সতীপীঠ কন্যাকুমারী

সতীপীঠ কন্যাকুমারী

কন্যাকুমারী মন্দিরটি ভারতের মূল ভূভাগের দক্ষিণতম প্রান্তে তামিলনাড়ু রাজ্যের অন্তর্গত কন্যাকুমারীতে অবস্থিত। সতীপীঠ কন্যাকুমারী একান্ন সতীপীঠের একটি পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর মেরুদন্ডের শেষ ভাগ পড়েছিল। মতান্তরে বলা হয় এখানে সতীর ডান কাঁধ পড়েছিল। এখানে প্রতিষ্ঠিত দেবী সর্বাণী এবং ভৈরব হলেন নিমিষ। 

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়, বলা হয় সতীর মেরুদন্ডের শেষ অংশটি পড়ে কন্যাকুমারী সতীপীঠ গড়ে উঠেছে। 

শোনা যায়, অনেকদিন আগে বাণ নামে এক অসুর শিবের তপস্যা করে বর পেয়েছিল যে একজন কুমারী মেয়েই কেবল তাকে বধ করতে পারবে। এই বর পেয়ে বাণাসুর সারা পৃথিবীতে ভীষণ অত্যাচার করতে লাগল। তার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দেবতারা আদ্যাশক্তি মহামায়াকে কুমারী মেয়ের রূপে জন্ম নিয়ে বাণাসুরকে হত্যা করার জন্য অনুরোধ করেন। তখন মা মহামায়া একটি কুমারী মেয়ের রূপে পৃথিবীতে জন্ম নেন। 

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

সময়ের সাথে সাথে ভগবান শিব সেই কুমারী মেয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করতে চান।  ঠিক হয় সূর্যোদয় হওয়ার সময় তাঁদের বিয়ে হবে। নির্দিষ্ট দিনে শিব বর্তমান কন্যাকুমারীর কাছে সুচিন্দ্রাম নামে একটি জায়গা থেকে বিয়ের জন্য যাত্রা শুরু করলেন। এদিকে নারদ মুনি জানতেন যে, বাণাসুরকে বধ করার জন্য দেবীর অবিবাহিত থাকাটা জরুরি। তাই তিনি একটি মোরগের রূপ ধারণ করলেন এবং ভোর হওয়ার আগেই চিৎকার করে ডেকে উঠলেন। সেই ডাক শুনে শিব ভাবলেন বুঝি ভোর হয়ে গেছে এবং শুভ সময় পেরিয়ে গেছে। নিরাশ হয়ে শিব দেবীকে বিয়ে না করেই ফিরে গেলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন শিব দেবীকে বিয়ে করতে এলেন না, তখন দেবী ভাবলেন শিব তাঁকে মিথ্যা কথা বলেছেন। তখন দেবী অসহ্য অপমান, যন্ত্রণা, শোক এবং রাগে পাগলের মতো হয়ে উঠলেন এবং সামনে যা পেলেন তাই ধ্বংস করে দিলেন। নিজের সব গয়নাগাটি খুলে ফেললেন এবং সব খাবার-দাবারও ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। পরে মন শান্ত হলে তিনি সারাজীবন অবিবাহিতা থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং গভীর তপস্যা শুরু করলেন। 

কিছুদিন পরে বাণাসুর সেই স্থানে গিয়ে তপস্যারত দেবী কুমারীকে দেখে তাঁর রূপে মোহিত হয়ে তাঁকে বিয়ে করতে চাইল। দেবী রাজি না হওয়ায় বাণাসুর নিজের বরের কথা ভুলে গিয়ে দেবীর ওপর জোর করতে গেল। তখন দেবী নিজের আসল রূপ ধারণ করলেন এবং ভীষণ যুদ্ধের পর বাণাসুরকে বধ করলেন। অসুর মারা যাওয়ার পর মা মহামায়া আবার নিজের পার্বতী রূপে ফিরে গেলেন এবং শিবের সঙ্গে মিলিত হলেন। বলা হয়, এই স্থানেই তিনি কুমারী রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দেবীর ফেলে দেওয়া খাবার থেকেই কন্যাকুমারীর সমুদ্রের তীরে নানা রঙের বালি সৃষ্টি হয়েছে। 

১৮৯২ সালে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের আদেশ মেনে স্বামী বিবেকানন্দ এই সতীপীঠ কন্যাকুমারী দর্শন করতে এসেছিলেন। এই স্থানেই তিনি সাধারণ সন্ন্যাসীদের মতো নিস্ক্রিয় হয়ে না থেকে মিশনারি কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করেছিলেন। রামকৃষ্ণদেবের আরও দুজন শিষ্য স্বামী ব্রহ্মানন্দ এবং স্বামী নির্মলানন্দ কন্যাকুমারী মন্দিরে এসেছিলেন। 

এই শক্তিপীঠটি ভারত মহাসাগরের উপর একটি ছোট্ট দ্বীপে অবস্থিত। সাধারণ ছিমছাম মন্দিরের গম্বুজটি আকারে অনেক বড় এবং লাল পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে অল্প কিছু পরিবর্তন হলেও মূল মন্দিরের স্থাপত্যের বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়নি। বলা হয়, মন্দিরটি নাকি ৩০০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। মন্দিরের ভিতর একটি কুয়ো আছে, এই কুয়োর জলে দেবীকে স্নান করানো হয়। 

এখানে দেবী সর্বাণী নামে পূজিতা হন। স্থানীয়দের কাছে দেবীর নাম ‘কুমারী আম্মা’ বা ‘ভগবতী আম্মা’। কুমারী কন্যারূপী দেবীর মূর্তি পূর্বমুখী। গলায় ফুলের মালা, মাথায় মুকুট। দেবীর হাতে একটি রুদ্রাক্ষের জপমালা থাকে। দেবীর নাকে একটি হিরের নাকছাবি আছে, যার দ্যুতি অসাধারণ। এই নাকছাবিটি নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। নাবিকেরা ভারত মহাসাগর দিয়ে জাহাজ নিয়ে যেতে যেতে এই নাকছাবির ঔজ্জ্বল্য দেখে ভাবত ওখানে কোনো বাতিঘর আছে। অনেকবার দুর্ঘটনা ঘটার পর মন্দিরের পূর্বদিকের সমুদ্রমুখী দরজা বরাবরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবশ্য বছরের নির্দিষ্ট কয়েকদিন খোলা থাকে ওই দরজা। এই স্থানে দেবী সর্বাণী ছাড়াও সূর্যদেব, গণেশ, ভগবান আয়াপ্পা স্বামী, দেবী বালাসুন্দরী এবং দেবী বিজয়াসুন্দরীর পুজো হয়। 

প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। কন্যাকুমারী সতীপীঠে দেবীর নাম সর্বাণী এবং ভৈরব হলেন নিমিষ। 

 মাতা সর্বাণীকে দর্শনের সময় হল প্রতিদিন ভোর ৪:৩০ থেকে দুপুর ১২:৩০ পর্যন্ত। এরপর মন্দির বন্ধ হয়ে যায়। আবার বিকেল ৪:০০ থেকে রাত ৮:৩০ পর্যন্ত ভক্তেরা মাকে দর্শন করতে পারেন। চৈত্র মাসের পূর্ণিমার দিন দেবীর বিশেষ পূজা হয়। বৈশাখ মাসে এখানে দশ দিন ধরে দেবীর পূজা হয়। এইসময় দেবীকে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় শোভাযাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়। খুলে দেওয়া হয় মন্দিরের পূর্বদিকের দরজা। উৎসবের নবমদিনে দেবীকে নৌকায় চড়িয়ে সমুদ্রের জলে ঘোরানো হয়। আশ্বিন মাসে শারদীয়া পুজোর সময়ও এখানে ভক্তদের বিশাল ভিড় হয়। এইসময় সঙ্গীতশিল্পীরা নবরাত্রি মণ্ডপে অনুষ্ঠান করে দেবীকে তাঁদের দক্ষতা দেখানোর সুযোগ পান। 

আপনার মতামত জানান