প্রতিভা পাতিল

প্রতিভা পাতিল

প্রতিভা পাতিল (Pratibha Patil) একজন ভারতীয় রাজনীতিক যিনি ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রথম নারী হিসেবে ভারতবর্ষের দ্বাদশতম রাষ্ট্রপতির দায়ভার পালন করেন। তিনি ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত রাজস্থানের রাজ্যপাল পদেও আসীন ছিলেন।  ১৯৬২ সালে মাত্র সাতাশ বছর বয়সে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যুক্ত হয়ে নিজের বিয়াল্লিশ বছর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন এই বর্ষীয়ান নেত্রী। জাতীয় রাজনীতির ইতিহাসে নিজের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি নির্বাচনে অপরাজিত থাকার বিরল নজির গড়ার একমাত্র দাবীদার এখনও পর্যন্ত তিনিই।

১৯ ডিসেম্বর ১৯৩৪ সালে পরাধীন ভারতের বম্বে প্রেসিডেন্সীর অন্তর্গত নদগাঁও গ্রামে (বর্তমান মহারাস্ট্রের জলগাঁও জেলার নদগাঁও গ্রামে) এক সাধারণ পরিবারে প্রতিভা দেবীসিংহ পাতিলের জন্ম হয়। তাঁর বাবা নারায়ণ রাও পাতিল পুলিশ দপ্তরের আইনজীবী (public prosecutor) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ছোটবেলায় প্রতিভা তাঁর বাবার কাছে আসা মক্কেলদের নানাবিধ সমস্যাগুলির কথা মনোযোগ সহকারে শুনতেন। অবসর সময়ে, সেই সমস্যার উৎস এবং সমাধান নিয়ে নিজের মনে বিশ্লেষণ করতেন। এই সময়েই তিনি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের নানা সমস্যার মূল হিসেবে ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটিকে শনাক্ত করেন। তবে তাঁর এই চিন্তাভাবনার বিষয়টি তাঁর পরিবারের মানুষের অগোচরেই ছিল। পারিবার থেকেই  তিনি সাধারণ আটপৌড়ে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হতে শিখেছিলেন। ১৯৬৫ সালের ৯ জুলাই প্রতিভা পাতিল মহারাষ্ট্রের অমরাবতী নিবাসী রাজপুত বংশোদ্ভূত ড: দেবীসিংহ রামসিংহ শেখাওয়াতের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রতিভা পাতিল এবং ডঃ শেখাওয়াতের দুই সন্তান হলেন জ্যোতি রাঠোর এবং রাজেন্দ্র সিংহ।

মহারাষ্ট্রের জলগাঁও জেলার আর. আর. বিদ্যালায় (R. R. Vidyalaya) থেকে প্রতিভা পাতিল তাঁর বিদ্যালয় শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। এরপর পুণা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ জলগাঁও জেলার মূলজী জেঠা কলেজ থেকে তিনি অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ছোট থেকেই খেলাধূলায় তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। কলেজে পড়াকালীন প্রতিভা পাতিল একাধিকবার টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পদক ও পুরস্কার লাভ করেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভের পরে তিনি মুম্বাই বিস্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ সরকারি আইন কলেজ (Govt. Law College) থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রী (L. L. B.) অর্জন করেন।

প্রতিভা পাতিল জলগাঁও জেলা আদালতের আইনজীবী হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন। আইন জীবিকার পাশাপাশি তিনি সমাজসেবার কাজেও যুক্ত ছিলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য হয়ে ১৯৬২ সালে মাত্র সাতাশ বছর বয়সে তিনি রাজনীতির আঙিনায় পা রাখেন। ঐ বছর তিনি মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে জলগাঁও কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে জীবনের প্রথম নির্বাচন লড়ে জয়যুক্ত হন। এরপর তিনি পর পর চারবার এদলাবাদের মুক্তাইনগর নির্বাচন ক্ষেত্র থেকে প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন লড়েন এবং প্রত্যেকবার জয়লাভ করে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বিধায়ক থাকেন। ঐ সালেই তিনি রাজ্যসভার পার্লামেন্ট মেম্বার হন এবং ১৯৯০ পর্যন্ত পার্লামেন্টের মেম্বার হিসেবে কাজ করেন। পরে ১৯৯১ সালে গঠিত দশম লোকসভা সদস্য হন তিনি। ঐ সময়ে তিনি অমরাবতী নির্বাচন ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে তিনি তাঁর জীবনের সমস্ত নির্বাচনে জয় লাভ করেন।

প্রতিভা পাতিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন—১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি মহারাষ্ট্র সরকারের জন স্বাস্থ্য ও পর্যটন বিভাগের ডেপুটি মিনিস্টারের দায়িত্ব সামলান। ঐ সময়েই তিনি মহারাষ্ট্র সরকারের হাউসিং এন্ড পার্লামেন্ট অ্যাফেয়ার্সের মন্ত্রীত্বও সামলেছিলেন। এই সালের শেষের দিকে উনি মহারাষ্ট্র সরকারের সমাজ কল্যাণ বিভাগের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হন এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৭৫ সালে তিনি সমাজ কল্যাণ বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিভাগের ক্যাবিনেট মন্ত্রী পদগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত তিনি পুনর্বাসন ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি শিক্ষা মন্ত্রকের ক্যাবিনেট মন্ত্রিত্ব সামলান। এরপর ১৯৭৯ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রতিভা পাতিল মহারাষ্ট্রের বিধানসভায় বিরোধী দলনেত্রী ছিলেন।  তাঁর কিছু বছর পর ১৯৮২ সালে তিনি মহারাষ্ট্র সরকারের নগর উন্নয়ন ও আবাসন দপ্তরের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হন এবং ১৯৮৩ সালে পুনরায় সমাজ কল্যাণ মন্ত্রকের ক্যাবিনেট পদগ্রহণ করেন এবং ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন।

পরবর্তী সময়ে প্রতিভা পাতিল ১৯৮৬ সালে রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারপার্সন হন এবং ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এই পদের দায়িত্ব পালন করেন। ঐ সময়ে ডঃ ভেঙ্কটরমন রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। একই সঙ্গে উনি লোকসভার হাউস কমিটিরও  চেয়ারপার্সন ছিলেন।

তাঁর কর্ম জীবনের বিশাল পরিসরে তিনি অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সালে মহারাষ্ট্র সরকারের জল দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ সালে তিনি মহারাষ্ট্র প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হয়ে ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ‘ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ আর্বান কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক’-এর ডিরেক্টর এবং ‘ভারতীয় ন্যাশনাল কোঅপারেটিভ ইউনিয়ন’-এর সভাপতিত্ব করেন। ঐ সময়ে তিনি মহারাষ্ট্র সরকারের ‘২০-পয়েন্ট প্রোগ্রাম’-এর অন্যতম একজন কাণ্ডারী ছিলেন।

প্রতিভা পাতিল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি নাইরোবি এবং পুয়ের্তো রিকোতে অনুষ্ঠিত ‘সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার কনফারেন্স’-এ  ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৯৫ সালে চীনের বেজিং-এ  অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব নারী সমাবেশ’-এ (‘World Women’s Conference’) এবং অস্ট্রিয়াতে ‘স্ট্যাটাস অফ উইমেন’ সমাবেশে ভারতীয় বিশেষ সম্মানীয় ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। 

প্রতিভা পাতিল শিশু ও নারী কল্যাণমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি মুম্বাই এবং দিল্লিতে কর্মজীবী মহিলাদের জন্য আবাসন তৈরি করেন। অমরাবতী জেলার পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য এবং বিমুক্তা জাতির দুঃস্থ শিশুদের জন্য স্কুল তৈরি করেন। ঐ অঞ্চলের দুঃস্থ মহিলাদের জন্য গান, সাঁতার এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। জলগাঁওতে গ্রামীণ যুবকদের জন্য কারিগরি কলেজ নির্মাণ করেন এবং জলগাঁও জেলাতে মহিলা হোমগার্ড নিয়োগ চালু করেন। মহারাষ্ট্র সরকারের অধীনে নারী উন্নতির লক্ষ্যে তৈরি ‘মহিলা বিকাশ মহামণ্ডল’ তৈরিতে ওনার ভূমিকা অপরিসীম। এছাড়াও তিনি অমরাবতীতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যে কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করেন।                               

রাজস্থানের রাজ্যপাল পদে আসীন হবার পূর্বে প্রতিভা দেবীসিংহ পাতিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যা হিসেবে তাঁর দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে নানান নির্বাচনে বিভিন্ন নির্বাচন কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়েছেন এবং তার প্রত্যেকটিতে জয়যুক্ত হওয়ার মতো বিরল কৃতিত্বের অধিকারিণী তিনি। প্রতিভা পাতিল ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি হয়ে ইতিহাসে চিরস্থায়ী স্থানলাভের পাশাপাশি এখনও পর্যন্ত একমাত্র মহিলা রাষ্ট্রপতি হওয়ার নজির সৃষ্টিকারী রূপেও স্মরণীয়।

৩ আগস্ট ২০১৮ সালে মেক্সিকো সরকার প্রতিভা পাতিলকে “অর্ডার অফ দা অ্যাজটেক ঈগল” (“Order of the Aztec Eagle”) সম্মানে ভূষিত করেন। এটি মেক্সিকোর সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ভারত এবং মেক্সিকোর সম্পর্ক দৃঢ়করণে  বিশেষ ভূমিকা পালন করার জন্য তিনি এই সম্মানের অধিকারী হন। ভারতের পূর্ব রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের পর তিনিই দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে এই সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। ১ জুন ২০১৯ সালে পুণের মিসিয়া ভবনে (MCCIA Bhavan) “অর্ডার অফ দা অ্যাজটেক ঈগল” সম্মান প্রদানের অনুষ্ঠানটি হয়। 

3 comments

আপনার মতামত জানান