নববর্ষ

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নববর্ষ

আমরা সবাই জানি এপ্রিল মাসের ১৪ কিংবা ১৫ তারিখ আর বাংলা মাসের বৈশাখের প্রথম দিনটি হল বাঙালীর নববর্ষ। আমাদের আদরের পয়লা বৈশাখ।কিন্তু আমাদের দেশের অনেক এলাকাতেই নতুন বছর শুরু হয় একটু আগে, চৈত্রের শুক্লা প্রতিপদে(প্রতিপদ মানে প্রথম) সেটা কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা। আমাদের এই বিশাল বৈচিত্র্যময় দেশের সংস্কৃতিটাও তো আমাদের জানতে হবে নাকি! আর জানবই যখন তখন যা জানবো ‘সব বাংলায়’ এই শপথ নিয়েই শুরু করা যাক ভারত ভ্রমণ ধর্ম, লোকাচার ও ইতিহাসের মোরাম বিছানো পথ বরাবর।

 

গুঢ়ি পড়ওয়া-

মহারাষ্ট্রে এবং গোয়ায় এই নববর্ষের নাম গুঢ়ি পড়বা। চৈত্র মাসের প্রথম দিনে এটি পালিত হয়।‘পড়ওয়া’ কথাটা এসেছে সংস্কৃত ‘প্রতিপদ ‘থেকে। ‘গুঢ়ি’ বা দণ্ড হল মরাঠি আচারের বৈশিষ্ট্য, এমনকী গরিব মানুষরাও বাড়ির জানলা থেকে ছোট ছোট লাঠি বের করে রাখেন। তাঁদের বিশ্বাস, সেগুলি অশুভ শক্তিকে দূরে রাখে, ঘরে সমৃদ্ধি আনে। ডাল এবং রঙিন ফুলে অলঙ্কৃত করা হয়। মানুষ এই সময় ঘরবাড়ি সাফসুতরো করে দরজায় সূক্ষ্ম সুন্দর রংগোলি আঁকেন।

 

উগাড়ি-

কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা তে এই উৎসবের একটা নাম ‘উগাড়ি’।উগাড়ি কথাটা এসেছে ‘যুগ’ আর ‘আদি’ মিলিয়ে।এখানে একে‘চৈত্র শুক্লাড়ি’ও বলে।কর্নাটকে এই উৎসবের জন্য একটি বিশেষ পদ তৈরি হয়, তার নাম ‘ওবত্তু’ বা ‘পুরন পোলি’। ডাল, গুড় আর তার সঙ্গে ঘি বা দুধ মিশিয়ে রুটির মতো করে গড়া। অন্ধ্র্প্রদেশ ও তেলঙ্গানাতেও পুরন পোলি বা পোলেলু এই অনুষ্ঠানের একটি অঙ্গ। আর একটি অদ্ভুত মিশ্রণ তৈরি হয়, তার নাম ‘উগাড়ি পচ্ঠড়ি’। এতে ছ’রকমের স্বাদ থাকে: তেতো নিম, মিষ্টি গুড় কিংবা পাকা কলা, ঝাল কাঁচালঙ্কা বা মরিচ, নুন, টক তেঁতুল আর টক কাঁচা কম। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এটা একটা ওষুধের মতো।

 

সাজিবু নোংমা পানবা-

অনেকে এই উৎসবটিকে ‘সাজিবু চেইরোবা’ ও বলে থাকে। মণিপুরের ‘সানামাহি’ ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষদের নববর্ষ কে এই নামে ডাকা হয়। চৈত্র মাসের প্রথম দিনে এটি পালিত হয়।

 

নভ্রেহ্-

চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের প্রথম দিন টা কাশ্মীরি পণ্ডিতরা নববর্ষ হিসেবে পালন করে।এই নববর্ষ কে কাশ্মীরে “নভ্রেহ্” নামে ডাকা হয়।কাশ্মীরি পণ্ডিতরা মনে করেন কাশ্মীরি সপ্তর্ষি যুগ ৫০৭৯ বছর আগে এই চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়।

 

থাপনা-

মাড়োয়াড়ি ক্যালেন্ডার অনুসারে চৈত্র মাসের প্রথম দিন টা রাজস্থানিদের নববর্ষ।রাজস্থানে একে “থাপনা” বলে।

 

চেট্টি চাঁদ-

চৈত্র মাসের দ্বিতীয় দিনটা সিন্ধ্রি সম্প্রদায় এর মানুষরা নববর্ষ হিসেবে পালন করে।সিন্ধিরা একে “চেট্টি চাঁদ” বলে।নববর্ষ পালিত হয় এইদিন তাদের ইষ্টদেবতা ‘ঝুলেলাল’এর সম্মানার্থে এবং এইদিন এরা জল কেও আরাধনা করে জীবনধারণের সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ উপাদান হিসেবে।

 

রঙ্গালি বিহু-

১৪ই এপ্রিল হল অসমীয়াদের নববর্ষ।এইদিনটিকে তারা “রঙ্গালি বিহু” বলে।একে অনেকে ‘বোহাগ বিহু’ ও বলে।অসমীয় ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস হল ‘বোহাগ’।‘বোহাগ’ মাসের প্রথম দিনে এই উৎসব হয় বলে একে ‘বোহাগ বিহু’ বলে।

 

বেস্তু বরষ-

গুজরাটিরা তাদের নববর্ষ কে “বেস্তু বরষ” বলে। গুজরাটি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস হল কার্ত্তিক।কার্ত্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের প্রথম দিন মানে দিওয়ালির পরের দিনটিকে গুজরাটিরা তাদের নববর্ষ হিসেবে পালন করে।

 

পুথান্ডু-

তামিলরা তাদের নববর্ষ কে “পুথান্ডু” বলে।তামিল ক্যালেন্ডারের ‘চিথিরাই’ মাসের প্রথম দিনটি, যেটা কিনা ১৪-ই এপ্রিল সেইদিনটিকে তামিলরা তাদের নববর্ষ হিসেবে পালন করে।একে “ভারুদা পিরাপ্পু” নামেও ডাকা হয়।এইদিন মেয়েরা আল্পনা দেয়,যাকে ‘কোলাম’ বলে।এই আল্পনার ঠিক মাঝখানটায় একটি প্রদীপ বসানো হয়, যেটিকে ‘কুত্তুভিলাকু’ বলে।এই প্রদীপটি সমস্ত কলুষতা দূর করে বলে তামিলরা বিশ্বাস করে।‘কান্নি’ নামের একটি আচার পালন করা হয় এইদিন।‘কান্নি’ মানে ‘শুভদৃষ্টি’।তামিলরা এইদিন অলঙ্কার,ফুল,ফল,সব্জি ইত্যাদির দিকে তাকিয়ে থাকে।তারা মনে করে তাদের এই ‘শুভদৃষ্টি’ তাদের জীবনে সুখ আনবে।

 

বিশু-

কেরলে নববর্ষ কে “বিশু” বলে।মালয়লাম ক্যালেন্ডারের ‘মেদাম’ মাসের প্রথম দিনটি যা কিনা গ্রেগ্ররিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি, সেই দিনটিকে কেরলের অধিবাসিরা নববর্ষ হিসেবে পালন করে।

 

বৈশাখী-

পাঞ্জাব এবং হরিয়ানাতে এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখ, যা কিনা নানাকসাহি ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় মাসের প্রথম দিন,সেই দিনটিকে শিখরা তাদের নববর্ষ হিসেবে পালন করে।এইদিনটি শিখরা তাদের দশম গুরু ‘গুরু গোবিন্দ সিং’এর স্মরণে পালন করে, কারণ ১৬৯৯ সালের এইদিনে গুরু গোবিন্দ সিং ‘খালসা পন্থ’ এর প্রবর্তন করেন।

 

মহা বিষুব সংক্রান্তি-

এটি ওড়িশার অধিবাসীদের নববর্ষ।একে আবার ‘পানা সংক্রান্তি’ও বলা হয়।এইদিন বিভিন্ন ধরণের ফলের রস,জল,দুধ,বেল,দই ও চিনি মিশিয়ে এক রকম পানীয় তৈরী করা হয় যাকে‘পানা’বলা হয়। এইদিন এই পানীয় পান করা নববর্ষ-এর অন্যতম পালনীয় কর্তব্য।

 

 

ভাষার মধ্যে যতই প্রভেদ থাক,প্রভেদ থাক যতই পোশাক,সংস্কৃতি কিংবা ভূমিরূপে, ভারতবর্ষের শরীর দিয়ে সেই কোন যুগ যুগান্তের আদিম ভোর থেকে ঐক্যের যে অর্ন্তলীন স্রোত আবহমান কাল ধরে তার শিরা,তার ধমনীর মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে তার শব্দ হয়তো শোনা যায় না,কিন্তু তার অন্তহীন গতিপথ ঠিক বোঝা যায় ভারতবর্ষের ধর্মীয় উৎসব গুলির উৎসমুখে এসে দাঁড়ালে।নতুন বছর কে বরণ করে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে আশাবাদের যে প্রদীপ জ্বালানো হয় তার প্রকারভেদ এক এক রাজ্যে হয়ত এক একেকরকম, কিন্তু দিনের শেষে একটা জায়গায় এসে আমরা সবাই এক হয়ে যাই. . . এক অকৃত্রিম বিশ্বাসে।এ প্রদীপ অনির্বাণ থাকুক বছরভর।

One comment

আপনার মতামত জানান