টি এস আর সুব্রামানিয়ান বনাম ভারত মামলা

টিএসআর সুব্রামানিয়ান বনাম ভারত মামলা

ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার ইতিহাস ঘাঁটলে এমন কিছু মামলার হদিশ পাওয়া যাবে যা আক্ষরিক অর্থেই ছিল ঐতিহাসিক। আইএএস, আইপিএসদের মতো বেসামরিক কর্মচারী এবং তাদের দাবিদাওয়াকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল টিএসআর সুব্রামানিয়ান বনাম ভারত মামলা । মিস্টার সুব্রামানিয়ানরা মূলত যে প্রশ্নগুলি উত্থাপন করেছিলেন সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল সিভিল সার্ভেন্টরা কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রশাসনের উর্ধতন কর্তা ইত্যাদি যে-কারও প্রদত্ত মৌখিক নির্দেশ পালন করতে বাধ্য কি না এবং তার সামাজিক উপকারিতা কতখানি। আবেদনকারী আমলারা বেসরকারী কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট মেয়াদ প্রদানেরও আর্জি জানিয়েছিলেন আদালতের কাছে। তাঁরা স্বাধীন একটি সিভিল সার্ভিস বোর্ড নির্মাণের আবেদনও জানিয়েছিল মহামান্য আদালতকে। সরকার পক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে দীর্ঘ সওয়াল জবাবের পরে বিচারালয় যে রায় দিয়েছিল তা ছিল আবেদনকারীদের পক্ষেই এবং সমস্ত মহলেই তা প্রশংসা অর্জন করেছিল।

প্রাক্তন মন্ত্রীপরিষদের সচিব টিএসআর সুব্রামানিয়ান সিভিল সার্ভিসের ভবিষ্যত ও কার্যক্ষেত্রের উন্নতি হেতু ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। উত্তরপ্রদেশ ক্যাডারের ১৯৬১ ব্যাচের এই আইএএস অফিসার আমলাতন্ত্রকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখার জন্য সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন। ১৯৯৮ সালে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি হিসেবে অবসর নেওয়ার পর থেকেই আমলাদের নানা বিষয়ে সুব্রামানিয়ান সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। প্রাক্তন আইএএস সুব্রামানিয়ান ছাড়াও আরও ৮২ জন অবসরপ্রাপ্ত আমলা সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদগুলিকে যুক্ত করে সুপ্রিম কোর্টে এই জনস্বার্থ মামলাটি দায়ের করেন। জনপ্রশাসনের উন্নতির জন্য নিযুক্ত বিভিন্ন কমিটি, যথা, সন্থানাম কমিটি ১৯৬২, ঝা কমিশন ১৯৮৬, সেন্ট্রাল স্টাফিং স্কিম ১৯৯৬, হুটা কমিটি ২০০৪, ইত্যাদির প্রতিবেদন এবং সুপারিশের ভিত্তিতেই আবেদনকারীরা রিট পিটিশনে তাদের আর্জিগুলি তৈরি করেছিল। মূলত যেসমস্ত আবেদন তাঁরা উত্থাপন করেছিল আদালতে সেগুলির দিকে নজর দেওয়া যাক।

প্রথম, আবেদনকারীরা, হুটা কমিটি ২০০৪-এর সুপারিশের ভিত্তিতে কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় স্তরে একটি স্বাধীন সিভিল সার্ভিস বোর্ড (CBS) বা কমিশন তৈরির আর্জি জানিয়েছিল আদালতকে। এই বোর্ড গঠনের আবেদনটি নাগরিক পরিষেবা সংস্কার হিসেবে ব্যপকভাবে সমাদৃত হয়েছিল। আসলে এই বোর্ড হল এমন একটি প্যানেল, যেটির নেতৃত্বে জাতীয় পর্যায়ে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুখ্য সচিবরা দেশের উচ্চ-পদস্থ সিভিল সার্ভিস অফিসারদের বদলি ও পদায়ন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এই আবেদন সিভিল সার্ভিস সংস্কার হিসেবেও বেশ প্রশংসিত হয়েছিল।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

দ্বিতীয়ত তাঁরা উক্ত কমিশন ও কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে, এমন একটি নির্দেশ জারি করার দাবি করেছিলেন, যাতে সিভিল সার্ভেন্টদের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য তাদের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়। আমলাদের নির্দিষ্ট মেয়াদ যে, পেশাদারিত্ব, দক্ষতা এবং সুশাসনকে উন্নত করবে সে-প্রসঙ্গও তারা তুলেছিলেন।

তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টির উত্থাপন করেছিলেন সুব্রামানিয়ান এবং তাঁর দল, সেটি হল, রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ, বিধায়ক, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তি বা প্রভাবশালী যেকোনো কারওর আদেশ, নির্দেশ, উপদেশ ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকভাবে যাতে বেসামরিক কর্মচারীরা নথিভুক্ত করে রাখতে পারে, আদালত সেই সংক্রান্ত নির্দেশ প্রদান করলে স্বেচ্ছাচার এবং অবৈধ সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা এড়ানো সম্ভব হবে। সিভিল সার্ভেন্টদের কার্যকারিতার প্রভূত অবনতির জন্য তাঁরা দায়ী করেছিলেন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে। অতএব তা থেকে আমলাতন্ত্রকে মুক্ত রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন টি এস আর সুব্রামানিয়ান।

সিনিয়র কাউন্সেল শ্রী কে কে ভেনুগোপাল রিট পিটিশনারদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন এবং কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় স্তরেই একটি সিভিল সার্ভিস বোর্ড (সংক্ষেপে ‘CSB’) তৈরির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। এটি সরকারের নির্বাহী স্বাধীনতাকে বিসর্জন না করে সমস্ত বদলি এবং পদায়নের বিষয়ে সুপারিশ করতে পারে। বিজ্ঞ সিনিয়র কাউন্সেল স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য বেসামরিক কর্মচারীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ প্রদানের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেছিলেন। এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলবে সমাজে এবং বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যও এই মেয়াদ নির্ধারণ ভীষণ দরকারী।

অন্যদিকে মিঃ পারস কুহাদ ভারত ইউনিয়নের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন এবং কেন্দ্র এবং রাজ্য স্তরে স্বাধীন CSB প্রতিষ্ঠার আবেদনের বিরোধিতা করেছিলেন। সুব্রামানিয়ানদের সেই বিপক্ষদলের যুক্তি ছিল যে, এই সিভিল সার্ভিস বোর্ড গঠন রাজনৈতিক নির্বাহী (Executive), যারা সরাসরি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, তাদের নেতৃত্বে চলা সরকারগুলির কার্যাবলীতে হস্তক্ষেপের সমান। তাঁরা আরও জানান যে, সংবিধান বা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি দ্বারা প্রণীত কোনো প্রাসঙ্গিক বিধানের অনুপস্থিতিতে, কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের অংশ নন, এমন কোনও ব্যক্তির জড়িত থাকা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া ভারত ইউনিয়নের পক্ষে দাঁড়ানো আইনজীবী বলেন, সিভিল সার্ভিস বোর্ড তৈরি হলে প্রশাসনিক কার্যাবলী পরিচালনায় সৃষ্টি হবে এবং বেসামরিক কর্মচারীদের দক্ষতাকে সেটি প্রভাবিত করতে পারে।

এইরকম দীর্ঘ সওয়াল জবাবের পর সুপ্রিম কোর্ট এই টি এস আর সুব্রামানিয়ান বনাম ভারত মামলা থেকে উঠে আসা বিষয়গুলিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে তবেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল। ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট এই মামলার রায় ঘোষণা করেছিল। এই মামলার বিচারের প্রধান দায়িত্ব ছিল কে এস রাধাকৃষ্ণণের ওপর এবং সঙ্গে ছিলেন বিচারপতি পিনাকী চন্দ্র ঘোষ।

প্রথম, সিভিল সার্ভিস বোর্ড গঠন বিষয়ে আদালতের বক্তব্য ছিল যে, কোনো অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, তিনি যতই বিশিষ্ট হোন না কেন, বেসামরিক কর্মচারীদের বদলি,পদায়ন, শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা, স্থগিতাদেশ, পুনর্বহাল ইত্যাদির নির্দেশনা দেবেন না, যদি না সংসদ বা রাজ্য আইনসভা দ্বারা প্রণীত আইন দ্বারা তা সমর্থিত হয়। পরিবর্তে আদালত কোনো কর্মরত উচ্চপদস্থ অফিসার, যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, মূলত কেন্দ্রে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি এবং রাজ্যে মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে সিভিল সার্ভিস বোর্ড গঠনের কথা বলেছিল। আদালত পরামর্শ দিয়েছিল, যে, সংবিধানের ৩০৮ অনুচ্ছেদের অধীনে সংসদ একটি সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়ন করতে পারে, যা রাজনৈতিক নির্বাহীদের পোস্টিং, বদলি, ইত্যাদি বিষয়ে নির্দেশনা ও পরামর্শ দিতে পারে। সংসদ এরকম আইন না আনা পর্যন্ত তিনমাসের মধ্যে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়ে এই জাতীয় বোর্ড গঠন করার কথাও বলেছিল আদালত।

আদালত এও পর্যবেক্ষণ করে দেখেছিল যে, নূন্যতম নিশ্চিত পরিষেবার মেয়াদ দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সুতরাং কোর্ট কেন্দ্র, রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে তিন মাসের মধ্যে বিভিন্ন বেসামরিক কর্মচারীদের পরিষেবার ন্যূনতম মেয়াদ প্রদানের জন্য যথাযথ নির্দেশ জারি করার নির্দেশ দিয়েছে৷

দ্বিতীয়ত, সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল যে, বেসামরিক কর্মচারীরা মৌখিক বা মৌখিক নির্দেশ, আদেশ, পরামর্শ, প্রস্তাব ইত্যাদির ভিত্তিতে কাজ করতে পারে না এবং প্রশাসনিক ঊর্ধ্বতন, রাজনৈতিক নির্বাহীদের দ্বারা প্রয়োগ করা অন্যায় ও স্বেচ্ছাচারী আচরণের চাপ থেকেও রক্ষা করতে হবে তাঁদের। আদালত স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছিল যে, প্রাতিষ্ঠানিক সততা বজায় রাখার জন্য নির্দেশাবলী রেকর্ড করা প্রয়োজন। ধারা ৪-এর অধীনে প্রতিটি সরকারী কর্তৃপক্ষের রেকর্ড রাখা বিষয়ে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অতএব মৌখিক নির্দেশ বা নির্দেশাবলী যদি রেকর্ড না করা হয় তবে সেই নির্দেশ কাউকে প্রদান করাও যাবে না বলে স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছিল ভারতের সর্বোচ্চ বিচারালয়।

টিএসআর সুব্রামানিয়ান বনাম ভারত মামলা র এই ঐতিহাসিক রায় নিঃসন্দেহে ভারতীয় সংবিধানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছিল এবং বেসামরিক, আমলাতন্ত্রের প্রভূত সংস্কারসাধন করে দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।

আপনার মতামত জানান