ভারতীয় বিচারালয়ের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা হল জেসিকা লাল হত্যা মামলা (Jessica Lal murder case)। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য বিনোদ শর্মার পুত্র সিদ্ধার্থ বশিষ্ঠ ওরফে মনু শর্মা এই হত্যা মামলার প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন। মডেল তথা বারটেন্ডার জেসিকা লালকে গুলি করে হত্যার জন্য মনু শর্মা প্রথমে খালাস পেলেও পরে হাইকোর্টের রায়ে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয় । এই মামলা পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্তও গিয়েছিল৷ ২০২০ সালে মনু শর্মা জেল থেকে মুক্তি পান।
১৯৯৯ সালের ৩০ এপ্রিল মধ্যরাতে প্রায় দুটো নাগাদ কুতুব কলোনেড বার কাম রেস্তোরাঁর বারটেন্ডার জেসিকা লালকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। দিল্লির অন্যতম এক জনপ্রিয় ফ্যাশন ডিজাইনার এবং বিশিষ্ট সমাজদেবী শ্রীমতি বীণা রমানির স্বামী জর্জ ম্যানিহোট বিশ্বভ্রমণের উদ্দেশ্য নিয়ে কানাডায় চলে যাচ্ছিলেন। সেই কারণে জর্জের বিদায়ী সম্বর্ধনা উপলক্ষে একটি পার্টির আয়োজন করেন শ্রীমতি বীণা। সেই পার্টির জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল কুতুব মিনারের নিকটবর্তী একটি রেস্তোরাঁ কুতুব কলোনেডকে। আদতে বীণা রমানিই ছিলেন এই বারের মালিক। সেই বিদায়ী পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন বড় বড় ব্যবসায়ী, ফ্যাশন ডিজাইনার, ফ্যাশন জগতের সমস্ত কেউকেটা ব্যক্তিত্ব। উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য বিনোদ শর্মার পুত্র মনু শর্মাও। রাত দুটো নাগাদ মনু শর্মা-সহ আরও পাঁচ-ছয়জন বারে গিয়ে মদ পরিবেশনের দাবি জানান এবং প্রতি বোতল মদের জন্য ১০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ করার প্রতিশ্রুতি দেন তাঁরা। ওই বারটিতে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত মদ পরিবেশন হওয়ার পর মদের জোগান শেষ হয়ে যায়। ফলে বারটেন্ডার জেসিকা মনু শর্মাদের জানান যে বার বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে আর মদ পরিবেশন করা সম্ভব নয়। পানীয় পরিবেশন করতে অস্বীকার করায় মনু শর্মা প্রচন্ড রেগে ওঠেন জেসিকার ওপর। এতখানিই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন যে, সঙ্গে থাকা একটি .২২ ক্যালিবার পিস্তল বের করে তিনি প্রথমে নিছক ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিলের জন্য বন্দুকের নল উপরদিকে করে সিলিং-এ গুলি ছোড়েন। এই হুমকি সত্ত্বেও জেসিকা মদ পরিবেশন করতে রাজী না হলে জেসিকার দিকে তাক করেই গুলি চালিয়ে দেন মনু। গুলি জেসিকার মাথায় গিয়ে লাগে এবং তৎক্ষণাৎ তাঁর মৃত্যু হয়। ঘরভর্তি লোক আকস্মিক এই ঘটনায় হতচকিত হয়ে যান। এই ঘটনার পর মনু শর্মা পালিয়ে যান ঘটনাস্থল থেকে। পরে তদন্তে জানা যায়, ঘটনার সময়ে মনু শর্মার সঙ্গী হিসেবে ঐ বারে উপস্থিত ছিলেন বিকাশ যাদব, অমরদীপ সিং গিল, অলোক খান্না।
এই হত্যার পরে মনু শর্মার পরিবারের সঙ্গে পুলিশের তরফে কোনোরকমভাবে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি কারণ মনু সহ তাঁর পুরো পরিবার এই ঘটনার পর থেকে ফেরার হয়ে যায়। কিছুদিন পরে ৪ মে অলোক খান্না ও অমরদীপ সিং গিলকে এবং ৬ মে সহযোগীদের সহায়তায় মনু শর্মাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এছাড়াও এই ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিকাশ যাদবও (রাজনীতিবিদ ডিপি যাদবের পুত্র) পলাতক ছিলেন। মনু শর্মার আরেক সহযোগী অমিত ঝিংগানকে প্রমাণ নষ্ট করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত করে ৮ মে গ্রেপ্তার করা হয়। সেদিনই রমানি, তাঁর স্বামী এবং মেয়ে মালিনীকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ তাদের বিরুদ্ধে একটি অবৈধ বার পরিচালনার অভিযোগ আনা হয়। শেষ অবধি তাঁরা জামিনে মুক্তি পেলেও তাঁদের পাসপোর্ট সমর্পণ করতে হয়েছিল। তাছাড়া ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা রক্ত দ্রুত সাফাই করে প্রমাণ গোপনের চেষ্টা করেছিলেন রমানী, এমন সন্দেহও করা হয়।
এরপর জেসিকা লাল হত্যা মামলা দিল্লি ট্রায়াল কোর্টে স্থানান্তরিত হয়। দিল্লি ট্রায়াল কোর্টের অতিরিক্ত দায়রা বিচারক ২৩ নভেম্বরে মনু শর্মাকে ধারা ৩০২, ২০১, আইপিসি ১২০ বি এবং ২৭ ধারার অস্ত্র আইনের অধীনে অভিযুক্ত করেন। অভিযুক্ত অমরদীপ সিং গিলকে আইপিসি ২০১ ও ১২০ ধারার অধীনে, বিকাশ যাদবকে ধারা ২০১ ও ১২০-এর অধীনে, মনু শর্মার সঙ্গী হরবিন্দর চোপড়া, বিকাশ গিল, যোগরাজ সিং এবং রাজা চোপড়াকে ২১২ ধারার অধীনে অভিযুক্ত করা হয়। এছাড়াও অভিযুক্ত ছিলেন অলোক খান্না, শ্যাম সুন্দর শর্মা, রবিন্দর কৃষাণ সুদান, ধনরাজ এবং অমিত ঝিংগান। দিল্লি পুলিশ হত্যার জন্যে ব্যবহৃত পিস্তলটিকে খুঁজে না পাওয়ায় ট্রায়াল কোর্ট মনু শর্মা-সহ বারোজন অভিযুক্তদের মধ্যে নয়জনকে খালাস দিয়ে দেয়।
এই মুক্তির ঘোষণা কিন্তু গণমাধ্যম এবং জনমানসকে উত্তপ্ত করে তোলে। দোষীদের শাস্তির বিরুদ্ধে ক্রমাগত চাপ তৈরি করতে থাকে মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষের একটি বৃহৎ অংশ। এরপরেই ‘জাস্টিস ফর মিস জেসিকা লাল’ নামে প্রচার শুরু হয়ে যায়। মোমবাতি মিছিল চলতে থাকে জেসিকার হত্যার সুবিচার চেয়ে।
তীব্র জনরোষের চাপে পড়ে পুলিশ জেসিকা লাল হত্যা মামলা পুনর্বিবেচনার জন্য হাইকোর্টে আবেদন করে এবং ২০০৬ সালের ২২ মার্চ আদালত বিচারাধীন নয় আসামির বিরুদ্ধে পুনরায় ওয়ারেন্ট জারি করে। তেহেলকা নামে নিউজ ম্যাগাজিন গোপনে একটি স্টিং অপারেশন করেছিল এই মামলার সঙ্গে জড়িত সাক্ষীদের নিয়ে। ৯ সেপ্টেম্বর তা সম্প্রচারিত হয় টিভিতে। সাক্ষীরা স্টিং অপারেশনে স্বীকার করেছিল যে বিচার চলাকালীন তাদের ঘুষ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল৷ এমনকি মূল অভিযুক্ত যিনি এই ঘটনার, তাঁর একটি অডিও রেকর্ডিংও ফাঁস হয়ে যায়। সেখানে তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, জেসিকার কাছে মদ চেয়ে না পাওয়ায় তাঁকে গুলি করে মারার জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
অবশেষে ২০০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর হাইকোর্ট প্রমাণের ভিত্তিতে মনু শর্মাকে দোষী সাব্যস্ত করে। সেইসঙ্গে হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের বিচার পদ্ধতিরও সমালোচনা করে। ২০ ডিসেম্বর হাইকোর্ট মনু শর্মাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেয় এবং ৫০,০০০ টাকা জরিমানা ঘোষণা করে। অন্যদিকে বিকাশ যাদব এবং অমরদীপ সিং গিলকে ৩০০০ টাকা জরিমানাসহ চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে আদালত। মনু শর্মার মৃত্যুদণ্ডেরর আর্জি অবশ্য নাকচ করে দেয় আদালত কারণ এই হত্যা ইচ্ছাকৃত হলেও পূর্বপরিকল্পিত ছিল না এবং মনু শর্মার এমন কোনো রেকর্ড ছিল না যাতে তাঁকে সমাজের জন্য ক্ষতিকারক বলে মনে হতে পারে।
জেলে থাকাকালীন বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে মনু শর্মাকে ২০০৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ৩০ দিনের সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছিল অসুস্থ মাকে এবং পারিবারিক ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে উপস্থিত থাকার জন্য। ১০ নভেম্বর আবার তিহার জেলে ফিরে আসেন তিনি৷ এরপরেও অবশ্য আরও কয়েকবার এমন শর্তাধীন মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি৷।
জেসিকা হত্যা মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। ২০১০ সালের ১৯ এপ্রিল সর্বোচ্চ আদালত জানায় যে হাইকোর্ট জেসিকা মামলার সব তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছে, অতএব মনু শর্মার যাবজ্জীবনের শাস্তিকেই মঞ্জুর করে সুপ্রিম কোর্ট। মনু শর্মার আইনজীবী রাম জেঠমালানি অবশ্য তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে মিডিয়ার প্রচারকে সমালোচনা করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট মিডিয়ার সক্রিয়তাকে মেনে নিয়েও জানায় হাইকোর্টের রায়ে মিডিয়ার কোনোরকম প্রভাব পড়েনি।
কারাবাসের সময় মনু শর্মার আচরণ ছিল প্রশংসনীয়। এমনকি জেলে থাকার সময় অনেক সামাজিক কাজের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সিদ্ধার্থ বশিষ্ঠ চ্যারিটেবল ট্রাস্ট। একটি সংবাদ সাক্ষাৎকারে জেসিকার বোন সাবরিনা লাল, যিনি এই মামলার একজন প্রধান যোদ্ধা ছিলেন, তিনি জানান জেসিকা লালের হত্যাকারী মনু শর্মাকে তিনি ক্ষমা করেছেন এবং তিহার জেল থেকে তাঁর মুক্তির বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই তাঁর। সামাজিক নানা কাজে যোগদান, মনু শর্মার আচরণের পরিবর্তন ইত্যাদি লক্ষ্য করেই সাবরিনা লাল এরূপ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
অবশেষে ২০২০ সালের ১১ মে দিল্লির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী সত্যেন্দ্র জৈনের সভাপতিত্বে দিল্লি সেন্টেন্স রিভিউ বোর্ড (এসআরবি) মনু শর্মার মুক্তির সুপারিশ করে। এসআরবি-এর সুপারিশে দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অনুমোদন পাওয়ার পর এবং সাবরিনা লালের কোনো আপত্তি না থাকায় মনু শর্মা অবশেষে ২০২০ সালের ২ জুন তিহার জেল থেকে মুক্তি পান। যদিও মনু শর্মার মুক্তিকে অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি।
২০১১ সালে এই হত্যা মামলাকে কেন্দ্র করে নির্মিত রানী মুখার্জী এবং বিদ্যা বালন অভিনীত ছবি ‘ নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ মুক্তি পায়।