বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিচিত্র ঘটনা পরম্পরায় যেসব ব্যক্তির নাম বিতর্কের তালিকায় উঠে এসেছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ (Khondaker Mostaq Ahmad)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকান্ডের মূল ষড়যন্ত্রী হিসেবে মোশতাক আহমেদের নাম উঠে আসে। একজন বিশিষ্ট আইনজীবী হিসেবে জীবন শুরু করলেও পরবর্তীকালে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি এবং ক্রমে মুজিবর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। আইয়ুব খানের শাসনকালে কারাবাসও করতে হয়েছিল তাঁকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নবগঠিত মুজিবনগর সরকারে তাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁর কাজ ছিল আন্তর্জাতিক সমর্থন তৈরি করা, কিন্তু সেই পদে থাকাকালীন তিনি পাকিস্তান সরকারের স্থিতাবস্থা রক্ষায় সহায়তা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। স্বাধীনতার পরে মুজিবর রহমানের মন্ত্রীসভায় বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করেছিলেন মোশতাক আহমেদ। তাঁর নির্দেশে চার রাজনৈতিক নেতাকে ঢাকার কারাগারে হত্যা করা হয়েছিল। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত অধ্যায়।
১৯১৮ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন অখন্ড ভারতে বর্তমানে বাংলাদেশের কুমিল্লার (সাবেক টিপ্পের জেলা) অন্তর্গত দাউদকান্দি উপজেলার দাসপাড়া গ্রামে একটি বাঙালি মুসলিম পরিবারে খন্দকার মোশতাক আহমেদের জন্ম হয়। তাঁর বাবা খন্দকার কবিরউদ্দিন আহমেদ (Khondaker Kabiruddin Ahmad) দাউদকান্দি অঞ্চলের একজন নামজাদা মানুষ ছিলেন।
প্রাথমিক স্তর এবং বিদ্যালয় স্তরের পড়াশোনা সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। আইনের প্রতি প্রবল আগ্রহ থেকেই উচ্চ শিক্ষাস্তরে আইনকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক অর্থাৎ বি.এল.এ ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
ব্রিটিশ ভারতে বড় হওয়া মোশতাক ইংরেজদের অত্যাচার দেখেছেন নিজের চোখে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের আগুন চারদিকে যখন ছড়িয়ে পড়েছিল, মোশতাক আহমেদ সেই আন্দোলনে ভীষণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তারিখের হিসেবে বলতে গেলে ১৯৪২ সালে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। পাকিস্তান আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে উপস্থিত সদস্যদের সম্মতিক্রমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের মত রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মোশতাক সেই দলের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন যৌথভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।
এরপর আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, গণতন্ত্রী দল এবং নিজাম-ই-ইসলামের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। যুক্তফ্রন্ট পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বৃহত্তর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়েছিল। ঢাকায় বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পিছনে তাঁদের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। এই যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ‘আর্টিকেল ৯২’ ব্যবহার করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়েছিল এবং অন্যান্য বাঙালি নেতাদের সঙ্গে মোশতাক আহমেদকেও ১৯৫৪ সালে কারাবন্দী করা হয়েছিল। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৫ সালে তিনি মুক্তি পান। আব্দুল হামিদ খান ভাসানি এবং মুজিব দলকে ধর্মনিরপেক্ষ করার উদ্দেশ্যে যখন আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়ার কথা বলেন, খন্দকার মোশতাক আহমেদ তখন তার প্রতিবাদ করেছিলেন। পরবর্তীকালে যুক্তফ্রন্ট সংসদীয় দলের চীপ হুইপ হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জা প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খানের প্রশাসনের বিরুদ্ধে সামরিক আইন জারি করার সিদ্ধান্ত নিলে আইয়ুব খান তা সমর্থন করেন এবং মির্জা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে আইয়ুব খানকে নিযুক্ত করলে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব সামরিক আইন ঘোষণা করেন। এই আইন জারি হলে ১৯৫৮ সালে মোশতাক আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনবার কারাবরণ করে বঙ্গবন্ধুর আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। এরপর ১৯৬৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শোষণের অবসান ঘটাতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে ছয় দফা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল সেখানেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি এবং সেই কারণে পুনরায় কারাবাস করতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৬৯ সালে আটটি রাজনৈতিক দল মিলে যে আইয়ুব-বিরোধী ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেছিল, মোশতাক সেই পরিষদের পশ্চিম পাকিস্তান অংশের সমন্বয়ক হয়েছিলেন। সেবছরই, রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের আহ্বানে যে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন হয়েছিল তাতে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে মুজিবর রহমানের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এরপরে ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন সংঘটিত হয় এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
সত্তরের দশকের শুরুতেই গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে মুক্তিযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল, যা কিনা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত ছিল। সেই সংগ্রামকালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে তাঁর দলের অন্যান্য সদস্যরা পালিয়ে গিয়েছিলেন। অবশেষে ভারতবর্ষের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলাতে তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম-সহ আওয়ামী লীগের আরও সমস্ত প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেই নবগঠিত সরকারের মন্ত্রীপরিষদের দায়িত্ব বন্টন করে দেওয়া হয়েছিল নেতাদের মধ্যে। খন্দকার মোশতাক আহমেদ পেয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব। তাঁর প্রধান কাজ ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন সংগ্রহ করা। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কর্মকান্ডকে ঘিরে বিতর্ক দানা বেঁধে উঠতে থাকে। তিনি মুজিবরের ছয় দফা সনদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর এই উদ্যোগে যে আওয়ামী লীগের অন্য কিছু নেতাও জড়িত এমন অভিযোগও শোনা গিয়েছিল।
স্বাধীনতা লাভের পর মুজিবর রহমান সরকারের মন্ত্রীসভায় স্থান পেয়েছিলেন মোশতাক আহমেদ। বিদ্যুৎ, সেচ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে মুজিবের তৃতীয় মন্ত্রীসভায় তাঁকে উক্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর পদ প্রদান করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত এই পদের দায়িত্ব সামলেছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালেই নবগঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশালের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন মোশতাক।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। সেদিন সেনা সদস্যদের হাতে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান এবং তাঁর পরিবার নিহত হয়েছিলেন। কেবল মুজিবের কন্যারা তখন পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় তাঁরা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। এই হত্যাকান্ডের পিছনে মোশতাক আহমেদের কুটিল ষড়যন্ত্র ছিল বলেই মনে করা হয়। তিনি মুজিব হত্যাকারীদের ‘সূর্য সন্তান’ বলে উল্লেখ করেন। এমনকি ১৯৭৫ সালেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে মুজিব হত্যাকারীদের বিচার থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেন তিনি। মুজিবরের মৃত্যুর পর অবিলম্বে খন্দকার মোশতাক নিজেকে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এরপর কে এম শফিউল্লাহর স্থানে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়েছিল। এরপর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মুহম্মদ মনসুর আলী, প্রমুখকে মোশতাক কারারুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এছাড়াও বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’কে বদলে দেন তিনি এবং তার বদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগানের প্রবর্তন করেন। ‘বাংলাদেশ বেতার’-এর নাম পরিবর্তন করে তিনি নতুন নাম দেন ‘রেডিও বাংলাদেশ’। এমনকি মুজিবের দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে তিনি দেশে ফিরতে বাধা করেছিলেন বলেও শোনা যায়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোট ৮৩ দিনে তাঁর কর্মকান্ডের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য, বাকশালের একদলীয় ব্যবস্থা রোধ করা, কতকগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকা পুনরায় খোলা এবং বেসরকারিকরণে গতি আনার চেষ্টা। মুজিবর চেয়েছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে, কিন্তু মোশতাক আহমেদ সাম্প্রদায়িকতার আবহকে সবসময় বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন। ৩ নভেম্বর বাংলাদেশে কুখ্যাত ‘জেল হত্যা দিবস’ নামে পরিচিত। নভেম্বরের তিন তারিখ মোশতাক আহমেদের নির্দেশে আওয়ামী লীগের চার নেতাকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদে বহাল ছিলেন তিনি। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফ এবং শাফাত জামিলের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানের পর তাঁকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছিল।
এরপর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ এবং জিয়াউর রহমানের প্রশাসন খন্দকার মোশতাক আহমেদকে ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর কারাবন্দি করে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে জেল থেকে মুক্তির পর ডেমোক্রেটিক লীগ গঠনের মাধ্যমে তিনি পুনরায় নিজের রাজনৈতিক জীবনকে পুনরুজ্জীবিত করবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সফলতা পাননি। উপরন্তু সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের লিপ্ত থাকার অভিযোগে পুনরায় কারারুদ্ধ করা হয় তাঁকে। জেল থেকে বেরোবার পরেও পুরোদমে রাজনীতি করতে থাকেন মোশতাক। মুজিবর রহমানের হত্যাকান্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী খন্দকার মোশতাক আহমেদের বিরুদ্ধে মুজিবর হত্যার অভিযোগ এনে ধানমান্ডি থানায় মামলা করেছিলেন।
অবশেষে ১৯৯৬ সালের ৫ মার্চ খন্দকার মোশতাক আহমেদের মৃত্যু হয়।
One comment