কিরীটেশ্বরী মন্দির

কিরীটেশ্বরী মন্দির ভ্রমণ

কিরীটেশ্বরী মন্দির হল মুর্শিদাবাদের অন্যতম প্রাচীন মন্দির। এই মন্দিরটি একটি সতীপীঠ যেখানে সতীর মাথার মুকুটের অংশ পড়েছিল বলে মানুষের বিশ্বাস। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তেরা এখানে পূজা দিতে আসে। মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে এলে অবশ্যই একদিন কিরীটেশ্বরী মন্দির ঘুরে দেখা উচিত। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে মীরকাশিম যখন রাজা রাজবল্লভকে ডুবিয়ে মারেন, সেই দিন এই মন্দিরের এক শিবলিঙ্গ নাকি আপনা আপনি ফেটে যায়। মীরজাফর শেষ বয়সে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হলে রোগমুক্ত হবার আশায় দেবীর চরণামৃত পান করেন। দেবীর চরণামৃত মুখে নিয়েই নাকি মারা গিয়েছিলেন তিনি।

কিরীটেশ্বরী মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় ভাগীরথী নদীর তীরে নবগ্রাম সি ডি ব্লকের কিরীটকণা গ্রামে অবস্থিত। ভাগীরথী নদীর যে তীরে বহরমপুর অবস্থিত, তার অপর পাড়ে রয়েছে এই মন্দির।

কিরীটেশ্বরী সতীপীঠে আসলে সতীর কোন অঙ্গ পড়েছে তা নিয়ে ভিন্নমত আছে। তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থে এটিকে একটি সতীপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মন্দিরের পুরোহিতদের মতে কিরীট হচ্ছে সতীর কপালের ওপরে শিরের নিচের সংযোগস্থল। কিন্তু শিবচরিতগ্রন্থে কিরীট অর্থে সতীর মাথার মুকুটের কথা বলা হয়েছে। এখানে সতীর কোনো অঙ্গ না পড়ায় এই পীঠকে একটি উপপীঠ বলে উল্লেখ করা আছে। মুকুট পড়ার কারণে দেবীকে মুকুটেশ্বরী বলেও ডাকা হয়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বলা হয় রাণী ভবানীর দত্তক পুত্র রাজারামকৃষ্ণ মায়ের দর্শন লাভের জন্য এখানে পঞ্চমুন্ডির আসন স্থাপন করে সাধনা শুরু করেছিলেন। সাধনা শেষে মায়ের দর্শন না পেয়ে আকুল রামকৃষ্ণ নিজের প্রাণ দিতে গেলে মা দৈবযোগে বলেন সময় হলে তিনি রামকৃষ্ণকে দেখা দেবেন। এরপর রামকৃষ্ণ বাংলাদেশের নাটোরে গিয়ে কঠোর সাধনা শুরু করেন এবং মায়ের দর্শন লাভ হয়। মা স্বপ্নাদেশে রানী ভবানী কে কিরীটকণাতে মন্দির স্থাপন করতে আদেশ দেন। রানী ভবানী পঞ্চমুন্ডির আসনের খানিক উপরে একটি গর্ভ তৈরি করে তার ভিতরে মায়ের শিলামূর্তি টিকে স্থাপন করেন। রাজা রামকৃষ্ণ মুর্শিদাবাদে তাঁর রাজধানী বড়নগর থেকে এখানে আসতেন। মন্দির-প্রাঙ্গনে দুটি পাথরখণ্ড রাখা আছে, যার উপর বসে রাজা রামকৃষ্ণ সাধনা করতেন। তারপরে লালগোলার রাজা ভগবান রায়, মুঘল সম্রাট আকবরের থেকে এই মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ১৪০৫ সালে দেবীর প্রাচীন মন্দিরটি ভেঙে পড়ে। পরবর্তীকালে উনিশ শতকে ভগবান রায়ের বংশধর দর্পনারায়ণ রায় নতুন মন্দির নির্মাণ করান। রাজা রাজবল্লভ এখানে দুটি শিবমন্দির তৈরি করেছিলেন।

 দেবীর বিগ্রহ
কিরীটেশ্বরী মন্দিরে দেবীর বিগ্রহ। ছবি ইন্টারনেট

মন্দিরে দেবীর কোনো মূর্তি নেই। এমনকি কোনও ছবিও এখানে পূজিত হয় না। শিলামূর্তিকেই দেবী রূপে পূজা করা হয়। এই শিলাটির রঙ লাল এবং শিলাটি একটি আবরণে ঢাকা থাকে। প্রতি বছর দুর্গাপূজার অষ্টমীতে এই আবরণটি পরিবর্তন করা হয়। বলা হয় সতীর কিরীটটি এই মন্দিরের কাছেই রানি ভবানীর গুপ্তমঠে রাখা আছে। প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী বিমলা ও ভৈরব সংবর্ত নামে পরিচিত। অনেকের মতে এখানে দেবীর ভৈরব রূপে যে মূর্তি পূজিত হয় সেটি একটি প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি। এই মূর্তিটি “ধ্যান বুদ্ধমূর্তি” নামে পরিচিত।

বহরমপুর বা হাজারদুয়ারি থেকে প্রথমে আসতে হবে ভাগীরথী নদীর ফেরিঘাটে। সেখান থেকে লঞ্চে করে নদীর অন্যপাড়ে এসে পাঁচগ্রাম – নবগ্রাম – লালবাগ রোড ধরে মন্দিরে আসতে হবে। টোটো ভাড়া করার আগে অবশ্যই ভাড়ার কথা বলে নেবেন।

মন্দিরের কাছাকাছি থাকবার ভালো ব্যবস্থা নেই। বহরমপুরে বা হাজারদুয়ারির কাছাকাছি হোটেলে থাকা যায়। সেখান থেকেই একদিনের জন্য কিরীটেশ্বর মন্দিরে ঘুরতে আসা যায়। ২০২০ সালের কোভিড পরিস্থিতির আগে অবধি পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মুর্শিদাবাদে প্রতিরাতে হোটেলের ভাড়া গড়ে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

পুরনো মন্দিরের অবশেষ। ছবি ইন্টারনেট

এখানে এসে মন্দিরে পূজা দিতে পারেন। পুরোহিতদের মুখে মন্দিরের জানা অজানা অনেক তথ্য পাবেন। অবশ্যই সকাল সকাল চলে আসুন। মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে এলে একদিন হাতে রাখুন ভাগীরথীর এইপাড়ে কিরীটেশ্বরী মন্দির এবং তার কাছকাছি অন্যান্য জায়গাগুলো ঘুরে দেখতে। মন্দিরের কাছাকাছি জায়গাগুলোর মধ্যে পড়ে খোসবাগ, ডাহাপাড়া ধাম, রোশনিবাগ ইত্যাদি। মন্দিরে এসে এখানের মনোরম এবং শান্ত পরিবেশ উপভোগ করতে পারেন। তবে কিছু মানুষ এখানে এসে পিকনিক করে। পিকনিক করে এখানের পরিবেশ খারাপ করবেন না।

সারা বছরই এখানে আসা যায়। তবে দর্পনারায়ণের সময় থেকে যে মেলার শুরু হয়েছিল টা আজও পৌষ মাসের প্রতি মঙ্গলবারে হয়। সেই সময়তেও আসতে পারেন। এছাড়া দুর্গাপূজা বা কালীপূজাতেও এখানে দেবীর পুজোয় প্রচুর ভিড় হয়। তাছাড়া মাঘ মাসের রটন্তি অমাবস্যাতেও দেবীর বিশেষ পূজা হয়। পূজা দিতে চাইলে এই সময়গুলোয় আসতে পারেন।


ট্রিপ টিপস

  • কিভাবে যাবেন – বহরমপুর বা হাজারদুয়ারি থেকে প্রথমে আসতে হবে ভাগীরথী নদীর ফেরিঘাটে। সেখান থেকে লঞ্চে করে নদীর অন্যপাড়ে এসে পাঁচগ্রাম – নবগ্রাম – লালবাগ রোড ধরে মন্দিরে আসতে হবে।
  • কোথায় থাকবেন – মন্দিরের কাছাকাছি থাকবার ভালো ব্যবস্থা নেই। বহরমপুরে বা হাজারদুয়ারির কাছাকাছি হোটেলে থাকা যায়। সেখান থেকেই একদিনের জন্য কিরীটেশ্বর মন্দিরে ঘুরতে আসা যায়।
  • কি দেখবেন – কিরীটেশ্বরী মন্দির ও পাশাপাশি আরও বিভিন্ন মন্দির।  মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে এলে একদিন হাতে রাখুন ভাগীরথীর এইপাড়ে কিরীটেশ্বরী মন্দির এবং তার কাছকাছি অন্যান্য জায়গাগুলো ঘুরে দেখতে। মন্দিরের কাছাকাছি জায়গাগুলোর মধ্যে পড়ে খোসবাগ, ডাহাপাড়া ধাম, রোশনিবাগ ইত্যাদি।
  • কখন যাবেন – সারা বছরই এখানে আসা যায়। 
  • সতর্কতা – 
    • সকালে মন্দিরে আসুন। বিকালের পর আসার দরকার নেই।
    • টোটো ভাড়া করার আগে অবশ্যই ভাড়ার কথা বলে নেবেন।
    • মন্দিরের কাছাকাছি থাকবার ভালো ব্যবস্থা নেই। বহরমপুরে বা হাজারদুয়ারির কাছাকাছি হোটেলে থাকা যায়। হোটেল আগে থেকে বুক করে রাখলে সুবিধে হবে।
    • মন্দিরপ্রাঙ্গণে পিকনিক করে এখানের পরিবেশ খারাপ করবেন না।

তথ্যসূত্র


  1. একান্ন পীঠ, হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়, দীপ প্রকাশন, পৃষ্ঠা ১৩৬-১৪২, মুর্শিদাবাদে কিরীটেশ্বরী
  2. https://en.wikipedia.org/
  3. https://bengali.koulal.com/
  4. https://www.budgettourplanner.com/

2 comments

আপনার মতামত জানান