জ্যোতির্লিঙ্গ বিশ্বনাথ

জ্যোতির্লিঙ্গ বিশ্বনাথ

বিশ্বনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরটি উত্তরপ্রদেশের বারাণসী শহরে গঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে মণিকর্ণিকা ঘাটে অবস্থিত। প্রাচীনকালে বারাণসী কাশী নামে পরিচিত ছিল বলে এই মন্দির কাশী বিশ্বনাথ মন্দির নামেও পরিচিত। বিশ্বনাথ মন্দিরকে শিবের সবচেয়ে পবিত্র আবাস বলে মনে করা হয়ে থাকে। ভক্তেরা বিশ্বাস করে যে, বিশ্বনাথের মন্দিরে পূজা দিলে এবং এখানকার গঙ্গায় স্নান করলে মোক্ষের পথ সহজেই পাওয়া যায়। রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, আদি শঙ্করাচার্য বা গুরুনানকের মতো মহান মানুষেরা এই বিশ্বনাথ মন্দির দর্শন করে গেছেন। বিশ্বনাথ মন্দিরের বুকে নানারকম কিংবদন্তি এবং দীর্ঘদিনের ইতিহাস বিরাজ করছে।

শিবপুরাণ অনুযায়ী একদা ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে দুজনের তুমুল বিবাদ উপস্থিত হয়। সেই বিবাদ সন্তোষজনক পরিণতিতে না পৌঁছে চলতেই থাকলে মহাদেব তখন একটি আলোকরশ্মির স্তম্ভ রূপে তাঁদের দুজনের মাঝখানে প্রকট হন। ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু কেউই সেই আলোকস্তম্ভের আদি ও অন্ত খুঁজে পাননি। শেষমেশ তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই দিব্য জ্যোতিই শ্রেষ্ঠতম। এভাবেই জ্যোতির্লিঙ্গের ধারণাটির উদ্ভব হয়।

বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে অন্যতম হল বিশ্বনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ। এই জ্যোতির্লিঙ্গকে ঘিরে নানারকম কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। ভক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী সৃষ্টির শুরুতে যখন চারিদিক অন্ধকার ছিল তখনও কাশী ছিল এবং সৃষ্টি ধ্বংসের পরেও কাশী থাকবে। সৃষ্টির শুরুতে যখন পরম তেজঃস্বরূপ পরমাত্মা ছাড়া কিছু ছিল না তখন সেই পরমাত্মা থেকে জন্ম নিয়েছিল পুরুষ ও প্রকৃতি। শিবপুরাণ অনুযায়ী এই পরমাত্মা হলেন চিরন্তন নিরাকার শিব। পুরুষ ও প্রকৃতি কী করবেন যখন ভেবে পাচ্ছিলেন না, পরমাত্মা তাঁদেরকে তপস্যা করতে বলেছিলেন। কিন্তু তপস্যার জন্যে প্রয়োজন উপযুক্ত স্থান। তখন পরমাত্মা অর্থাৎ শিব পাঁচ ক্রোশ বিস্তৃত পঞ্চকোশীর নির্মাণ করেছিলেন। পুরুষ ও প্রকৃতির তপস্যার শ্রমে তাঁদের শরীর থেকে ঘাম নিঃসৃত হয়ে চারপাশে জলমগ্ন হয়ে গেল। জগৎ জলের তলায় তলিয়ে গেলে পঞ্চকোশীকে জলমগ্ন হওয়ার থেকে বাঁচানোর জন্য শিব তাকে ত্রিশূলের ওপর স্থাপন করেন। সৃষ্টি জলমগ্ন দেখে বিষ্ণু বিস্মিত হলেন, তাঁর মাথা কাঁপতে লাগল, ফলে বিষ্ণুর কান থেকে একটি মণি খসে পড়ে এবং মণিকর্ণিকার সৃষ্টি হয়। বিষ্ণুও তাঁর স্ত্রীয়ের সঙ্গে পঞ্চকোশীতে অবস্থান করেছিলেন। বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে ব্রহ্মার জন্ম হয়। শিব ব্রহ্মাকে সৃষ্টির কাজ করতে বললেন। ব্রহ্মা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করলেন, সেইসঙ্গে জীবেরও সৃষ্টি হল। শিব ভাবলেন কর্মপাশে আবদ্ধ জীব কীভাবে তাঁকে পাবে! এই চিন্তা থেকেই পঞ্চকোশীতে নিজেকে লিঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। নিজের ত্রিশূল দিয়ে তুলে কাশীকে শিব পৃথিবীতে রেখেছিলেন। শিবপুরাণ অনুযায়ী, যখন ব্রহ্মার একটি দিন চলে যায় এবং প্রলয়ে ধ্বংস হয় পৃথিবী তখন কাশীকে ভগবান শিব ত্রিশূলে ধারণ করে সুরক্ষিত রাখেন। সৃষ্টি পুনরায় শুরু হলে শিব কাশীকে আবার পৃথিবীতে স্থাপন করেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

অন্য কিংবদন্তী অনুযায়ী ব্রহ্মার একটি মুখ শিবকে কটু কথা বলেছিল বলে রুষ্ট হয়ে শিব সেই মুখটিকে ভস্ম করেছিলেন। শিবের তখন ব্রহ্মাহত্যার পাপ লাগে এবং ব্রহ্মার সেই স্খলিত মুখ বোঝার মত শিবের পিঠে আটকে যায়। অবশেষে এই কাশীতে এসেই সেই ভার নেমে যায়। তাই শিব নিজেও কাশীর মাহাত্ম্য বুঝতে পেরেছিলেন এবং এখানে নিজের আবাস গড়েছিলেন। অবশ্য কাশীতে শিবের বাসস্থান নিয়ে আরেকটি কিংবদন্তীও প্রচলিত রয়েছে। শিবের শাশুড়ী অর্থাৎ দেবী পার্বতীর মা খুবই চিন্তিত ছিলেন কারণ তাঁর জামাইয়ের কোনো বাসস্থান ছিল না। শিব তখন নিকুম্ভ রাক্ষসকে কাশীকে তাঁদের বসবাসের উপযুক্ত করে তুলতে এবং সেখানে একটি বাসস্থান নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। কাশীর বাসস্থান দেখে পার্বতী এতই খুশি হয়েছিলেন যে, তিনি অন্নপূর্ণা রূপে সকলকে অন্ন প্রদান করেছিলেন। ঋগ্বেদ, অথর্ববেদ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে কাশীর উল্লেখ পাওয়া যায়।

তবে ইতিহাসের দিক থেকে দেখতে গেলে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের ইতিহাস হল ভাঙা-গড়ার ইতিহাস। বহুবার বিদেশী আক্রমণে এই মন্দির ধ্বংস হয়েছে, বিদেশী শক্তি এই মন্দিরকে লুঠ করেছে বারবার। এই মন্দির প্রথমে কবে নির্মিত হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে ঐতিহাসিকদের মতে, একাদশ শতকে হরিচন্দ্র এই মন্দির পুননির্মাণ করেছিলেন। ১১৯৪ সালে মহম্মদ ঘোরীর সেনাপতি হিসেবে কুতুবউদ্দিন আইবক যখন কনৌজের রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করেন তখন এই মন্দিরটি ভেঙে ফেলেন। দিল্লির সুলতান ইলতুতমিসের শাসনামলে ১২৩০ সাল নাগাদ একজন গুজরাটি ব্যবসায়ী মন্দিরটির সংস্কার করেছিলেন বলে জানা যায়। পরে হুসেন শাহ শার্কি অথবা সিকান্দার লোদীর শাসনকালে পুনরায় মন্দিরটি ভেঙে ফেলা হয়। এরপর সম্রাট আকবরের সময়ে মোগল সেনাপতি মানসিংহ এবং আকবরের অর্থমন্ত্রী টোডরমল মন্দিরটির পুননির্মাণ করেছিলেন। তবে ১৬৬৯ সালে ঔরঙ্গজেব আবার এই মন্দির ভেঙে ফেলেন এবং ধ্বংসের পর সেইস্থানে জ্ঞানবাপী মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৭৪২ সালে মারাঠা শাসক মলহার রাও হোলকার মসজিদটি ভেঙে সেইস্থানে পুনরায় মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা করেন কিন্তু তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। ১৭৫০ সালের দিকে জয়পুরের মহারাজা কাশী বিশ্বনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের জন্য জমি কেনার উদ্দেশ্যে জায়গাটির চারপাশের জমির জরিপ পরিচালনা করেন কিন্তু তাঁর স্বপ্নও অধরা থাকে। অবশেষে ১৭৭৭ থেকে ১৭৮০ সালের মধ্যে ইন্দোরের রাণী অহল্যাবাই হোলকার বর্তমান মন্দিরটির পুননির্মাণ করেন। ১৮৩৫ সালে মহারাজা রঞ্জিত সিংহ তাঁর স্ত্রী দাতার কৌরের নির্দেশে  মন্দিরের গম্বুজে সোনার প্রলেপ দেওয়ার জন্য এক টন সোনা দান করেছিলেন। নাগপুরের তৃতীয় রঘুজী ভোঁসলে ১৮৪১ সালে মন্দিরে রৌপ্য দান করেছিলেন।

কাশী বিশ্বনাথের এই মন্দিরটি স্থাপত্য শৈলী খুব সুন্দর। এই মন্দিরটির কাঠামো মোট তিনটি অংশে বিভক্ত। প্রথমভাগটি সূচালো চূড়াবিশিষ্ট একটি মন্দির, দ্বিতীয় ভাগে সোনার প্রলেপ দেওয়া গম্বুজাকৃতি চূড়ার মন্দির এবং তৃতীয় ভাগেও মন্দিরের চূড়াটি প্রথমটির মতো , তবে এটি সোনার প্রলেপযুক্ত। এছাড়াও এই ১৫.৫ মিটার উচ্চ তৃতীয় মন্দিরটির চূড়ায় রয়েছে একটি ত্রিশূল ও পতাকা। সোনার চূড়ার জন্য এই মন্দিরকে স্বর্ণমন্দিরও বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও এই মন্দির চত্বরে বিরূপাক্ষ গৌরী, শনিদেব, অভিমুক্তেশ্বর, বিনায়ক, কালভৈরব প্রভৃতি দেবতার ছোট ছোট মন্দির দেখা যাবে। মূল মন্দিরের উত্তরদিকে একটি পবিত্র কূপ রয়েছে, যেটি জ্ঞানবাপী কূপ নামে পরিচিত। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে, আক্রমণকারীদের হাত থেকে জ্যোতির্লিঙ্গকে বাঁচানোর জন্য এক পুরোহিত মূর্তি নিয়ে এই কূপটিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। একটি সভামন্ডপ পেরিয়ে গর্ভগৃহের দিকে গিয়ে জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন করতে হয়। জ্যোতির্লিঙ্গের মূর্তিটি ৬০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং এর পরিধি ৯০ সেন্টিমিটার। একটি রৌপ্য বেদীর উপরে এই জ্যোতির্লিঙ্গটি স্থাপিত। জ্যোতির্লিঙ্গের ডান অংশে ভগবতী অর্থাৎ শক্তির বাস। মন্দিরটিতে নাগারা স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন লক্ষ করা যাবে। এছাড়াও মন্দিরের বিভিন্ন মন্ডপগুলি জটিল ও সূক্ষ্ম কারুকার্য ও ভাস্কর্যে ভরপুর। মন্দিরের গায়ে এইসমস্ত খোদাইকার্যগুলির সাহায্যে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

এই কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিশেষ বিশেষ কিছু উৎসব ধুমধাম করে পালিত হয়ে থাকে। প্রথমেই বলতে হয় মহাশিবরাত্রির কথা। ফাল্গুন মাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে এই উৎসব পালন করা হয়। ভক্তরা এই সময়ে উপবাস করে, বিশেষ বিশেষ আচার পালনের মাধ্যমে শিবরাত্রি উদযাপন করে। মন্দির চত্বর সুন্দরভাবে সাজানো হয় এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় শোভাযাত্রাও হয় এই সময়ে। দ্বিতীয়ত বলতে হয় নবরাত্রিদুর্গাপূজার কথা। এটি দেবী দুর্গার উদ্দেশে নিবেদিত নয় রাত্রির উৎসব। দেবীর বিসর্জনের মাধ্যমে এই উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে। এইসময় ভক্তিমূলক গানের আসর, ধর্মীয় গ্রন্থের আবৃত্তি ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আরেকটি উল্লেখযোগ্য উৎসব হল অন্নকূট উৎসব। এটি মূলত দীপাবলির পরেরদিন পালিত হয়। এটিকে গোবর্ধন পূজাও বলা হয়ে থাকে এবং এই উৎসব কৃষ্ণের সঙ্গে জড়িত। এইদিনে কৃষ্ণকে পাহাড়ের মত উঁচু করে খাবার সাজিয়ে নিবেদন করা হয়। বিশ্বনাথ মন্দিরে একটি বিশাল আকৃতির অন্নকূট নির্মাণ করে শিবকে নিবেদন করা হয়। ভক্তেরা সেই অন্নকূট দেখতে ভিড় করে। এছাড়াও আলোর উৎসব দীপাবলিতে গোটা মন্দির চত্বরকে দীপমালায় সজ্জিত করা হয়। এখানে অনুষ্ঠিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল দেব দীপাবলি। সাধারণত দীপাবলির পনেরো দিন পর এই উৎসব হয়ে থাকে। এই দিন ত্রিপুরাসুরকে শিব বধ করেছিলেন। এইসময় গঙ্গার ঘাটে অর্থাৎ রবিদাস ঘাট থেকে রাজঘাট পর্যন্ত প্রায় একলক্ষ প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়। কথিত আছে এইদিন দেবতারা গঙ্গাস্নান করতে পৃথিবীতে নামেন এবং এই উৎসবটি ত্রিপুরা পূর্ণিমা স্নান হিসেবেও পরিচিত। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে পালিত আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল রঙ্গভরী একাদশী। ফাল্গুন মাসে দোল পূর্ণিমার ঠিক আগের একাদশীর দিন এই উৎসব পালিত হয়। মনে করা হয় এইদিন দেবী পার্বতীকে নিয়ে শিব কাশীতে এসেছিলেন এবং তাঁদের আবীর দিয়ে স্বাগত জানানো হয়েছিল। এইদিন আমলকি গাছেরও পুজো করা হয়, বিশ্বাস করা হয় তার ফলে নারায়ণ ও লক্ষ্মীর আশীর্বাদ পাওয়া যাবে। সেই কারণে এই দিনটি আমলকি একাদশী নামেও পরিচিত।ভক্তরা কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের মহন্তের বাড়ি থেকে একটি পালকিতে শিব ও দেবী পার্বতীর মূর্তি বহন করে মন্দিরের গর্ভগৃহে নিয়ে যায় এবং আবীর ও গোলাপের পাপড়ি দিয়ে তাঁদের সাজানো হয়।

হিন্দুদের বিশ্বাস অনুসারে এই কাশী হল সাতটি মোক্ষপুরীর একটি। কথিত আছে এখানে কারও মৃত্যু হলে শিব নিজে সেই মৃত ব্যাক্তির কানে স্বয়ং এসে পরিত্রাণের মন্ত্র শোনান। প্রতি বছর এই কাশী বিশ্বনাথ দর্শনের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গা এমনকি বিদেশ থেকেও প্রচুর ভক্ত এসে এখানে ভিড় করে।

আপনার মতামত জানান