বাংলা শিশু-সাহিত্যের জগতে এক স্বনামধন্য জনপ্রিয় লেখক সুনির্মল বসু (Sunirmal Basu)। রবীন্দ্রোত্তর যুগের বাংলা সাহিত্যে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, যতীন্দ্রমোহন বাগচী প্রমুখদের পরবর্তী পর্যায়ে এক বিপুল প্রতিভা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন সুনির্মল বসু। শিশুদের জন্য ছড়া, কবিতা, নাটক এমনকি গল্প-উপন্যাস সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। প্রায় একশোটিরও বেশি কবিতা ও ছড়ার বই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর। ‘ছানাবড়া’, ‘বেড়ে মজা’, ‘হৈ চৈ’, ‘হুলুস্থুল’, ‘কথা শেষ’, ‘হাসির দেশে’, ‘পাততাড়ি’ ইত্যাদি তাঁর লেখা বিখ্যাত সব ছড়ার বই।
১৯০২ সালের ২০ জুলাই গিরিডির মকতপুর অঞ্চলে মামার বাড়িতে সুনির্মল বসুর জন্ম হয়। তাঁর বাবা পশুপতি বসু পেশায় ছিলেন শিক্ষক এবং তাঁর ঠাকুরদাদা গিরিশচন্দ্র বসু ঠাকুর ছিলেন সেকালের ঢাকা জেলার মালখা নগরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ দারোগা। ডাকাত ধরার দুর্ধর্ষ অভিজ্ঞতা অবলম্বনে তিনি পরবর্তীকালে ‘সেকালের দারোগার কাহিনি’ নামে একটি বইও লিখেছিলেন। অন্যদিকে তাঁর দাদু মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা ছিলেন দেশসেবক, রাজনৈতিক নেতা, সুবক্তা এবং সুলেখক। তিনি ‘নবশক্তি’, ‘বিজয়া’ ইত্যাদি বহু পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, ব্রিটিশের বিরাগভাজন হয়ে ব্রহ্মদেশে বেশ কিছুদিন কারাবাসও করেছিলেন তিনি। সুনির্মল বসুর বাবা প্রথম জীবনে শিক্ষকতা করলেও পরে তিনি স্বাধীনভাবে অভ্র ব্যবসায় নেমে পড়েন। গিরিডিতে যে স্কুলে পড়াতেন তাঁর বাবা সেখানকার ছাত্র ছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কুলদারঞ্জন প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। ছোটবেলা থেকেই মামার বাড়িতে বহু বই-পত্র, পত্রিকা পড়ার সুযোগ ঘটেছিল তাঁর। সেই সুবাদে কৈশোরে সুনির্মল শর্ম্মা ছদ্মনামে কবিতা লেখাও শুরু করেন তিনি। ‘অবকাশরঞ্জন’, ‘অমৃত’, ‘আশা’ ইত্যাদি নানা সময়ে নানাবিধ হাতে-লেখা পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন সুনির্মল। কৈশোরে ছবিও আঁকতেন তিনি। পরবর্তীকালে নীহারিকা দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয় সুনির্মল বসুর।
মনে করা হয় আট বছর বয়সের আগে সুনির্মল বসু স্কুলে ভর্তি হননি। অর্থাৎ মোটামুটিভাবে ১৯১০ সালের পর থেকেই স্কুলের প্রথাগত পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। গিরিডিতে ব্রাহ্মপণ্ডিত বামনদাস মজুমদারের তৈরি স্কুলে বেশ কিছুদিন পড়াশোনা করেছেন সুনির্মল বসু এবং তারপর ১৯১৬ সালে তিনি ভর্তি হন গিরিডি হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে। বামনদাস মজুমদারের স্কুলে পড়াকালীন বামনদাসবাবুর সঙ্গে প্রায়ই সব ছাত্র মিলে উশ্রী নদীর ধারে বেড়াতে যেতেন। এর পাশাপাশি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট’-এ ভর্তি হয়ে ছবি আঁকা শিখছিলেন তিনি। পরে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সেন্ট পলস কলেজে পড়তে আসেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে তিনিও প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পরে চারজন বন্ধু মিলে তাঁরা প্রকাশ করেন ‘আশা’ পত্রিকা এবং এই পত্রিকার পরিচালন সমিতিতে ছিলেন সুনির্মল বসু, বসন্তকুমার দত্ত, অজিতকুমার নাগ এবং সুশীলকুমার মিত্র। মজার বিষয় এই চারজনের পদবির আদ্যক্ষর দিয়ে পরিচালন সমিতির নাম রাখা হয় ‘বদনামি’। গিরিডির বাসিন্দাদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই পত্রিকা। কিন্তু এরই মাঝে গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে পড়াশোনায় চিরকালের মত ছেদ পড়ে তাঁর। কলেজে পড়ার আগে আগে মামারবাড়িতে থাকার সময় ‘শিশু’ ও ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত নামী-দামী লেখকদের লেখা পড়ে সাহিত্যচর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। একবার ‘সন্দেশ’ পত্রিকার ধাঁধার উত্তর পাঠিয়ে পত্রিকার পাতায় সঠিক উত্তরদাতা হিসেবে তাঁর নাম ছাপা হয়েছিল। সেখান থেকে আরও উৎসাহ পেয়ে একবার কবিতা লিখে গোপনে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়, কিন্তু সেই কবিতা ছাপা হয়নি। তারপরে গিরিডিতেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সঙ্গে দাদামশাইয়ের সূত্রে তাঁর ঘনিষ্ঠ আলাপ জমে ওঠে। শুধু তিনিই নন, গিরিডিতে থাকাকালীন বহু গণ্য-মান্য বাঙালি কৃতী ব্যক্তিদের আনাগোনা লেগেই থাকত তাঁদের বাড়িতে। সেখানেই প্রিয়নাথ বসুর সার্কাস, গোবর গুহ-র কুস্তিচর্চা এমনকি বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ কৃষ্ণচন্দ্র দে’র সঙ্গীত শোনার দুর্লভ অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। গিরিডিতে থাকার সময় তাঁর জীবনের এই বাঁধনহারা দিকটির পাশাপাশি পড়াশোনার ক্ষেত্রে এক কঠোর নিয়মানুবর্তিতাও ছিল। তাঁর দিদি অমিয়া বসু এবং তিনি একত্রে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তেন। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কবিতার খাতায় সেই সময় ‘কবীরের জন্ম’, ‘রাণী ও সারিকা’ এবং ‘ভক্ত প্রহ্লাদ’ নামে বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলেন সুনির্মল বসু। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলে সেই উপলক্ষ্যেও তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন বলে জানা যায়। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকে নক্ষত্র রায় চরিত্রে এবং ‘ডাকঘর’ নাটকে কবিরাজ চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি। অবন ঠাকুরের কাছে ছবি আঁকা শেখার সময়েই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বিখ্যাত শিশু-সাহিত্যিক স্বপনবুড়ো ওরফে অখিল নিয়োগীর। ১৯২৩ সালে ‘কল্লোল’ পত্রিকা প্রকাশিত হলে অখিল নিয়োগী এবং সুনির্মল বসু একত্রে তার দপ্তরে নিয়মিত যেতেন বিভিন্ন গণ্যমান্য সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আশায়। পরে কালি-কলম পত্রিকার দপ্তরেও ‘বারবেলার বৈঠক’-এর নিয়মিত সদস্য ছিলেন তাঁরা। তাছাড়া ‘মুকুল’ পত্রিকার অফিস কিংবা ‘দেব সাহিত্য কুটীর’-এর দপ্তরে নিত্য যাতায়াত ছিল তাঁর। ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকার পক্ষ থেকে ‘মণিমেলার আসর’ এবং ‘যুগান্তর’ পত্রিকার পক্ষ থেকে ‘সব পেয়েছির আসর’-এর কারণেই সুনির্মল বসু সমস্ত বাংলায় সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। মণিমেলার আসরের প্রতিটি সভায় সভাপতিত্ব করতেন সুনির্মল। অন্যদিকে অখিল নিয়োগীর সঙ্গে প্রতি বছর শোভাবাজার দেব বাড়ির ঠাকুরদালানে ‘সব পেয়েছির আসর’-এর বার্ষিক সভা আয়োজন করতেন সুনির্মল বসু।
কোনওদিন প্রথাগত চাকরি করেননি তিনি। লিখেই জীবিকা নির্বাহ করে গিয়েছেন অতি কষ্টে। নিত্য অভাবের সংসারেও স্ত্রীর সাহচর্যে নিশ্চিন্তে লেখালিখি করে গিয়েছেন তিনি। বড় হয়ে কলেজের পড়াশোনায় ছেদ ঘটার পরে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে তাঁর লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হাওয়ার দোলা’ প্রকাশিত হয়। এরপরে একে একে প্রায় একশোটিরও বেশি কবিতা ও ছড়ার বই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর। সুনির্মল বসুর লেখা বিখ্যাত সব কাব্যগ্রন্থ ও ছড়ার বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘ছানাবড়া’, ‘বেড়ে মজা’, ‘হৈ চৈ’, ‘হুলুস্থুল’, ‘কথা শেষ’, ‘হাসির দেশে’, ‘পাততাড়ি’, ‘বীর শিকারি’, ‘কবিতা শেখা’, ‘আমার ছড়া’, ‘টুনটুনির গান’, ‘রঙিন দেশের রূপকথা’, ‘পাতার ভেঁপু’, ‘জানোয়ারের ছড়া’ ইত্যাদি। তাঁরই সম্পাদনায় একসময় প্রকাশিত হত ছোটদের পাক্ষিক পত্রিকা ‘কিশোর এশিয়া’। শুধু ছড়া বা কবিতাই নয়, শিশু-কিশোরদের উপযোগী বহু গল্প, উপন্যাস, নাটিকা ও জীবনী লিখেছেন তিনি। সুনির্মল বসুর ‘আলোর মৌচাক’, ‘শামিয়ানা’, ‘হাবুবীর’, ‘অবাক কাণ্ড’, ‘বঙ্কু খুড়ো’, ‘আজগুবিপুর’, ‘বন্দেমাতরম’ ইত্যাদি ছড়াগুলি আজও বাঙালির স্মৃতিতে অমলিন। তাছাড়া ‘বিধির বিধান’, ‘মোহনকুমার’, ‘বিড়াল রাজকন্যা’, ‘দুই রাজকুমার’, ‘সওদাগরের ছেলে’ ইত্যাদি রূপকথার গল্পও লিখেছেন তিনি। ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, বাঘাযতীন, কানাইলাল দত্ত প্রমুখ বাংলার বীর বিপ্লবীদের নিয়ে নানা সময় শিশুতোষ ছড়া লিখেছেন সুনির্মল বসু। নিজের ছোট মেয়ে তারাসুন্দরীকে উৎসর্গ করে ‘কেবল হাসির দেশে’ ছড়ার বইটি উপহার দেন তাঁকে। ‘ইন্টিবিন্টির আসর’, ‘সিঙ্গি বাবা’, ‘ভোম্বল দাস’, ‘সেয়ানে সেয়ানে’, ‘অকেজো ঘোড়ার কীর্তি’, ‘হারুসর্দারের বাঘ শিকার’, ‘গাট্টা তেওয়ারী’ ইত্যাদি তাঁর লেখা। ১৯৩১ সালে গিরিজাপ্রসাদ বসুর সাহচর্যে তিনি ‘ছোটদের চয়নিকা’ নামে একটি কবিতা সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন। এছাড়া ‘আরতি’ নামে একটি শিশু-বার্ষিকীও সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। ছোটদের জন্য তাঁর লেখা ‘ছড়ার ছবি’ বইটি ১৯৫১ সালে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর বেশিরভাগ বইই প্রকাশিত হয়েছে শিশু সাহিত্য সংসদ থেকে। ছোটদের মনে ছন্দের বোধ জাগিয়ে তুলতে তিনি লিখেছিলেন ‘ছন্দ ঝুমঝুমি’, ‘ছন্দের গোপন কথা’ এবং ‘ছন্দের টুংটাং’ ইত্যাদি বইগুলি। বহু রোমাঞ্চকর গল্পও লিখেছিলেন সুনির্মল বসু যার মধ্যে অন্যতম হল ‘মরণের ডাক’, ‘কেউটের ছোবল’, ‘মরণের মুখে’, ‘মরণফাঁদ’ ইত্যাদি। ‘আনন্দনাড়ু’, ‘বুদ্ধভুতুম’ ইত্যাদি নামে কয়েকটি নাটকও লিখেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে ‘লোকসেবক’ পত্রিকার ‘সবুজপাতা’ নামে ছোটদের বিভাগে তিনি বহু লেখা লিখেছেন যার মধ্যে অন্যতম হল ‘জীবনখাতার কয়েক পাতা’ নামে একটি সুপাঠ্য ধারাবাহিক রচনা।
শিশুসাহিত্যের জগতে অনন্য সাহিত্যকর্মের জন্য সুনির্মল বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ভুবনেশ্বরী পদকে ভূষিত হন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম মরণোত্তর বিদ্যাসাগর পুরস্কার পান তিনি। ১৯৪৯ সালে দিল্লিতে আয়োজিত প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের শিশুসাহিত্য শাখায় সভাপতিত্ব করেছিলেন সুনির্মল বসু।
১৯৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সুনির্মল বসুর মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
- অমিতাভ গঙ্গোপাধ্যায়, 'শিশুসাহিত্যের জাদুকর সুনির্মল বসু', নিবোধত, ৩১ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, নভেম্বর-ডিসেম্বর, ২০১৭, পৃষ্ঠা ৪৬৩-৪৬৮
- https://shodhganga.inflibnet.ac.in/
- http://www.srishtisandhan.com/
- https://fulkibaz.com/