প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশে কিছু দিবস পালিত হয়। ওই নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। পালনীয় সেই সমস্ত দিবস গুলির মধ্যে একটি হল বিশ্ব সুনামি সচেতনতা দিবস (World Tsunami Awareness Day)।
বিশ্ব জুড়ে প্রতি বছর ৫ নভেম্বর বিশ্ব সুনামি সচেতনতা দিবস উদযাপন করা হয়। বিশ্ব জুড়ে মানুষের মধ্যে বিশেষত উপকূলবর্তী অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে সুনামি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করবার উদ্দেশ্যেই বিশ্ব সুনামি সচেতনতা দিবস পালন করা হয়।
সুনামি একটি জাপানি শব্দ, যার অর্থ সামুদ্রিক তরঙ্গ। একেরপর পর এক বৃহদায়তন তরঙ্গের ফলে যে প্রবল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সংঘঠিত হয় তাকেই সুনামি নামে অভিহিত করা হয়। যাবতীয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলির মধ্যে সুনামি বিরল ঘটনা হলেও এই দুর্যোগে প্রাণহানি এবং সম্পত্তিনাশ অন্যগুলির তুলনায় অনেকটাই বেশি পরিমাণে ঘটে থাকে৷ মূলত সমুদ্রগর্ভে ভূমিকম্প কিংবা ভূমি স্খলনের কারণে সুনামির সৃষ্টি হয়ে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা বিধ্বংসী জলোচ্ছ্বাসের আকার নিয়ে জনবসতি তছনছ করে দেয়। ২০০৪ সালে ঘটে যাওয়া ভারত মহাসাগরের সুনামিটি এযাবৎকালের মধ্যে যত সুনামি আছড়ে পড়েছে সেই সবগুলির তুলনায় ছিল ভয়ংকর। ভারত, শ্রীলঙ্কা-সহ মোট ১৪টি দেশের কয়েকলক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল এই ধ্বংসলীলায়। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দারা সেকারণে সর্বদাই আশঙ্কায় দিনযাপন করেন। সুনামির কবল থেকে কীভাবে প্রাণ ও সম্পত্তি রক্ষা করা সম্ভব সে সম্পর্কে মানুষকে জানানো হয় এবং সুনামিসংক্রান্ত ঝুঁকি যতটা হ্রাস করা সম্ভব সেই প্রয়াস করা হয়ে থাকে।
২০১৫ সালের ২২শে ডিসেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে ৫ই নভেম্বর তারিখটিকে বিশ্ব সুনামি সচেতনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিল। পরেরবছর ২০১৬ সালের ৫ই নভেম্বর প্রথম এই দিনটি উদযাপন করা হয়েছিল। এই দিবসের পরিকল্পনা অবশ্য মূলত একটি ভূমিকম্প প্রবণ দেশ জাপানের মস্তিষ্কপ্রসূত। বিশেষভাবে ৫ই নভেম্বর দিনটিকে বেছে নেওয়ার পিছনে রয়েছে জাপানের একটি অতি পুরাতন গল্পের প্রতি সম্মানপ্রদর্শনের মনোভাব। গল্পটি ‘ইনামুরা-নো-হাই’ (Inamura-no-hi) নামে পরিচিত যার অর্থ হল ধানের শীষ পোড়ানো। ১৮৫৪ সালের এক ভূমিকম্পের সময় জাপানের এক কৃষক দেখতে পান সমূদ্রের তরঙ্গ ফুলে-ফুলে উঠছে যা-কিনা সুনামির পূর্বলক্ষণ। তখন তিনি তাঁর জমির ধানে অগ্নিসংযোগ করে সেই আগুনের সাহায্যে গ্রামবাসীদের সংকেত পাঠান যাতে বিপদ আঁচ করে তারা উঁচু কোনও জায়গায় পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে। এবং শেষপর্যন্ত গ্রামবাসীরা স্বীকার করেন যে তারা প্রাণে বেঁচেছেন ওই আগুনের সংকেতের জন্যে। তাছাড়া সেই কৃষক একটি বাঁধ এবং কিছু বৃক্ষরোপণ করেন ভবিষ্যতে এই ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবার জন্য। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ সমস্ত দেশকে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং নাগরিক সমাজকে এই দিবস উদযাপনে অংশ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে আহ্বান জানায়। রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্যান্য ব্যবস্থাপনার সহযোগিতায় ইউএন অফিস ফর ডিজাসটার রিস্ক রিডাকশনকে (UN office for Disaster Risk Reduction বা UNISDR) এই দিনটি উদযাপনে সাহায্যের জন্যও বলা হয়েছিল এবং সেকাজ তারা সম্পন্ন করে আসছে দক্ষতার সঙ্গে। রাষ্ট্রপুঞ্জের এই দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস অফিসের (UNISDR) যে ‘সেন্ডাই সেভেন অভিযান’ (Sendai Seven Campaign) বিশ্ব সুনামি সচেতনতা দিবসকে তার কার্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছে।
বিশ্বের নানাপ্রান্তে বিবিধ আয়োজনের মাধ্যমে এই দিনটিকে বিশেষ মর্যাদা সহকারে পালন করে জনসচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়। বিভিন্ন দেশে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে শিক্ষামূলক সেমিনারের আয়োজন করা হয় এবং আলোচনার মাধ্যমে মানুষকে সুনামি সম্পর্কে কীভাবে তার মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে সেসব বিষয়ে জানানো হয়ে থাকে। কোথাও বা বিশেষ ভিডিও প্রদর্শনের মাধ্যমে দেখানো হয় সুনামি বিজ্ঞান সম্পর্কিত এবং সুনামির জন্য প্রস্তুতি বিষয়ক নানা তথ্য। এছাড়াও টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মাধ্যমেও মানুষকে যথাসম্ভব সচেতন করবার নিরন্তর প্রয়াস চলতে থাকে। এইবছর অর্থাৎ ২০২০ সালে অতিমারী পরিস্থিতির জন্য সুনামি সম্পর্কিত সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রাদেশিক ওয়েবিনারেরও (Regional Webinars) পরিকল্পনা করা হয়েছে। এবছর বিশেষ এই দিনটি উপলক্ষে ৩০দিন ব্যাপী যে অভিযানের আয়োজন করা হয়েছে তার মূল লক্ষ্য এমন দেশের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা যাদের কাছে জাতীয় এবং আঞ্চলিক দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসকরণের কৌশলগুলি স্পষ্ট থাকবে।