রিচার্ড ফাইনম্যান

রিচার্ড ফাইনম্যান

রিচার্ড ফাইনম্যান (Richard Feynman) একজন আমেরিকান তাত্ত্বিক পদার্থবিদ যিনি কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের জগতে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য বিশ্ব বিখ্যাত। নোবেল জয়ী পদার্থবিদ এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক তথাকথিত তাঁর এই দুই পরিচয়ের বাইরেও তিনি একজন দুর্দান্ত চিত্রশিল্পী। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ড্রাম বাজানোতেও তাঁর পারদর্শিতা ছিল অতুলনীয়।

১৯১৮ সালের ১১ মে, নিউইয়র্কের কুইন্স শহরের ফার রকাওয়েতে এক ইহুদী পরিবারে রিচার্ড ফিলিপস ফাইনম্যানের জন্ম হয়। তাঁর বাবা মেলভীল আর্থার ফাইনম্যান (Melville Aurthur Feynman) ছিলেন একজন সেলস্ ম্যানেজার এবং তাঁর মায়ের নাম লুসিল ফিলিপস (Lucille Phillips)। রিচার্ডের এক ছোট ভাই ছিল যে মাত্র চার সপ্তাহ বয়সে মারা যায় এবং ন বছরের ছোট এক বোন ছিল যার নাম জোয়ান। পরবর্তীকালে তাঁর অনুপ্রেরণাতেই জোয়ান একজন আ্যস্ট্রোফিজিসিস্ট হয়ে ওঠে। তাঁর প্রথম স্ত্রী আরলিন গ্রীনবম বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরবর্তীকালে তিনি মেরি লৌকে বিয়ে করেন। এই বিয়েটিও অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর তিনি গুয়েনিথ হোয়ার্থ-কে বিয়ে করেন এবং দুই সন্তানের জন্ম দেন।

বাল্যকাল থেকেই রিচার্ড ফাইনম্যান ইঞ্জিনিয়ারিং ভালবাসতেন এবং বাড়িতে নিজস্ব গবেষণাগারে অনেক রকম পরীক্ষা চালাতেন। ফার রকাওয়ে হাই স্কুলে পড়াকালীন তিনি রেডিও মেরামত করতে শিখেছিলেন এবং একটি ‘হোম বার্গলার এলার্ম সিস্টেমও’ বানিয়েছিলেন। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি ত্রিকোণমিতি, অ্যাডভান্সড অ্যালজেবরা, ইনফাইনাইট সিরিজ, অ্যানালিটিক জিওমেট্রি এবং ক্যালকুলাসে দক্ষতা  অর্জন করেন। ফাইনম্যানের বৈজ্ঞানিক সত্তার ভিত্তি তৈরিতে বাবা মেলভিলের বিশেষ প্রভাব ছিল। বাবার কাছ থেকেই ফাইনম্যান প্রচলিত চিন্তা-ভাবনাকে প্রশ্ন করতে শিখেছিলেন। মা লুসিলের থেকে পেয়েছিলেন রসবোধ যা তাঁর ব্যক্তিত্বের অননুকরণীয় একটি দিক ছিল।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৩৫ সালে ফাইনম্যান ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-তে (Massachusetts Institute of Technology) পড়তে চলে যান। প্রথমে তিনি অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও পরবর্তীকালে মত বদল করে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েন। কিন্তু সেটিও পছন্দ না হওয়ায় তিনি অবশেষে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। স্নাতক  হওয়ার আগেই তিনি দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যার মধ্যে একটি এখন পরিচিত ‘হেলম্যান ফাইনম্যান থিওরেম’ হিসেবে। ১৯৩৯ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ‘পুটনাম ফেলো’ (Putnam fellow) হিসেবে পরিচিত হন। সেই একই বছরে তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং অঙ্কে দুর্দান্ত নম্বর পান যার ফলে তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়া শুরু করেন। সেখানে অসাধারণ কর্মদক্ষতার জন্য একটি সেমিনারে নিজস্ব ভাবনা প্রকাশ করার সুযোগ পান তিনি। ফাইনম্যানের জীবনে প্রথম সেমিনারের  দর্শকদের মধ্যে ছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, উলফগ্যাং পাওলি এবং জন ভন নিউম্যান। ফাইনম্যানের বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে আইনস্টাইন বলেছিলেন , এই ভাবনাটি তিনি ‘জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি’ সমাধান করার কাজে লাগাতে পারেন এবং সেটি পরবর্তীকালে হয়েল নারলিকারের মাধ্যাকর্ষণ থিওরি (Hoyle-Narlikar theory of gravity) হিসেবে পরিচিত হয়। তিনি প্রিন্সটনে  ১৯৪০ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেন এবং ১৯৪২ সালে তিনি জন আর্চিবল্ড হুইলারের অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।। তাঁর প্রকাশিত গবেষণাপত্রটির নাম ছিল ‘প্রিন্সিপাল অফ লিস্ট একশন ইন কোয়ান্টাম মেকানিক্স'(The Principle of Least Action in Quantum Mechanics)। জন আর্চিবল্ড হুইলারের সাথে একত্রে আবিষ্কৃত ‘হুইলার ফাইনম্যান আ্যবজরবার থিওরি’টিকে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার আলোয় দেখার আশায় তাঁর ‘প্রিন্সিপাল অফ স্টেশনারি একশান’ তত্ত্বটিকে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার সমস্যা সমাধানে প্রয়োগ করেন। মূলত এখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ‘পাথ ইন্টিগ্রাল ফর্মুলা’ ও ‘ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম’-এর সূচনা করেন। প্রিন্সটনে থাকাকালীন তিনি ‘ম্যানহাটন প্রজেক্টে ‘ কাজ করতে শুরু করেন। প্রিন্সটন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়ার পর তিনি, তাঁর ছোটবেলার প্রেমিকা আরলিন গ্রীনবম (Arline Greenbaum) -কে বিয়ে করেন। আরলিন যক্ষ্মায় আক্রান্ত থাকার কারণে বিয়ের পর বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে ভর্তি থাকতেন এবং প্রতি সপ্তাহে ফাইনম্যান তাঁর সাথে দেখা করতে আসতেন।

১৯৪৩ সালে রবার্ট ওপেনহাইমার, পরমাণু বোমা তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে নিউ মেক্সিকোতে অত্যন্ত গোপনতার সাথে ‘লস আ্যলামস গবেষণাগার’ স্থাপন করেন। ফাইনম্যানের কাছেও এই কর্মসূচীতে যোগদান করার আমন্ত্রণ গিয়ে পৌঁছয়। ফাইনম্যানকে ওপেনহাইমার জানান যে তিনি নিউ মেক্সিকোর আলবুকার্কে তাঁর স্ত্রীয়ের জন্য স্বাস্থ্যনিবাসের ব্যবস্থা করেছেন। ফাইনম্যানকে এখানে হ্যান্স বেথের (Hans Bethe) অধীনে তাত্ত্বিক বিভাগের প্রধানের পদ দেওয়া হয়। যদিও এখানে ফাইনম্যান মূল বিভাগের কাজ করতেন না। তিনি  লস আ্যলামসের ‘ওয়াটার বয়লার’ (একটি ছোট নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর)- এর নিউট্রন ইকোয়েশনস সমাধান করতেন। এই কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি ওক রিজে চলে যান, যেখানে তিনি ইঞ্জিনিয়ারদের সুরক্ষা বিষয়ে পদ্ধতিগতভাবে  সাহায্য করতেন। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুন, আরলিনের মৃত্যু ঘটে এবং সেই খবর পেয়ে ফাইনম্যান তৎক্ষণাৎ তাঁর বন্ধু, ক্লাউজ ফুক্স-এর গাড়ি চালিয়ে আলবুকার্ক চলে যান। সেখান থেকে ফিরে আসার পর তিনি কাজের মধ্যে ডুবে যান এবং ট্রিনিটি নিউক্লিয়ার টেস্টে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি ওয়েল্ডারস লেন্স ছাড়াই আ্যটম বোমের বিস্ফোরণ প্রত্যক্ষ করেন।

১৯৪৪ সালের আগস্ট মাসে, হ্যান্স বেদ এবং রবার্ট ব্যেশরের সুপারিশে ফাইনম্যানকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করা হয় কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে।  তিনি ম্যানহাটন প্রজেক্ট ছেড়ে, ইথাকা, নিউ মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে রওনা হন, ১৯৪৫-এর অক্টোবর মাসে। ১৯৪৮ সালের পোকোনো কনফারেন্সে (Pocono Conference) তিনি প্রথমবার ‘ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম’-এর কথা উল্লেখ করেন। তখন থেকেই শিনিচিরো তোমোঙ্গা, জুলিয়ান স্যুইঙ্গার এবং ফাইনম্যান একসাথে কাজ করতে আরম্ভ করেন। ১৯৪৯ -এর গ্রীষ্মে তিনি ব্রাজিল ভ্রমণ করতে যান। রিওতে থাকাকালীন ফাইনম্যান সাম্বা এবং স্থানীয় সঙ্গীতের প্রতি প্রবল আকৃষ্ট হন। এইসময় তিনি চিত্রকলায় এবং তার সাথে ফ্রীজিডেইরা (frigideira), বঙ্গো (bongo) এবং কঙ্গা (conga) ড্রাম বাজাতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ফাইনম্যান এরপর আর কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে ফেরত যাননি। রিওতে থাকাকালীন ফাইনম্যান ‘ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’-তে (ক্যালটেক) মাঝে মাঝে পড়াতে যেতেন। ১৯৫১ সালে ব্যেশরের সুপারিশে তিনি ‘ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’-তে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং অবসরপ্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি এখানেই অধ্যাপনা করেন।

১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রিচার্ড ফাইনম্যান কে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে ‘আ্যটমস ফর পিস কনফারেন্সে’ পাঠানো হয়। উনি ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটার’ তৈরীর ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। কর্মরত থাকাকালীন ৩১ জন ছাত্র-ছাত্রীর ডক্টরাল আ্যডভাইজার ছিলেন তিনি। ফাইনম্যান ইউরেনিয়াম-২৩৫ এবং ইউরেনিয়াম-২৩৮ আলাদা করার পদ্ধতি নিয়েও গবেষণা করেছেন। ১৯৬০-এর দশকে ফাইনম্যান অডিও টেপে নিজের জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় রেকর্ড করে রালফ ল্যিগটনকে পাঠান, যেগুলির সাহায্য নিয়ে তিনি ফাইনম্যানের আত্মজীবনীমূলক একটি বই লেখেন, যার নাম দেওয়া হয়- ‘সিওরলি ইউ আর জোকিং  মিস্টার ফাইনম্যান!’। বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৬৫ সালে ফাইনম্যান, শিনিচিরো তোমোঙ্গা ও জুলিয়ান স্যুইঙ্গার একত্রে পদার্থবিজ্ঞানের ‘নোবেল প্রাইজ’ পান তাঁদের ‘কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকস’-এর ওপর অসাধারণ কীর্তির জন্য।  ক্যালটেকে দেওয়া ফাইনম্যানের সমস্ত লেকচার পরবর্তীকালে ‘দ্য ফাইনম্যান লেকচারস’ নামক বইতে  মুদ্রিত হয় যা বিজ্ঞান মহলে বর্তমানে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ফাইনম্যান ‘আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি’, ‘দ্য আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য আডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স’ এবং ‘ন্যাশনাল অ্যাক্যাডেমি অফ সায়েন্সে’র  সদস্য ছিলেন। ১৯৬৫ সালে তিনি লন্ডনের ‘রয়্যাল সোসাইটি’তে এক বিদেশি সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। এমনকি নাসার(NASA) ‘স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার’ দুর্ঘটনার তদন্তের কাজেও তিনি যোগদান করেন এবং সারা বিশ্বকে চমকে দেন ‘O- rings’ -এর ত্রুটি খুঁজে বার করে।

১৯৭৮ সালে তাঁর লাইপোসারকোমা (এক বিরল ধরনের ক্যান্সার) ধরা পড়ে। ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, ৬৯ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র


  1. Feynman, Richard P. (1985). Ralph Leighton (ed.). Surely You're Joking, Mr. Feynman!: Adventures of a Curious Character. W. W. Norton & Co. ISBN 0-393-01921-7. OCLC 10925248.
  2. https://www.nobelprize.org/prizes/physics/1965/feynman/biographical/
  3. https://en.wikipedia.org/wiki/Richard_Feynman
  4. http://www.atomicarchive.com/Bios/Feynman.shtml

3 comments

আপনার মতামত জানান