মহাভারত

শান্তনু রাজা এবং গঙ্গা

শান্তনু আর গঙ্গা স্বর্গেই বাস করছিলেন। কিন্তু একটি ঘটনার পর ব্রহ্মার শাপে স্বর্গচ্যুত হয়ে মর্ত্যে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। মর্ত্যে তারা স্বামী-স্ত্রী রূপে বেশ কিছুকাল জীবনযাপন করেছিলেন।

শাপের কারণ ছিল একদিন স্বর্গে যখন বায়ুর প্রভাবে গঙ্গার সূক্ষ্ম বস্ত্র সরে যায়,তখনও মহাভিষ নামক ইক্ষবাকুবংশীয় রাজা (যিনি বহু যজ্ঞ করে স্বর্গে যান) গঙ্গাকে দেখছিলেন, অন্যান্য দেবতারা যেখানে মুখ নিচু করে বসেছিলেন, সেখানে মহাভিষ  নিঃসঙ্কোচে গঙ্গাকে দেখছিলেন। ফলস্বরূপ তার কপালে জুটল অভিশাপ। এত যজ্ঞ করে যে স্বর্গে এসে এই কাজের জন্য ব্রহ্মা তাকে অভিশাপ দিলেন তিনি মর্ত্যে জন্ম বেনে। স্থির হল  মহাভিষ ভরতবংশে রাজা প্রতীপের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করবেন।

একদিন গঙ্গাতীরে বৃদ্ধ প্রতীপ জপ করছিলেন যখন, তখনই গঙ্গা নারীরূপে তার ডান ঊরুতে এসে বসলেন। প্রতীপ যখন জিজ্ঞেস করলেন তাকে ,”তুমি কি চাও?”
“হে কুরুবংশীয় মহাবীর! আমি তোমাকে চাই”, গঙ্গা উত্তর দিলেন তাকে।
কিন্তু শাস্ত্র অনুসারে পুরুষের বাম ঊরুতে স্ত্রীর স্থান এবং ডান ঊরুতে পুত্র, কন্যা ও পুত্রবধূর স্থান। সেই হিসাবে গঙ্গাকে তিনি পত্নী হিসাবে গ্রহণ করতে পারবেন না, বরং পুত্রবধূ হিসাবে গ্রহণ করতে পারবেন। গঙ্গা রাজি হলেন, শুধু একটি শর্ত ছিল তাঁর। তাঁর হবু স্বামী তাকে কোনও কাজে বাধা দেবেন না। প্রতীপ কথা দিলেন “ঠিক আছে, তাই হবে।”
এরপরে মহাভিষ রাজার পুত্র হিসাবে জন্ম নিলেন।  ছেলের নাম রাখা হল শান্তনু। শান্তনু বড় হলে একদিন প্রতীপ তাকে বললেন, “তোমায়  বিয়ের জন্য এক সুন্দরী কন্যা আগেই আমার কাছে এসেছিল। আমি তাকে কথা দিয়েছি সেই তোমার স্ত্রী হবে। তুমি তাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ কোরো এবং তাঁর কোন কাজে কখনও বাধা দিয়ো না।”

একদিন শান্তনু মৃগয়া করে ক্লান্ত হয়ে গঙ্গার পাড়ে বসেছিলেন, তখনই দেখতে পেলেন গঙ্গাকে। তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে রাজা তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। গঙ্গা রাজি হলেন, কিন্তু তাঁর শর্ত জানালেন রাজাকে, “আমি যেই কাজই করি না কেন, তা যত ভালই হোক বা খারাপ হোক, আপনি আমায় বাধা দেবেন না,  বাধা দিলে তখনই আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাব।” রাজা রাজি হলেন।  শান্তনু আর গঙ্গার বিবাহ সম্পন্ন হল। বিবাহের পর অনেকদিন অবধি দুজনে সুখে দিনযাপন করতে লাগলেন। সমস্যা হল তাদের সন্তান জন্মানোর পর।

তাঁদের সন্তান জন্মালে গঙ্গা সেগুলো ভাসিয়ে দিতেন জলে। গঙ্গাকে বাধা দিলে গঙ্গা চলে যেতে পারে এই ভয়ে শান্তনু কিছু বলতেন না। কিন্তু নিজের পুত্রদের চোখের সামনে এভাবে জলে ভাসিয়ে দিতে দেখে তাঁর মন কেঁদে উঠত। ভেতরে ভেতরে ছটফট করতেন তিনি। এভাবে সাত সাতটা পুত্রকে চোখের সামনে জলে ভেসে যেতে দেখলেন, দেখলেন কিভাবে সদ্যোজাত সন্তানের জননী নিজের পুত্রকে ভাসিয়ে দিচ্ছে জলে। এই নিষ্ঠুর দৃশ্য রাজা দেখলেন সাত সাতবার। কিন্তু অষ্টম পুত্রকে তিনি ভাসাতে দিলেন না। বাধা দিলেন গঙ্গাকে, “তোমার মনে কি এতটুকু করুণা নেই? স্নেহ নেই? কি নিষ্ঠুর তুমি? কেন এভাবে হত্যা করছ এইটুকু শিশুকে?” গঙ্গা রাজাকে কারণ বললেন। কিন্তু বিবাহের পূর্বের শর্ত অনুযায়ী তিনি রাজাকে ছেড়ে চলে গেলেন, অষ্টম পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন।

গঙ্গা শান্তনুকে ছেড়ে চলে যাবার পর রাজা ছত্রিশ বছর স্ত্রীসঙ্গ পরিত্যাগ করে বনগামী হয়েছিলেন। একদিন সেই গঙ্গাতীরেই একজন বালককে দেখে তাঁর মনে পিতৃস্নেহ জেগে উঠল। পরে তিনি  বুঝলেন এ পুত্র তারই। গঙ্গা মানুষ করেছে তাকে। এই পুত্রের নাম দেবব্রত, পরে যিনি ভীষ্মরূপেই বেশি পরিচিত হয়েছিলেন। গঙ্গা দেবব্রতর শিক্ষা সম্পূর্ণ করিয়ে শান্তনুর হাতে তুলে দিলে, শান্তনু দেবব্রতকে যুবরাজপদে বসিয়ে দিলেন।

তথ্যসূত্র


  1. "মহাভারত সারানুবাদ", দেবালয় লাইব্রেরী(প্রকাশক সৌরভ দে, তৃতীয় প্রকাশ) - রাজশেখর বসু, আদিপর্ব (১৫। মহাভিষ-অস্তবসু-প্রতীপ-শান্তনু-গঙ্গা) পৃষ্ঠাঃ ৩৬-৩৭
  2. "মহাভারতের একশোটি দুর্লভ মুহূর্ত", আনন্দ পাবলিশার্স, পঞ্চম মুদ্রণ - ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যায় ১০- ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা (আজ হতে এ বিশ্বের সমস্ত রমণী আমার জননী), পৃষ্ঠাঃ ৫৭-৬০

 

2 comments

  1. Sei saat jon holen saat bosu…..ashto bosu “dyu” holen arek obhisapgrosto bosu….jar paap sorbadhik chilo bole take prthibite besi din tbakte hoechilo…..bakider beai din prithibite thakte hyni…

আপনার মতামত জানান