সর্বমঙ্গলা

সর্বমঙ্গলা মন্দির

বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দিরটি ১৭০২ সালে মহারাজা কীর্তিচাঁদ দ্বারা নির্মিত একটি প্রাচীন মন্দির। এটি একটি দুর্গা মন্দির। এখানে দেবী সর্বমঙ্গলা আসলে মা দুর্গা। এখানে মা দুর্গা অষ্টাদশভুজা। এটিই অবিভক্ত বাংলায় প্রথম নবরত্ন স্থাপত্য রীতিতে তৈরী করা মন্দির। বাংলায় এই মন্দির কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর, তারকেশ্বর এবং তারাপীঠ এর মতো সমান জনপ্রিয় । প্রতিদিন প্রায় শত শত ভক্ত আসে এখানে।

এই মন্দিরটিকে অনেকে ৫১ সতীপীঠের একটি বলে মনে করেন। সেই মতে এখানে দেবীর নাভি পরেছিল।এখানে দেবী হলেন সর্বমঙ্গলা ও ভৈরব মহাদেব।

প্রচলিত কাহিনী অনুসারে বর্ধমানের বাইরে সর্বমঙ্গলা অঞ্চলে কিছু জেলে-মাঝিদের জালে একসময় একটি অদ্ভূত দর্শন পাথর উঠে আসে। কিছুটা শিলার মত দেখতে এইরকম পাথর দিয়েই তখনকার দিনে থেঁতো করা হত গুগলি, শামুক। সেটিকে পাথর ভেবেই তার উপরে শামুক–গুগলি থেঁতো করত তারা। সেই শিলা যে আদতে মূর্তি, বুঝতে পারেন স্থানীয় এক পুরোহিত। কাহিনী অনুসারে সেই সময় দামোদর নদ লাগোয়া চুন তৈরির কারখানার জন্য শামুকের খোলা নেওয়ার সময় শিলামূর্তিটি চলে যায় চুন ভাটায়। তখন শামুকের খোলের সঙ্গে শিলামূর্তিটি পোড়ানো হলেও মূর্তির কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে সেই রাতে স্বপ্নাদেশ পাওয়া মাত্র বর্ধমানের তৎকালীন রাজা শিলামূর্তিটিকে নিয়ে এসে সর্বমঙ্গলা নামে পুজো শুরু করেন। মতান্তরে নবরত্ন মন্দির তৈরি করে সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন বর্ধমানের রাজা চিত্রসেন।

ঐতিহাসিক মতে বর্ধমানের মহারাজা শ্রী কীর্তিচাঁদ, ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটি নির্মাণ করান। কিন্তু এই মন্দিরে থাকা মাতা সর্বমঙ্গলার মূর্তিটি মন্দিরের থেকেও বেশি প্রাচীন, অনেকের মতে ১০০০ বছর পুরোনো, আবার কারো মতে ২০০০ বছর পুরনো। মনে করা হয় মূর্তিটি এখানে আগে থেকেই ছিল, এবং পরে মন্দিরটি নির্মিত হয়। এই মূর্তিটি হল কষ্টিপাথরের অষ্টাদশভূজা সিংহবাহিনী ‘মহিষমর্দিনী’। দৈর্ঘ্যে বারো ইঞ্চি, প্রস্থে আট ইঞ্চি। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হবার পরে, বর্ধমানের তৎকালীন মহারাজা স্যার উদয় চাঁদ ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে, তাদের হাতে এই প্রাচীন মন্দিরটি পরিচালনার দায়িত্ব দেন ও তার পর থেকে এখনো পর্যন্ত সেই ট্রাস্টি বোর্ডই এই মন্দিরের দেখাশোনা করে চলেছে।

মন্দিরের কাঠামোটি প্রাচীন টেরাকোটা ধাঁচে তৈরী করা এবং সেই সময়ে মন্দিরের স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। স্থাপত্যের দিক থেকে এই মন্দির গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি বাংলার প্রথম নবরত্ন ধাঁচে তৈরী করা মন্দির। অন্য বিখ্যাত নবরত্ন ধাঁচের মন্দির হল দক্ষিণেশ্বর। মূল মন্দির তৈরী করার পর তার আশেপাশে গড়ে ওঠে নাট মন্দির, শ্বেত পাথরের তৈরি রামেশ্বর ও বাণেশ্বর নামে দুটি শিব মন্দির। কালো পাথরে তৈরি হয় মিত্রেশ্বর, চন্দ্রশ্বর ও ইন্দ্রেশ্বর নামে আরও তিনটি শিব মন্দির।

দুর্গাপূজার সময় এই মন্দির উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে। নবমীর দিন কুমারী পূজা এখানের ঐতিহ্য। দশমীতে অপরাজিতা পুজোর মধ্যে দিয়ে উৎসব শেষ। এছাড়াও পয়লা বৈশাখ, বিপত্তারিনী পূজা, কালী পূজাশিবরাত্রি পূজায় এখানে প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে। সর্বমঙ্গলা মাতা স্থানীয় সমস্ত মানুষের কাছে পূজিতা দেবী। শুধু বর্ধমান জেলাতেই না, পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত কোণ থেকেও লোকেরা এখানে পূজা অর্পণ করতে আসে। এটি এই রাজ্যের একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসাবেও পরিণত হয়েছে।

আপনার মতামত জানান