আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, চলতে ফিরতে হাঁটতে শারীরিক কসরৎ করতে বা নিছকই কোনো প্রয়োজনীয় কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ করে অনেক সময় অসাবধানতাবশত আঘাত লেগে যায়। আঘাত লাগার সাথে সাথেই বা তার একটু পরেই আমরা দেখি সেই জায়গাটা ফুলতে শুরু করে। আঘাতের তীব্রতার ভিত্তিতে ফোলার পরিমাণ কম বা বেশি হয়। এখন মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে শরীরে কোথাও আঘাত লাগলে ফুলে যায় কেন?
ফুলে যাওয়ার অর্থ হল শরীরের ওই বিশেষ অংশের আকার বা আয়তন আগের তুলনায় বেড়ে যাওয়া বা পরিবর্তিত হওয়া ডাক্তারি পরিভাষায় একে ইডিমা (edema) বলে।ফুলে যাওয়া অংশটি গরম ও লালচে হয়ে যায়।নানারকম রাসায়নিক বস্তু নির্গত হতে শুরু করে, স্নায়ু (Nerve) অনেক সময় চেপে গিয়ে প্রদাহ শুরু হয়। এখানে আমরা জেনে নেবো শরীরে কোথাও আঘাত লাগলে ফুলে যায় কেন।
কোনও জায়গায় আঘাত লাগলে ফুলে যাওয়া হল এক ধরনের প্রদাহজনীত প্রতিক্রিয়া বা ইনফ্লেমেটরি রিঅ্যাকশন (Inflamatory Reaction)। এই প্রতিক্রিয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হল- ওই অংশে অবস্থিত কলার (Tissue) ক্ষতিগ্রস্ত কোষ (Damaged Cell) এবং সংশ্লিষ্ট অংশগুলিকে দ্রুত সরিয়ে ফেলে শরীরকে সুস্থ করা।
আমাদের শরীরের একটি নিজস্ব “ইমিউন সিস্টেম” (Immune System) বা রোগ প্রতিরোধক তন্ত্র আছে। মানবদেহে ইমিউন সিস্টেম হল দেহের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেটি শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক যে কোনো পদার্থ যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, রাসায়নিক পদার্থ বা আঘাতজনিত অবস্থা থেকে দেহকে রক্ষা করে, দেহে রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ায় অর্থাৎ দেহকে ইমিউনিটি (Immunity) শক্তি প্রদান করে। ইমিউনিটি হল দেহ প্রতিরক্ষার জন্য একটি প্রাকৃতিক উপায়। শ্বেত রক্তকণিকা বা লিউকোসাইট (Leucocyte) হল ইমিউন সিস্টেমের প্রধান কোষ। শ্বেত রক্তকণিকা (White Blood Cell) বা WBC এক অতন্দ্র প্রহরীর মতো আমাদের শরীরকে পাহারা দেয়। এরা যেকোনো ধরণের সংক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করে। মানবদেহে প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে শ্বেত রক্ত কণিকার সংখ্যা প্রায় ৫০০০-৯০০০।
এবার আমরা জেনে নেবো কীভাবে আমাদের ইমিউন সিস্টেমটি কাজ করা শুরু করে ফুলে যাওয়া অংশটির ওপর। এই পদ্ধতির প্রথম ধাপটি হল ক্ষতিগ্রস্ত স্থানের রক্ত প্রবাহের মাত্রা প্রচন্ড বেড়ে যাওয়া। রক্তবাহী নালীগুলি ক্রমশ প্রসারিত (Dialated) হতে থাকে ও কলার মধ্যে রক্ত প্রবাহের মাত্রা বাড়ে ও ক্ষতিগ্রস্ত স্থানটি লাল হয়ে যায়। এর পর হিস্টামিন (Histamin) নামের একধরণের প্রোটিনের উপস্থিতিতে রক্তবাহী নালিকাগুলির ভেদ্যতা (Permeability) বাড়ে। এই নালিকাগুলি তখন রক্তরস (Plasma), প্রোটিন এবং শ্বেতরক্ত কণিকাগুলিকে সংবহন তন্ত্র (Circulatory System) থেকে ক্ষতিগ্রস্ত (Damaged) কলায় চালিত করে। রক্তরস, কোষ এবং অন্যান্য বস্তুগুলির প্রভূত পরিমানে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে প্রবাহের কারণে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানটি ফুলে যায়। আঘাতপ্রাপ্ত স্থানটি ফুলে গিয়ে মাঝে মাঝে এমন মারাত্মক আকার নেয় যে ওই অংশটি নড়ানো যায় না।
শ্বেত রক্তকণিকা বিশেষত ফ্যাগোসাইট এরপর ফোলা অংশের ক্ষতিগ্রস্ত কলার ওপর কাজ শুরু করে। ফ্যাগোসাইট আঘাতপ্রাপ্ত স্থানের মৃত কোষগুলিকে ফ্যাগোসাইটোসিস (Phagocytosis) পদ্ধতিতে খেয়ে ফেলে মানে ধ্বংস করে। নিউট্রোফিল নামক বিশেষ ফ্যাগোসাইটটি একধরনের পাচক উৎসেচক নিঃসৃত করে এই কাজে সাহায্য করে। আঘাতপ্রাপ্তির ঘন্টা খানেকের মধ্যে প্রচুর পরিমান নিউট্রোফিলের অনুপ্রবেশ ঘটে আঘাতস্থলে। দুই থেকে তিন দিন পরে মনোসাইট নামের অন্য আর এক শ্বেত রক্তকণিকা ওই স্থানে প্রবেশ করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত মৃত কোষগুলিকে (Cellular Debris) অপসারিত করে। শ্বেত রক্তকণিকার উপস্থিতিতে ও বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরের ঠিক হয়ে যাওয়া এবং ফোলা ভাব কমে যাওয়ার পদ্ধতিকে হোমিওস্টাসিস (Homeostasis) বলে।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম শরীরে কোথাও আঘাত লাগলে ফুলে যায় কেন। আঘাতপ্রাপ্ত স্থান ফুলে গেলে ও তার থেকে অবধারিত ভাবে যন্ত্রণা শুরু হলে আমরা বাধ্য হই বিশ্রাম নিতে। এই বিশ্রাম আমাদের আরও আঘাত পাওয়া থেকে বাঁচায়। আর পূর্বের আঘাত যদি খুব মারাত্মক না হয় তাহলে শরীরের ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতায় তা নিজে থেকেই কয়েকদিনের মধ্যে সেরেও যায়।
তথ্যসূত্র
- https://www.britannica.com/
- https://www.medicalnewstoday.com/
- https://www.betterhealth.vic.gov.au/
- https://en.m.wikipedia.org/
