রবীন ঘোষ

রবীন ঘোষ

বিশ্বসঙ্গীতের ভান্ডার কালে কালে বহু গুণী সঙ্গীতসাধকের অকৃপণ অবদানে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। তেমনই একজন প্রথিতযশা বাঙালি খ্রিস্টান সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরকার হলেন রবীন ঘোষ (Robin Ghosh)। বিখ্যাত প্লেব্যাক গায়ক আহমেদ রুশদি এবং তাঁর জুটি অসাধারণ সব সফল গান উপহার দিয়েছিল শ্রোতাদের। পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগতের এক অন্যতম নাম হল রবীন ঘোষ। কেউ কেউ তাঁকে আর.ডি বর্মনের সঙ্গে তুলনা করেন কেউ আবার বলেন ‘পাকিস্তানের নওশাদ’। তবে পশ্চিবঙ্গ বা ভারতের চলচ্চিত্র জগত তাঁর সঙ্গীতের মূর্ছনা থেকে বঞ্চিত থেকে গেছে।

১৯৩৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ইরাকের প্রাচীন বাগদাদ শহরে এক শিক্ষিত পরিবারে রবীন ঘোষের জন্ম হয়। তাঁর বাবা এস এম ঘোষ একজন বাঙালি হিন্দু ছিলেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রসে কাজ করতেন। রবীনের মা আসনাত জিয়া ঘোষ ছিলেন একজন আরবীয় ক্যাথলিক খ্রিস্টান। 

রবীনের ছোটবেলাতেই তাঁর বাবা সংসারের সমস্ত দায়িত্ব স্ত্রী আসনাতের  উপর চাপিয়ে পরিবার ত্যাগ করে অন্য এক মহিলাকে বিবাহ করেন। এরপর রবীনের মা একার দক্ষতায় সংসার চালিয়ে রবীনকে বড় করে তোলেন। রবীন ঘোষের  ভাই অশোক ঘোষ পরবর্তীকালে বাংলাদেশের একজন সফল চলচ্চিত্র পরিচালক হয়েছিলেন। রবীন ঘোষের স্ত্রীয়ের নাম শবনম। তাঁদের একটিই পুত্র সন্তান, নাম রনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ছয় বছর বয়সী রবীন তাঁর পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন অবিভক্ত ভারতের ঢাকা শহরে। সেখানে মায়ের অভিভাবকত্বে ক্রমে বড় হয়ে ওঠেন রবীন। গানের প্রতি ছোট থেকেই অদম্য উৎসাহ ছিল তাঁর। খুব অল্প বয়স থেকেই কে এল সায়গলের ৭৮ আরপিএম গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করতে শুরু করেছিলেন তিনি। হারমোনিয়াম বাজানোও শিখেছিলেন কম বয়সেই।

বাগদাদে থাকার সময় অল্প বয়সী রবীন সেখানকার কনভেন্ট স্কুলে তাঁর প্রাথমিক পড়াশুনা শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে সঙ্গীতকে এতই ভালোবেসেছিলেন এবং আঁকড়ে ধরেছিলেন যে, সঙ্গীত সংক্রান্ত পড়াশুনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। শেষ পর্যন্ত ঢাকার সেগুনবাগিচার  সংগীত কলেজ থেকে সঙ্গীত নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন রবীন। পড়াশুনা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ১৯৫০-এর দশকের শেষদিকে রবীনের এক বন্ধু তাঁকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে চাকরির প্রস্তাব দেন। এই বেতার কেন্দ্রে শামসুদ্দিন আবুল কালাম সহ বহু নামজাদা মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকতো। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে সেই বেতার কেন্দ্রে চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম একবার পরিদর্শনে আসেন এবং  সেখানেই পরিচয় হয় তাঁর রবীন ঘোষের সঙ্গে। এরপরই ১৯৬০ সালে এহতেশামের ‘রাজধানীর বুকে’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ পান রবীন। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে এই তাঁর আত্মপ্রকাশ। এরপর একে একে ‘চন্দা’, ‘তালাশ’, ‘পয়সা’, ‘চকোরি’র মতো পাকিস্তানের  জনপ্রিয় সিনেমাগুলি ছাড়াও আরও নানান উর্দু ও বাংলা ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করেন রবীন। তবে চকোরি সিনেমার সঙ্গীতের কাজ করে তাঁর পরিচিতির সীমা বেড়ে গিয়েছিল অনেকটাই। সেই সিনেমার ‘জাঁহা তুম উঁহা হাম’ গানটির সুর করেছিলেন রবীন এবং গেয়েছিলেন পাকিস্তানের বিখ্যাত গায়ক আহমেদ রুশদি৷ তাঁদের এই জুটি দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল গোটা দেশে৷ 

প্রায় একশোটিরও বেশি পাকিস্তানি চলচ্চিত্রে সুর দিয়েছিলেন রবীন। তাঁর করা সুরে গান গেয়েছিলেন ফিরদৌসী রহমান, মাহমুদুন নবী, আব্দুল জব্বার, তালাত মাহমুদ সহ বিখ্যাত সব সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর গানের জন্যেই অসংখ্য পাকিস্তানি সিনেমা সুপারহিট হয়েছিল। ১৯৬১ থেকে ১৯৮৬ সাল, এই পঁচিশ বছর পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে বিচরণ করেছিলেন তিনি।

১৯৬৮ সালে ‘তুম মেরে হো’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান রবীন ঘোষ। সেখানে উর্দু ছবিতে সঙ্গীত পরিচালকের কাজ করতে থাকেন তিনি। ১৯৭৭ সালে তিনি ‘আইনা’ নামের ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এই সিনেমাটি  পাকিস্তানের প্রথম প্ল্যাটিনাম জুবিলি সিনেমার তকমা পায়। কেউ কেউ ছবিটিকে পাকিস্তানের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রও বলে থাকেন। 

শরাফত ছবির ‘যাও তুমহে পেহচান লিয়ে’, কিংবা ফিরদৌসী বেগমের কণ্ঠে ‘মৌত কো দিন দো সাদা’, জঞ্জির ছবির ‘গুলবাহার, ম্যায় হুঁ গুলবাহার’, ‘আইনা’ ছবিতে মেহেদী হাসানের কন্ঠে ‘মুঝে দিল সে না ভুলানা’ এবং ‘ওয়াদা করো সাজনা’র জনপ্রিয়তা আজও একইরকম অম্লান রয়ে গেছে। এছাড়াও কয়েকটি উর্দু ছবির গান যেগুলি ভীষণই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যেমন – কাভি তো তুমকো ইয়াদ আয়েগি’, ‘হামে খোওকার বহত পচতাওগে’, ‘সাওন আয়ে’, ‘পেয়ার ভারে দো শর্মিলে নয়ন’, ‘দেখো ইয়ে কোন আগায়া’, ‘মিলে দো সাথী’, ‘সোনা না চান্দি না কোই মহল’ ইত্যাদি। তবে পাকিস্তানি ও উর্দু সিনেমার চাপে বাংলা ছবিতে খুব বেশি কাজ করা হয়নি রবীনের৷ তবুও যেটুকু করেছেন তার মধ্যেও নিজের স্বাক্ষর রেখে দিয়েছেন। আপোষ (১৯৮৭) সিনেমায় ‘ও আমার প্রাণের সুজন’ কিংবা হারানো দিন চলচ্চিত্রের ‘আমি রূপ নগরের রাজকন্যা’ বা নাচের পুতুল ছবির ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ ইত্যাদি বাংলা গান বাংলাদেশে আজও বিখ্যাত৷

আশির দশকে সস্ত্রীক রবীন ঘোষের করাচি থেকে বাংলাদেশের যাতায়াত লেগেই থাকতো। ঢাকাতে এসেই বেশ কয়েকটি বাংলা চলচ্চিত্রের গানে সুরারোপ করেন তিনি৷ ১৯৯২ সালে বাংলা ছবি ‘আমার সংসার’-এ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে শেষ কাজ করেছিলেন। ১৯৯৮ সালে স্থায়ীভাবে রবীন স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে আসেন ঢাকায়।

ভারতবর্ষের যেমন ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পাকিস্তানের তেমনি নিগার অ্যাওয়ার্ড। শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে মোট ছয়বার এই নিগার পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে ‘তালাশ’ সিনেমার জন্য রবীন প্রথম নিগার পুরস্কার জিতেছিলেন।

২০১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি অসুস্থ হয়ে রবীন ভর্তি হন হাসপাতালে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া এবং হৃদরোগে ভুগছিলেন। অবশেষে ২০১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৭৬ বছর বয়সে ঢাকায় গুলশানের কিওর মেডিক্যাল সেন্টারে কিংবদন্তি সুরকার রবীন ঘোষের মৃত্যু হয়।

One comment

আপনার মতামত জানান