড করেন জেসি ওয়েন্স। ১০০ গজের দৌড়ে ৯.৪ সেকেন্ড, লং জাম্পে ৮.২৩ মিটার দৈর্ঘ্য, ২২০ গজের লো-হার্ডলস মাত্র ২২.৬ সেকেণ্ডে শেষ করায় সমগ্র বিশ্বে জেসি ওয়েন্স এক খ্যাতিমান অ্যাথলিট হিসেবে স্বীকৃতি পান।

এত কিছুর পরেও এক কৃষ্ণকায় মানুষ হওয়ার জন্য অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন যে প্রতিযোগিতাগুলিতে তিনি অংশ নিয়েছিলেন, সেখানে কালো মানুষদের জন্য পৃথক হোটেল, পৃথক রেস্তোরাঁতে তাঁকে থাকতে ও খেতে হয়েছিল। এমনকি ১৯৩৬ সালে জার্মানির বার্লিনে যখন গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজিত হয়, সেসময় নাৎসি অধিকৃত জার্মানিতে এক কৃষ্ণকায় আফ্রো-আমেরিকান অ্যাথলিট হওয়ার কারণে অলিম্পিকে যোগদানের আবেদন বানচাল করার পরিকল্পনা করেছিলেন এনএএসিপি (NAACP) সেক্রেটারি ওয়াল্টার ফ্রান্সিস হোয়াইট। জেসি ওয়েন্সের অলিম্পিকে যোগদানের বিরোধিতা করে জার্মানরা যখন বয়কট করে, সেসময় ওয়েন্স আমেরিকার অলিম্পিক কমিটির সভাপতিকে বলেছিলেন যে জার্মানিতে কৃষ্ণকায় সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে এমন বাধা থাকলে আমেরিকার উচিত অলিম্পিক প্রতিযোগিতা থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেওয়া। অবশেষে অলিম্পিক কমিটি ওয়েন্স এবং তাঁর সহযোগীদের ‘আন-আমেরিকান এজিটেটরস’ হিসেবে ঘোষণা করলে তাঁদের অলিম্পিকে যোগদান করতে দেওয়া হয়।

১৯৩৬ সালের অলিম্পিকেই প্রথম বিখ্যাত জুতো-নির্মাণ সংস্থা অ্যাডিডাসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডলফ ড্যাসলার ওরফে অ্যাডি ড্যাসলার অ্যাথলিট জেসি ওয়েন্সকে তাঁদের কোম্পানির নির্মিত বিশেষ এক প্রকারের জুতো পরে দৌড়তে বলেন। ঐ বিশেষ জুতোটির নাম গেব্রুডার ড্যাসলার শ্যুফেব্রিক শ্যু (Gebrüder Dassler Schuhfabrik shoes)। সেটাই ছিল ক্রীড়াজগতে প্রথম স্পনসরশিপের সূচনা। সমগ্র প্রতিযোগিতায় আমেরিকা মোট এগারোটি পদক জেতে যার মধ্যে ছয়টি ছিল শুধুমাত্র কৃষ্ণকায় অ্যাথলিটদের অর্জিত। জেসি ওয়েন্স এই অলিম্পিকে মোট চারটি স্বর্ণপদক অর্জন করেন যথাক্রমে ১০০ মিটার দৌড়, লং জাম্প, ২০০ মিটার ও ৪০০ মিটার রিলে প্রতিযোগিতায়। ৩ আগস্ট ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় ১০.৩ সেকেণ্ডে দৌড় শেষ করে বিজয়ী হন তিনি। এর পরের দিন ৪ আগস্ট ছিল লং জাম্পের প্রতিযোগিতা যেখানে ৮.০৬ মিটার দীর্ঘ লং জাম্প করে দ্বিতীয় স্বর্ণপদকটি অর্জন করেন ওয়েন্স। তৃতীয় স্বর্ণপদকটি ওয়েন্স লাভ করেন ৫ আগস্টে ২০০ মিটার স্প্রিন্ট প্রতিযোগিতা ২০.৭ সেকেণ্ডে শেষ করে। এই তিনদিনে জেসি ওয়েন্স র‍্যালফ মেটক্যাফে, লুজ লং, ম্যাক রবিনসন প্রমুখ প্রতিদ্বন্দ্বিকে পরাজিত করেছিলেন। এর পর ৯ আগস্ট তারিখে ৪০০ মিটার স্প্রিন্ট রিলেতে চতুর্থ স্বর্ণপদকটি অধিকার করেন ওয়েন্স। এই দিনে রিলেতে আমেরিকার পক্ষে তাঁর সঙ্গে দৌড়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক ওয়েক্রফ এবং ফয় ড্রেপার। লং জাম্পের ক্ষেত্রে ১৯৩৫ সালে ওয়েন্স যে ৮.১৩ মিটারের রেকর্ড করেছিলেন ১৯৩৬ সালের অলিম্পিকে তা নিজে যদিও ভাঙতে পারেননি এবং বিশ্বের ইতিহাসে দীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত এই রেকর্ড আর কোনো অ্যাথলিটের পক্ষেই ভাঙা সম্ভব হয়নি। ২৫ বছর পরে অ্যাথলিট আরভিন রবার্সন ১৯৬০ সালে অলিম্পিকে এই রেকর্ড ভেঙে দেন। জানা যায়, অ্যাডলফ হিটলার এই বিজয়ের পর অলিম্পিকের শেষে কেবলমাত্র জার্মান অ্যাথলিটদের সঙ্গে করমর্দন করেই ক্রীড়াঙ্গন ত্যাগ করেন। এতে ক্ষুব্ধ অলিম্পিক ক্রীড়া কমিটি তাঁকে জানায় যে হয় তিনি সকল পদকজয়ীদের সঙ্গে করমর্দন করবেন, নচেৎ কারো সঙ্গেই করমর্দন করতে পারবেন না। এই সিদ্ধান্তে হিটলার প্রচণ্ড আত্মম্ভরিতায় ক্রীড়াঙ্গনেই প্রবেশ করেননি। ১৯৩৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অলিম্পিয়া’ নামের এক তথ্যচিত্রে এই ঘটনাটির প্রামাণ্য চিত্র রয়েছে এবং তার সঙ্গে জেসি ওয়েন্সের এই বিশ্বজয়ী লং জাম্পের রেকর্ডের প্রামাণ্য চিত্রও রয়েছে।

আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষের শিকার হলেও জার্মানিতে শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে একই হোটেলে থাকতে পারতেন ওয়েন্স। দেশে ফিরলে তাঁকে নিয়ে নিউ ইয়র্কে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা হয়। স্বয়ং নিউ ইয়র্কের মেয়র ফিওরেল্লো লাগার্ডিয়া তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কৃষ্ণাঙ্গ জেসি ওয়েন্সকে তৎকালীন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট রাষ্ট্রপতি ভবনে আমন্ত্রণ জানাননি। অন্যদিকে ওয়েন্স যেহেতু কট্টর রিপাবলিকান ছিলেন তাই রুজভেল্টের পক্ষ থেকে কোনো সম্মান বা দাক্ষিণ্য প্রত্যাশাও করেননি ওয়েন্স। ১৯৩৬ সালে ইউরোপ থেকে ফিরে তিনি রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেন এবং ঐ বছরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রুজভেল্টের প্রতিদ্বন্দ্বী আফ্রো-আমেরিকান রিপাবলিকান আলফ ল্যাণ্ডনকে জেতানোর জন্য ভোট সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য রাখেন।

১৯৮৪ সালে প্রথম তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে একটি জীবনী-চিত্র নির্মিত হয় ‘জেসি ওয়েন্স’স স্টোরি’ নামে। তারপর ২০১৬ সালে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র মুক্তি পায় ‘রেস’ নামে যেখানে জেসি ওয়েন্সের চরিত্রে অভিনয় করেন স্টিফেন জেমস। ১৯৭১ সালে সংযুক্ত আরব আমীরশাহী কিংবদন্তি অলিম্পিকজয়ী জেসি ওয়েন্সের স্মরণে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে। পরবর্তীকালে তাঁর স্মরণেই কোন একটি বছরে আমেরিকার ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড বিভাগে শ্রেষ্ঠ কীর্তি স্থাপনকারীকে দেওয়া হয় জেসি ওয়েন্স পুরস্কার ।

অলিম্পিকের স্বর্ণপদক ছাড়াও জেসি ওয়েন্স নানা সময় বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৭৬ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জেরাল্ড ফোর্ডের কাছে তিনি ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম’ লাভ করেন। ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার তাঁকে ‘লিভিং লেজেণ্ড’ সম্মানে ভূষিত করেন। ১৯৯৯ সালে বিবিসি চ্যানেলের বিচারে শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের তালিকায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেন জেসি ওয়েন্স।

১৯৮০ সালের ৩১ মার্চ অ্যারিজোনায় ৬৬ বছর বয়সে জেসি ওয়েন্সের মৃত্যু হয়।

3 comments

আপনার মতামত জানান