সববাংলায়

আ্যডলফ হিটলার

আ্যডলফ হিটলার( Adolf Hitler) ছিলেন একজন জার্মান রাজনীতিক ও স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ক। তিনি জার্মানির নাৎসি পার্টির নেতা ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা তাঁর হাত ধরেই হয়েছিল। তাঁর নেতৃত্বে ষাট লক্ষ ইহুদি সহ প্রায় এক কোটি দশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়। ইতিহাসের পাতায় কুখ্যাত স্বৈর স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে তিনি পরিচিত।

১৮৮৯ সালের ২০ এপ্রিল অস্ট্রিয়ার ব্যাভেরিয়ার ‘ব্রনাউ-আম-ইন’ নামে এক মফস্বল শহরে হিটলারের জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম আ্যডলফ হিটলার। তাঁর বাবার নাম আ্যলয়েস হিটলার এবং মায়ের নাম ক্লারা পলজি। আ্যলয়েস হিটলারের তৃতীয় স্ত্রী’র ছয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থ সন্তান ছিলেন আ্যডলফ হিটলার। বাবার সঙ্গে হিটলারের সুসম্পর্ক ছিল না। তবে তিনি মা’কে ভালোবাসতেন ও শ্রদ্ধা করতেন। ছয় বছর বয়সে তিনি স্থানীয় অবৈতনিক স্কুলে ভর্তি হন। ভাই এডমণ্ডের অকাল মৃত্যু আ্যডলফ হিটলারকে একগুঁয়ে, জেদি আর রগচটা করে তোলে। পড়াশোনার থেকে ছবি আঁকতে বেশি ভালবাসতেন তিনি। চেয়েছিলেন নামী শিল্পী হতে। কিন্তু বাবা চেয়েছিলেন ছেলে তাঁর মতই কাস্টমসের চাকরি করুক। হিটলার চেয়েছিলেন কোন ক্লাসিক্যাল স্কুলে ভর্তি হতে যেখানে সে চিত্রকলা শিখতে পারে। তাঁর বাবা কিন্তু হিটলারকে জোর করেই একটি সাধারণ স্কুলে ভর্তি করে দেন। হিটলার এর প্রতিবাদে ভেতরে ভেতরে ঠিক করে নেন যে স্কুলের পরীক্ষায় তিনি খারাপ ফল করবেন যাতে বাবা বুঝতে পারেন তাঁর ক্ষেত্র এটা ছিলনা।

১৯০৩ সালে আ্যডলফ হিটলারের বাবার মৃত্যু হয়। তারপর ১৯০৭ সালে মা’ও মারা যান। অনাথ হিটলার সংসারের সব বন্ধন ছিঁড়ে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। প্রথমে তিনি ভিয়েনাতে আসেন। সেখানে কখনো মজুরের কাজ করে কখনও ছবি আঁকার রঙ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতেন। এই ভিয়েনাতে থাকাকালীন সময়েই তাঁর মনের মধ্যে প্রথম জেগে উঠে ইহুদিবিদ্বেষ। সেই সময়ে জার্মানির অধিকাংশ কলকারখানা সংবাদপত্রের মালিক ছিলেন ইহুদীরা। দেশের অর্থনীতির অনেকখানি ইহুদীরা নিয়ন্ত্রণ করত।ইহুদীদের এই প্রাধান্য হিটলার কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। ১৯১৩ সালে তিনি ভিয়েনা ছেড়ে চলে এলেন মিউনিখে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হলে হিটলার সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধের পুরো সময়টায় তিনি সামনে থেকে জার্মানির হয়ে লড়ে গেছেন। যুদ্ধে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘সেকেন্ড ক্লাস আয়রন ক্রস’ লাভ করেন। পরে তাঁকে ‘ফার্স্ট ক্লাস আয়রন ক্রস’ দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন:  অনন্ত প্রসাদ শর্মা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি হেরে যায়। এইসময় হিটলার ‘জার্মান ওয়ার্কার্স’ পার্টিতে সামরিক রাজনৈতিক এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। দলের ভেতর নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার জন্য তিনি সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন। ১৯২০ সালে এই দলের নাম পরিবর্তন করে ‘ন্যাশনাল ওয়ার্কার্স পার্টি’ বা ‘নাৎসি পার্টি’ নাম দেওয়া হয়। হিটলার স্বস্তিক চিহ্ন যুক্ত দলের পতাকা প্রকাশ করেন । ক্রমে নাৎসি দলের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং এই দল জার্মান রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। ১৯২৪ সাল নাগাদ হিটলার প্রায় এক বছর কারাবন্দী ছিলেন। এই কারাবন্দী থাকাকালীন সময়ে তিনি তাঁর সহকারীকে দিয়ে তাঁর আত্মজীবনী ‘মেই ক্যাম্ফ’ (Mein kampf) রচনা করেন।

১৯৩৩ সালের নির্বাচনে নাৎসি পার্টি’ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। এরপরই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য হিটলার বিরোধীদলের বিরুদ্ধে নানান চক্রান্ত শুরু করেন। অনেকেই খুন হন অনেকে মিথ্যে অভিযোগে জেলে যান এই সময়ে। বিরোধী দলের মধ্যে তিনি বিশৃঙ্খলা তৈরি করে দেন। ফলত অল্প সময়ের মধ্যেই নাৎসি বাহিনী তথা হিটলারই হয়ে উঠলেন জার্মানির সর্বেসর্বা। হিটলার হয়ে উঠলেন জার্মানির চ্যান্সেলর।

সমগ্র জার্মানি জুড়েই ইহুদি বিদ্বেষ ক্রমেই বাড়ছিল। হিটলার ক্ষমতায় এসে তাকে আরও তীব্র করে তুললেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর মিত্র পক্ষ ও জার্মানদের মধ্যে যে ‘ভার্সাই চুক্তি’ হয়েছিল তাতে প্রকৃতপক্ষে জার্মানির সমস্ত ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছিল। হিটলার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জার্মানির হারিয়ে যাওয়া গৌরব পুনরুদ্ধার করার সংকল্প গ্রহণ করেন। ১৯৩৩-৪৫ সাল পর্যন্ত হিটলার ছিলেন জার্মানীর চ্যান্সেলর। তিনি ভার্সাই চুক্তির শর্তগুলো অস্বীকার করে নিজের শক্তি ও ক্ষমতার ব্যাপারে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। হিটলার দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে বেশি মনোযোগী হলে এবং কিছুদিনের মধ্যেই ভার্সাই সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করে সুডেটেনল্যান্ড অধিকার করলে অস্ট্রিয়া ও ইতালি জার্মানির সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়।

হিটলার পোল্যান্ডের কাছে ডানজিগ ও ‘পোলিশ করিডোর’ (Polish Corridor) দাবি করলেন যাতে ওই অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে পারেন। পোল্যান্ডের সরকার তাঁর এই দাবি প্রত্যাখ্যান করলে হিটলার ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। ১৯৩৯ সালে জার্মান বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করার দিনটি থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এর দুদিনের মধ্যে ৩ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও নিজেদের নিরাপত্তার কারণে জার্মানির ওপর কোনো আক্রমণ করেনি। মাত্র পনের দিনে জার্মান বাহিনী ও সোভিয়েত রাশিয়ার মিলিত আক্রমণে পোল্যান্ডের পতন হয়। পোল্যান্ডের পর নাৎসি বাহিনী ওরফে (থার্ড রেইখ) নরওয়ে ও ডেনমার্ক দখল করে। ইতিমধ্যে নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হলেন চার্চিল। এরপর হিটলার ফ্রান্স দখল করেন। এই সময় ইতালি নিজেকে জার্মানদের মিত্র পক্ষ হিসেবে ঘোষণা করে ।ফ্রান্স অধিকার করার পর জার্মানরা যুগোস্লাভিয়া অধিকার করে। ইতিমধ্যে রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরী জার্মানির পক্ষে যোগ দেয়। ফলে সমগ্র দক্ষিণ ইউরোপ জার্মানির নিয়ন্ত্রণে এসে যায়।

আরও পড়ুন:  ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী

বিশ্বের ইতিহাসে যখন জার্মান বাহিনী একের পর এক দেশ অধিকার করে চলেছে তখন দেশের অভ্যন্তরে হিটলার শুরু করেছেন ইহুদি নিধন যজ্ঞ। পৃথিবীর ইতিহাসে এই নৃশংসতার কোন তুলনা নেই। হিটলার চেয়েছিলেন জার্মানিকে ইহুদি শূন্য করে তুলতে।প্রথমদিকে হাজার হাজার ইহুদিকে বন্দি করে জনবসতিহীন সীমান্ত অঞ্চলে পাঠানো হত যেখানে কোনো খাবার বা পানীয় জলের বন্দোবস্ত থাকত না। এর সাথে যোগ হত হিটলারের বাহিনীর নির্মম অত্যাচার। অল্পদিনের মধ্যেই বহু ইহুদি মারা যেত। যাঁরা বেঁচে থাকত তাদের গুলি করে হত্যা করা হত। শিশু, বৃদ্ধ, নারী কেউই রেহাই পেত না। হাজার হাজার ইহুদিকে হত্যা করতে যে বিরাট পরিমাণ গুলি খরচ হত তাতে জার্মান কর্তৃপক্ষ চিন্তিত হয়ে পড়ে। তাই নতুন উপায় বের করা হল। হিটলারের আদেশে তৈরি হল আউশভিৎস কনসেনট্রেশন ক্যাম্প(Auschwitz concentration camp )। এই ক্যাম্পে তৈরি হল কুখ্যাত ‘গ্যাস চেম্বার’। চারদিকে বন্ধ একটা ঘরে কয়েকশো ইহুদিকে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস ছাড়া হত। এর ফলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই বিষাক্ত গ্যাসে মারা যেতেন সকলে। সীমান্ত অঞ্চলে বিরাট বিরাট গর্ত করে তাঁদের মৃতদেহগুলো ছুঁড়ে ফেলা হত। এভাবে তিন বছরে প্রায় ষাট লাখ ইহুদি হত্যা করেছিল হিটলার এবং তাঁর বাহিনী।

১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দরে ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে বিধ্বস্ত করে ফেলে সমগ্র বন্দরটি। এই ঘটনায় আমেরিকা প্রত্যক্ষভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মিত্র শক্তির সম্মিলিত বাহিনীর কাছে ক্রমেই হিটলার বাহিনীর পরাজয় ঘটতে থাকে। জার্মান বাহিনীর সবচেয়ে বড় পরাজয় হল রাশিয়ার স্টালিনগ্রাদে। দীর্ঘ ছ’ মাস যুদ্ধের পরে রাশিয়ান ফৌজ এর কাছে জার্মান বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল। জার্মান বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে হিটলারের অনেক সেনাপতি হিটলারকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে কিন্তু তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।হিটলার ক্রমশই সঙ্গী-সাথীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকেন। সকলের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। বেশিরভাগ সময়ই বাঙ্কারে থাকতেন তিনি। এই সময় তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিলেন তাঁর দীর্ঘদিনের প্রেমিকা ইভা ব্রাউন।

আরও পড়ুন:  রবিশঙ্কর

১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ বাঙ্কারের মধ্যে হিটলার নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করলেন। তার আগেই তাঁর প্রেমিকা ইভা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পূর্ব নির্দেশ মত তাঁর দেহ আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

বাদল সরকারের জীবনী দেখুন

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন