পাঁচটি রাজ্য যারা স্বাধীন ভারতে অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করে

পাঁচটি রাজ্য যারা স্বাধীন ভারতে অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করেছিল

১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট মধ্যরাত্রে ভারতের বুকে উড্ডীন হল স্বাধীন ভারতের পতাকা, নেমে গেল ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক। বেতারের দূরাভাষে নব্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জওহরলাল নেহরু বক্তব্য রাখলেন, এই স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে ভারতবাসী যেন নতুন জীবন ও নতুন আশায় উজ্জীবিত হল। বহু বহু বছরের কঠোর আন্দোলন, দমন-পীড়ন আর নৃশংস অত্যাচারের পরে স্বাধীনতা অর্জনই কেবল সব সমস্যার সমাধান ছিল না। সমস্যা তখনও আরও বাকি ছিল। আর তাদের মধ্যে প্রধান সমস্যা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল ভারতের মানচিত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টুকরো টুকরো দেশীয় রাজ্যগুলিকে একত্রিত করে অখণ্ড এবং সার্বভৌম ভারতবর্ষ গঠন করাকে নিয়ে। এখানে পাঁচটি রাজ্য যারা স্বাধীন ভারতে অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করেছিল তাদের নিয়ে আলোচনা করা হল।

ব্রিটিশ শাসন চলাকালীন ভারতে ৫৬৫টি দেশীয় রাজ্য ছিল যেগুলি পুরোপুরি ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল না এবং সেখানে কোনোদিনই ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়নি। অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির মাধ্যমে এই সব রাজ্যগুলি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ অবস্থায় ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই রাজ্যগুলি এক অর্থে আংশিক স্বাধীনতা ভোগ করত, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরাও নিজেদের প্রয়োজনে ঐ দেশীয় রাজ্যগুলির রাজাদের মদত জোগাত। ইতিহাসে আমরা অনেকেই পড়েছি ব্রিটিশ গভর্নর লর্ড ওয়েলেসলি বহু দেশীয় রাজ্যকে একপ্রকার বাধ্য করেছিলেন এই অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি স্বীকার করে নিতে। ব্রিটিশ ভারতেই ‘গভর্নমেন্ট অফ ইণ্ডিয়া অ্যাক্ট, ১৯৩৫’ প্রথম পাশ হয় যে আইনে বলা হয় এই দেশীয় রাজ্যগুলি নিজেদের সম্মতিক্রমে অখণ্ড ভারতীয় রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কিন্তু দেশীয় রাজ্যের রাজারা প্রথমে এই যুক্তরাষ্ট্রের ধারণার তীব্র বিরোধিতা করে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তারা ক্রমেই এই ধারণায় বিশ্বাসী হয় এবং একে একে এই আইনি চুক্তিতে সম্মত হয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা পাকাপাকিভাবে ভারতবর্ষ ছেড়ে যেতে সিদ্ধান্ত নেয়। এই সময়েই ভারতের সব দেশীয় রাজ্যগুলির ভবিষ্যৎ এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পর্যবসিত হয়। তারা নিজেরা নিজেদের মত করে সদ্যগঠিত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভাজিত হতে পারত না। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ইণ্ডিয়ান ইণ্ডিপেণ্ডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী সকল দেশীয় রাজ্যের উপর ব্রিটিশের শাসন ও আধিপত্য খর্ব করা হয়। এর ফলে দেশীয় রাজ্যগুলি সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনতা লাভ করে, যদিও তাদের মধ্যে অধিকাংশ রাজ্যই নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, আর্থিক সাহায্য ও অন্যান্য পরিকাঠামোর জন্য ভারত সরকারের উপর নির্ভরশীল ছিল। দেশীয় রাজ্যগুলি স্বাধীন হওয়ার পরে দেশীয় রাজাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে তারা ভারত নাকি পাকিস্তান কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। বরোদা, বিকানীর, জয়পুর ইত্যাদি রাজ্যগুলি সবার আগে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও আরও কিছু রাজ্য ছিল যারা কোনোভাবেই ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হতে চায়নি, বরং এক একটি রাজ্য পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি জানিয়েছিল। ত্রিবাঙ্কুর, যোধপুর, জুনাগড়, জম্মু ও কাশ্মীর এবং হায়দ্রাবাদ এই রাজ্যগুলি নিয়েই সমস্যা সৃষ্টি হয়।

ব্রিটিশরা ভারতের ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় এই সব দেশীয় রাজ্যগুলিকে কীভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হবে তার দায়িত্ব অর্পণ করে যায় সদ্যগঠিত স্বাধীন ভারতের সরকারের উপর। ১৯৩০ সালের পর থেকেই জাতীয় কংগ্রেস সমস্ত দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়টিতে প্রত্যক্ষ উদ্যোগ নেয়। ১৯৩৮ সালের হরিপুরা কংগ্রসে সিদ্ধান্ত হয় যে, সমস্ত দেশীয় রাজ্যগুলির উপর একই রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে এবং ঐ সকল রাজ্যগুলিকে ভারতেরই অঙ্গীভূত হিসেবে বিবেচনা করা হবে। স্বাধীনতা তথা পূর্ণ স্বরাজের অর্থ ঐ দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়েই অখণ্ড ভারতের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে স্বাধীন ভারতের কার্যনির্বাহী প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রধান সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের অবদান স্মরণীয়। তাঁকেই আধুনিক ভারতের রূপকার বলা হয়। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের অধীনে সাংবিধানিক পরামর্শদাতা ভি. পি. মেননের সঙ্গে যৌথভাবে স্বাধীন ভারতের আয়তনের প্রায় ৪৮ শতাংশ জুড়ে বিস্তৃত এবং ভারতের তৎকালীন জনসংখ্যার ২৮ শতাংশের ধারক এইসব দেশীয় রাজ্যগুলিকে সুকৌশলে অখণ্ড ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে ভারতের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেন। এই প্রসঙ্গেই লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পিত ‘ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাক্সেশন’ চুক্তির কথাও আমাদের জানা।

ত্রিবাঙ্কুর– ত্রিবাঙ্কুর ছিল প্রথম দেশীয় রাজ্য যে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়নি এবং স্বাধীন ভারতের সরকারে জাতীয় কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। দক্ষিণ ভারতের এই সমুদ্র-উপকূলবর্তী দেশীয় রাজ্যটি সমুদ্র-বাণিজ্যের কারণে প্রভূত মানব সম্পদ এবং অর্থ সম্পদে পরিপূর্ণ ছিল এই রাজ্যটি। ত্রিবাঙ্কুরের দেওয়ান ছিলেন স্যার সি. পি. রামস্বামী আইয়ার যিনি ভারতের মধ্যে থেকেও ত্রিবাঙ্কুরকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করেছিলেন। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ মনে করেন রামস্বামী আইয়ারের এই ঘোষণার পিছনে পাকিস্তানের মহম্মদ আলি জিন্না এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্পষ্ট মদত ছিল। ইতিমধ্যে কেরালার এক সমাজতান্ত্রিক কর্মী স্যার সিপি রামস্বামীর উপর অতর্কিত আক্রমণ হানলে তাঁর জীবন সংশয় দেখা দেয় এবং তিনি ত্রিবাঙ্কুর ত্যাগ করেন। ফলে ১৯৪৭ সালের ৩০ জুলাই ত্রিবাঙ্কুর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।

যোধপুর– যোধপুরের শাসক হানওয়াত সিংহ জয়সলমীরের রাজার সঙ্গে একত্রে মহমদ আলি জিন্নার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। অন্যদিকে মহম্মদ আলি জিন্নাও যোধপুর আর জয়সলমীরকে যেন তেন প্রকারেণ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করায় আগ্রহী ছিলেন। মাউন্টব্যাটেন এই সময় যোধপুরের শাসককে বোঝান যে একটি হিন্দু রাজ্য হয়ে মুসলিম শাসিত পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে। ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় যোধপুর।

ভোপাল– ভোপালের ক্ষেত্রে সেখানকার শাসক হামিদুল্লাহ খান ছিলেন মুসলিম কিন্তু রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজাই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। হামিদুল্লাহের সঙ্গে মুসলিম লিগের ঘনিষ্ঠ সখ্যতা ছিল এবং জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধীও ছিলেন তিনি। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি জানিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সাল নাগাদ অন্যান্য দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে দেখে একপ্রকার বাধ্য হয়েই ভোপালের শাসক হামিদুল্লাহ্‌ খান ভারতের অন্তর্ভুক্তিকরণে সম্মত হন।

হায়দ্রাবাদ– হায়দ্রাবাদের ক্ষেত্রে এক বিরাট রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘর্ষ এবং আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে এই দেশীয় রাজ্যটি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। হায়দ্রাবাদ সংযুক্তিকরণের ক্ষেত্রে সেখানকার নিজাম শাসকদের পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে চূর্ণ করে রাজাকার সেনার সঙ্গে ভারতীয় সেনার প্রত্যক্ষ সংঘাত বাধে। ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনা ‘অপারেশন পোলো’ নামে পরিচিত। অবশেষে ১৯৪৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাজা নিজাম বৃহত্তম ও শক্তিশালী দেশীয় রাজ্য এই হায়দ্রাবাদকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হন এবং আত্মসমর্পণ করেন।  

জুনাগড় জুনাগড় ছিল গুজরাটের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ভৌগলিকভাবে তার কোন সংযোগই ছিল না। জুনাগড়ের নবাব তৃতীয় মহম্মদ মহবত খানজি মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে বিরোধিতা করে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে চান এবং সমুদ্রপথে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চান। জুনাগড়ের ক্ষেত্রে হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও সেখানকার শাসক ছিলেন মুসলিম। ১৯৪৭ সালের আগে জুনাগড়ের দেওয়ান নাবি বক্স মুসলিম লীগের শাহ নওয়াজ ভুট্টোকে স্টেট কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে যোগ দিতে বলেন। দেওয়ানের অনুপস্থিতিতে ভুট্টো কার্যালয়ের সমগ্র আধিপত্য দখল করে পাকিস্তানের সঙ্গে জুনাগড়ের অন্তর্ভুক্তি ঘটাতে উদ্যোগী হয়। ফলে জুনাগড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। পার্শ্ববর্তী দেশীয় রাজ্যগুলি স্বাধীনতা ঘোষণা করায় জুনাগড়ের সৈন্যবাহিনী সেইসব রাজ্যগুলি দখল করে। এই মুহূর্তে ভারত সরকার মনে করে যে জুনাগড়কে পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হতে দিলে গুজরাট অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে এবং সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু প্রজা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করে। এমতাবস্থায় ভারতের পক্ষ থেকে জুনাগড়ে একটি গণভোটের ব্যবস্থা করা হয় যেখানে প্রজারা মত প্রকাশের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে জুনাগড় ভারত বা পাকিস্তান কার অন্তর্ভুক্তিকে স্বীকার করবে। ইতিমধ্যে জুনাগড়ে তেল ও কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, বিমান ও ডাক ব্যবস্থাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী জুনাগড়ের সীমান্ত দখল নেয় এবং ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর তারিখে ভারতীয় সেনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের পরে জুনাগড়ের নবাব খানজি পাকিস্তানে পলায়ন করেন। ১৯৪৮ সালে গণভোটে জুনাগড়বাসীদের মতের সপক্ষে জুনাগড় অবশেষে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।

এই হল পাঁচটি রাজ্য যারা স্বাধীন ভারতে অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করেছিল ।

আপনার মতামত জানান