স্বাধীনতা সংগ্রামী, অগ্নিযুগের বিপ্লবী এবং সাহিত্যিক পূর্ণেন্দু দস্তিদার (Purnendu Dastidar)। তার জন্ম ১৯০৯ সালের ২০ জুন। চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে। তাঁর বাবা চন্দ্রকুমার দস্তিদার। দস্তিদার সুলতানী আমলের পদবী,বংশসূত্রে তাঁরা ছিলেন দাশগুপ্ত। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বাবা চন্দ্রকুমার দস্তিদার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করার পর চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন। তাঁর মা কুমুদিনী দস্তিদার। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রমী নারী।
পূর্ণেন্দু দস্তিদার(Purnendu Dastidar) ছিলেন সাত ভাইয়ের মধ্যে বড়।১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় পূর্ণেন্দু দস্তিদার এম.ই. স্কুলে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। ওই বছর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ অসহযোগ আন্দোলনের কাজে চট্টগ্রাম আসেন। এ উপলক্ষে এক বিরাট জনসভা হয়। এই জনসভায় চট্টগ্রামের স্কুল-কলেজের ছাত্ররা যোগ দেন। এতে পূর্ণেন্দু দস্তিদার ছিলেন।এপূর্ণেন্দু চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯২৫ সালে এন্ট্রান্স ও ১৯২৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই.এসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলেও সূর্যসেন এর সহযোগী হিসেবে কলকাতায় গ্রেফতার হন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ত্যাগ করেন। জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় ১৯৩৪ সালে তিনি দেউলি কারাগার থেকে ডিস্টিংশনসহ বি.এ পাস করেন এবং পরে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪০ সালে জেল থেকে মুক্তি লাভের পর তিনি চট্টগ্রাম আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
জীবনের দীর্ঘ সময় তাঁকে কাটাতে হয় জেলে। আর জেলে বসে তিনি রচনা করেন তাঁর বেশির ভাগ গ্রন্থ। এসব গ্রন্থে তিনি তুলে আনেন ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ও ত্যাগের কথা। তিনি বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে যুক্ত করেন সাহিত্যের এক নতুন ধারা, বিপ্লবী রাজনৈতিক সাহিত্য।
পূর্ণেন্দু দস্তিদারই প্রথম চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলে নারীদের অন্তর্ভূক্ত করেন। তখনকার দিনে সশস্ত্র বিপ্লবী দলে নারীদেরকে নানা কারণে নেয়া হতো না। তার মধ্যে একটা অন্যতম কারণ ছিল; বিপ্লবীরা নারী সংস্পর্শে এলে বিপ্লবী পথে-মতে জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগবেন। তিনি এধারণা পাল্টে দেন। বিপ্লবী দলে তিনি কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতাসহ আরো অনেক নারীকে সংগঠিত করেন।
১৯২৫ সালে পুলিশ সূর্যসেনকে ধরার জন্য দেওয়ান বাজারে তাঁর শ্বশুর বাড়ি ঘেরাও করলে সূর্যসেন পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বাড়িতে ওঠেন। বিপ্লবী দলের ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, কানাইলাল, দেশের কথা, ও সরকারী রাউলাট কমিশন ইত্যাদি যেসব গোপন বই-পত্র ছিল তা রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল তাঁর উপর। তিনি এসব গোপন বই তাঁর খুড়তুতো বোন প্রীতিলতার কাছে রেখে দেন।
১৯২৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হন। ১৯২৮ সালে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা মুক্তি পান। এসময় পূর্ণেন্দু দস্তিদার কলকাতায় চলে আসেন। এখানে তিনি বিপ্লবী দলের সাথে রিভলভার, পিস্তল কেনা, বিস্ফোরকের জন্য পিকরিক এসিড সংগ্রহ, গান কটন তৈরী করা, বোমার খোল বিভিন্ন জেলে পৌছে দেয়ার কাজ করতেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি কলকাতাস্থ চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের একজন প্রধান সদস্যে পরিণত হন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করার প্রাক প্রস্তুতি পর্বের সকল কাজের সাথে পূর্ণেন্দু দস্তিদার যুক্ত ছিলেন। মাস্টারদা তাঁকে কোলকাতা থেকে কাজ করতে বলেছিলেন ফলে প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্বেও সরাসরি অস্ত্রাগার দখলের সশস্ত্র অভ্যুত্থানে থাকতে পারেননি। কলাকাতায় তিনি বিখ্যাত সাহিত্যিক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন।
১৯৪০ সালে তিনি বিপ্লবী রাজনীতির পাশাপাশি চট্টগ্রাম আদালতে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এ সময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে সারা বাংলায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দিলে কমিউনিষ্ট পার্টি সারা দেশব্যাপী লঙ্গরখানা খুলে বুভুক্ষু মানুষকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে। পূর্ণেন্দু দস্তিদার এই সময় অমানুষিক পরিশ্রম করেন।
১৯৪৬ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সমায় তিনি জীবনবাজী রেখে অসীম সাহসিকতার সাথে দাঙ্গা মোকাবেলা করেন। পাকিস্তান আমলের পুরোটা সময় কেটেছে তাঁর জেল আর আত্মগোপনে। আত্মগোপনে থাকাবস্থায় তিনি বিভিন্ন স্থানে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলেন।
১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ নবগঠিত পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। একই বছর বিপ্লবী রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে পাকিস্তান পুলিশ পুনরায় তাঁকে গ্রেফতার করে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জেলে আটক থাকা অবস্থাতেই তিনি চট্টগ্রাম জেলার হিন্দু আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়ে পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।১৯৫৫ সালের ৯ জুন জেল থেকে মুক্তি পান। তিনি পূর্ববঙ্গ পরিষদে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের (১৮ এপ্রিল ১৯৩০) স্মারকস্তম্ভ নির্মাণের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালে প্রস্তাবটি ব্যবস্থাপক সভায় গৃহীত হয় । ১৯৫৭ সালের ২৬ জুলাই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে তিনি ন্যাপের রাজনীতিতে যুক্ত হন।১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়। এ সময় তাঁকে আবারো গ্রেফতার করে পাকিস্তান পুলিশ। ১৯৬২ সালে তিনি মুক্তি পান। ওই বছর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির চট্টগ্রাম শহর কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৬৩ সালে ‘কবিয়াল রমেশ শীল’ নামে তাঁর রচিত একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এছাড়া তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ এবং অনূদিত গ্রন্থ ‘শেকভের গল্প’, ‘মোপাশাঁর গল্প’ প্রকাশিত হয়।১৯৭১ সালের ৯ মে পূর্ণেন্দু দস্তিদার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে ভারত গমন করেন। দেমাগিরি বর্ডার দিয়ে সীমান্ত পার হবার পর তিনি অজ্ঞাত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। যদিও তাঁর মৃত্যু নিয়ে অনেকে সন্দেহ করেন যে, তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
- https://en.wikipedia.org/wiki/Purnendu_Dastidar
- https://wikivisually.com/
- http://bn.banglapedia.org/
- http://en.banglapedia.org/
- http://www.gunijan.org.bd/
