বাংলা ভাষায় সুললিত প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে জনমানসে বৈজ্ঞানিক চেতনার বিকাশে অন্যতম পথপ্রদর্শক ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (Ramendra Sundar Tribedi)। কেবলই বিজ্ঞান নয়, দর্শন, সমাজ, ধর্ম ও সাহিত্যক্ষেত্রেও তাঁর অবদান শিক্ষিত বাঙালির মননে সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। বৈচিত্র্যময় ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে ঐক্যের সন্ধান ও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে পার্থক্য বিশ্লেষণ স্হান পেয়েছে তাঁর ‘প্রকৃতি’, ‘চরিতকথা’, ‘যজ্ঞকথা’ ইত্যাদি গ্রন্থ এবং অন্যান্য প্রবন্ধগুলিতে। বিশ শতকের বাঙালি মনীষার জাগরণে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এক অবিস্মরণীয় নাম।
১৮৬৪ সালের ২০ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার টৈঁয়া বৈদ্যপুর গ্রামে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর জন্ম। রামেন্দ্রসুন্দরের বাবা গোবিন্দসুন্দর ত্রিবেদী গণিত ও মহাকাশ বিষয়ে প্রবল আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল চন্দ্রকামিনী দেবী। তাঁরা আসলে বাঙালি ছিলেন না, তাঁর পূর্বপুরুষরা বন্ধুগল গোত্রের জিঝৌতিয়া ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত ছিল। প্রায় দুশো বছর আগে তাঁরা মুর্শিদাবাদে এসে স্হায়ী বসতি স্হাপনের ফলে তাঁদের মধ্যে বাংলা সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি এক গভীর অনুরাগ সৃষ্টি হয়। ছোটোবেলায় রাত্রে আকাশের তারা দেখানোর জন্য বালক রামেন্দ্রসুন্দরকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে যেতেন তাঁর বাবা। পরিবারের মধ্যে বিদ্যানুরাগের চর্চা থাকায় ছোটোবেলা থেকেই বিদ্যাশিক্ষার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ পায় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর।
শৈশব থেকেই অত্যন্ত মেধাবী রামেন্দ্রসুন্দর ছয় বছর বয়সে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি হন। সেখানে পাঁচ বছর পড়াশোনা করে তিনি ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় বসে প্রথম হয়ে বৃত্তি পান। গণিত ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। জানা যায়, জ্যামিতির প্রথম দুটি খণ্ড তিনি মাত্র দশ বছর বয়সেই সম্পূর্ণ করে ফেলেছিলেন। গ্রামের পাঠশালায় পড়া শেষ করে তিনি কান্দি ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলজীবনে পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন রামেন্দ্রসুন্দর। ১৮৮১ সালে কান্দি জেলা স্কুল থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় পঁচিশ টাকা বৃত্তিসহ প্রথম স্হান অর্জন করেন তিনি এবং ১৮৮৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্হান অধিকার করে স্বর্ণপদক ও বৃত্তি পান। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকেই ১৮৮৬ সালে বিজ্ঞানে অর্নাসসহ প্রথম স্হান অধিকার করে স্নাতক হন। ১৮৮৭ সালে এম.এ পরীক্ষাতেও রামেন্দ্রসুন্দর বিজ্ঞানে প্রথম স্হান অর্জন করার জন্য স্বর্ণপদক লাভ করেন। এরপর ১৮৯২ সালে রিপন কলেজ থেকে ‘প্রেমচাঁদ ও রায়চাঁদ’ বৃত্তি পান তিনি।
১৮৯২ সালে রিপন কলেজেই পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্রের অস্হায়ী অধ্যাপক হিসেবে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর কর্মজীবন শুরু হয়। পরবর্তী ছয় মাসে তিনি স্হায়ী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং আমৃত্যু তিনি ঐ কলেজেই শিক্ষকতা করেছেন। ১৯০৩ সালে তিনি এই কলেজের স্হায়ী অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন।
‘নবজীবন’ পত্রিকায় প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে রামেন্দ্রসুন্দরের প্রকাশ ঘটে। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে বি.এ ক্লাসে পড়ার সময় তাঁর লেখা প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ ‘মহাশক্তি’ প্রকাশিত হয় আর তারপর একে একে প্রকাশ পায় আরও তিনটি প্রবন্ধ ‘মহাতরঙ্গ’, ‘জড়জগতার বিকাশ’ ও ‘সৃষ্টিতত্ত্ব’। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ, নবীনচন্দ্র দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মত মনীষীরা ‘নবজীবন’-এর নিয়মিত লেখক ছিলেন। ‘নবজীবন’ ছাড়াও ‘সাধনা’, ‘দাসী’, ‘সাহিত্য’, ‘মানসী’, ‘সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’, ‘মুকুল’, ‘উপাসনা’, ‘আর্যাবর্ত’ ও ‘ভারতী’ ইত্যাদি পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হত। বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ রচনায় রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক হয়েও রামেন্দ্রসুন্দর স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর ছিলেন। তিনি বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও সাহিত্যের সৃজনশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর রচনায় যেখানে তাঁর এক নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী লক্ষ্য করা যায়। সবকিছুই যুক্তি দ্বারা বিচার করে তত্ত্ব ও তথ্যের সমন্বয় করতে গিয়ে কখনোই তিনি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেননি। শুধু তাই নয়, গভীর তত্ত্ব বিশ্লেষণের সময় তিনি উদাহরণের সাহায্য নিয়েছেন যা তাঁর প্রবন্ধগুলিকে অনন্য করে তুলেছে।
স্কুলজীবনে নবীনচন্দ্র দত্তের লেখা ‘খগোল’ বিবরণ পড়ে বিজ্ঞানচর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন রামেন্দ্রসুন্দর। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার যথাযথ বইপত্র সেসময় বিশেষ ছিল না। তাঁর অগ্রজ অক্ষয়কুমার দত্তই প্রথম বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই রচনা করেন আর অক্ষয়কুমার দত্তের পথ অনুসরণ করে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সারাজীবন মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তাঁর লেখা বিজ্ঞান বিষয়ক প্রথম বই ‘পদার্থবিদ্যা’। এছাড়াও তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক অন্যান্য প্রবন্ধগুলিতে পৃথিবীর বয়স সংক্রান্ত তথ্য, রেডিয়েশন তরঙ্গ তত্ত্ব, আণবিক তত্ত্ব, কসমিক ক্যাটাস্ট্রফির সম্ভাব্যতা, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তত্ত্ব, লাইট স্পেকট্রাম, থার্মোডাইনামিক্সের নীতিসমূহ বিষয় হিসেবে স্হান পেয়েছে। তিনি বিজ্ঞানের পরিসর, পদ্ধতি ও তাৎপর্য নিয়েও প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
তাঁর বিখ্যাত গ্রন্হগুলির মধ্যে ‘প্রকৃতি’, ‘জিজ্ঞাসা’, ‘কর্মকথা’, ‘চরিতকথা’, ‘যজ্ঞকথা’, ‘বিচিত্র প্রসঙ্গ’, ‘শব্দকথা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য এবং এগুলি ব্যতীত তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ‘বিচিত্র জগৎ’ ও ‘জগৎ কথা’ স্মরণীয়। তাঁর প্রবন্ধগুলিকে মূলত চারটি বিষয়ে ভাগ করা যায়। প্রথমত রাষ্ট্র ও সমাজমূলক প্রবন্ধ হিসেবে রামেন্দ্রসুন্দরের লেখা ‘বর্ণাশ্রম ধর্ম’ ও ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসে’ প্রবন্ধগুলি উল্লেখযোগ্য যেখানে তিনি ভারতবর্ষের ইতিহাসের সাথে ভারতীয়দের একসূত্রে বাঁধতে চেষ্টা করেছিলেন। ভারতের রাজশক্তি ও প্রজাশক্তি এক না হওয়ার কারণে ভারতবর্ষ একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে প্রকাশিত হতে পারেনি বলে তিনি মত ব্যক্ত করেছেন এই দুটি লেখায়। দ্বিতীয়ত রয়েছে তাঁর শিক্ষা-চিন্তামূলক প্রবন্ধ – ‘অরণ্যে রোদন’, ‘স্বদেশী বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রভৃতি এই জাতীয় প্রবন্ধগুলিতে এখানে তিনি দেশবাসীকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত করার জন্য যথার্থ শিক্ষাদানের কথা বলেছেন। সম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্হার ত্রুটিগুলিকে দূর করে শিক্ষাপ্রণালী সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। তৃতীয় ভাগে পড়ে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বদেশী চিন্তামূলক প্রবন্ধ ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ যেখানে তিনি স্বদেশী চেতনার সঙ্গে দেশবাসীর পরিচয় করিয়েছেন। এই প্রবন্ধটি মহিলাদের স্বদেশী চেতনা উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। এই প্রবন্ধে বাংলার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও বাংলা সংস্কৃতিকে বিচ্ছিন্ন করার কথা স্হান পেয়েছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তাঁর এই প্রবন্ধটি বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি তাঁর মূর্শিদাবাদের বাড়ির সামনে বিষ্ণুমন্দিরে প্রায় পাঁচশো লোককে একত্রিত করে তাঁর ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ প্রবন্ধটি পাঠ করেন। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হলে রামেন্দ্রসুন্দরের প্রস্তাবে সারা বাংলায় ‘অরন্ধন’ পালিত হয় এবং বাংলার মেয়েরা ‘বঙ্গলক্ষ্মী ব্রত’ পালন করেন। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি দেশপ্রেম ও স্বদেশ চেতনার বিশেষ পরিচয় রাখেন। সবশেষে তাঁর সাহিত্যবিষয়ক গ্রন্থ হিসেবে ‘জিজ্ঞাসা’, ‘নানাকথা’, ‘মহাকাব্যের লক্ষণ’ প্রভৃতি প্রবন্ধগ্রন্থ থেকে তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘জিজ্ঞাসা’ গ্রন্থে ‘সুখ দুঃখের কথা’ প্রবন্ধটিতে রামেন্দ্রসুন্দর ডারউইনের মতবাদের দ্বারা সুখ-দুঃখকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং ‘মহাকাব্যের লক্ষণ’ প্রবন্ধে মহাকাব্যের সৃষ্টির উৎস ও দেশ-সমাজে তার প্রভাব সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
রামেন্দ্রসুন্দরের অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। ভাষাতত্ত্ব, দর্শন, লোকসাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর অসাধারণ জ্ঞান যেমন ছিল, তেমনিই বিজ্ঞানের বিভিন্ন জটিল বিষয়কে তিনি সহজ মাতৃভাষায় বর্ণনা করতে পারতেন এবং সেই বিষয়ে বক্তৃতাও দিতেন। তাঁর মৌলিক কোনো গবেষণা না থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞানচর্চায় তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। তিনি বাংলা সংস্কৃতির ধারা বজায় রাখার জন্যই ১৮৯৪ সালে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ গঠন করেন যা তখনকার সর্বোচ্চ গুণমানী প্রতিষ্ঠান ছিল। তিনি ১৯০৪ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৪ সালে কলকাতার টাউন হলে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন’-এর সপ্তম অধিবেশনের বিজ্ঞান শাখার সভাপতি ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর। সেখানে তিনি বাংলায় প্রবন্ধ পাঠ করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অসম্মতি জানায়। তিনি তখন প্রবন্ধ পাঠ থেকে বিরত থাকেন। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী তাঁকে অনুমতি দিলে তিনি বাংলায় প্রবন্ধ পাঠ করেন এবং এই ঘটনায় তাঁর বাংলা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পায়। সাধারণ মানুষের কাছে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের প্রচার তাঁর জীবনের এক ব্রত ছিল। তিনি সাহিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৯১৯ সালের ৬ জুন মাত্র ৫৫ বছর বয়সে কলকাতায় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মৃত্যু হয়।
এই ধরণের তথ্য লিখে আয় করতে চাইলে…
আপনার নিজের একটি তথ্যমূলক লেখা আপনার নাম ও যোগাযোগ নম্বরসহ আমাদের ইমেল করুন contact@sobbanglay.com এ
তথ্যসূত্র
- https://en.m.wikipedia.org/
- https://bn.m.wikisource.org/
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.narajolerajcollege.ac.in/
