বীরভূম

বীরভূম নাম হল কিভাবে

পশ্চিমবঙ্গের ২৩টি জেলার মধ্যে  বীরভূম একটি অন্যতম জেলা।বর্ধমান বিভাগের অন্তর্গত এই জেলার পশ্চিমে ঝাড়খণ্ডের জামতাড়া, দুমকা ও পাকুড় জেলা এবং অন্য তিন দিকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, পূর্ব বর্ধমান ও পশ্চিম বর্ধমান জেলা অবস্থিত।

এই জেলার নাম ‘বীরভূম’ কিভাবে হল  সেই প্রসঙ্গে কোন ঐতিহাসিক সাক্ষ্য প্রমাণ না পাওয়া গেলেও বীরভূম নামটির উৎপত্তি বিষয়ে বেশ কিছু জনশ্রুতি জনমানসে প্রচলিত আছে।

যেমন একটি মত অনুসারে বীর যোদ্ধাদের দেশ হিসেবে প্রাচীনকালে বীরভূমের বেশ নাম ডাক ছিল। এখানকার আদি বাসিন্দারা বিভিন্ন শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে করতে ক্রমশ যুদ্ধ শাস্ত্রে সুনিপুণ হিয়ে উঠেছিল বলে মনে করা হয়। ‘দিগ্বিজয় প্রকাশ’ নামক একটি গ্রন্থে রাঢ় অঞ্চলের সীমানা নির্দেশ করে বলা হয়েছেঃ

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

গৌরস্য পশ্চিমে ভাগে বীরদেশস্য পূর্ব্বত‍‍‌‌
দামো দরোত্তরে ভাগে রাঢ়দেশঃ প্রকীর্তত।

একথা মনে করাই যেতে পারে এই বীরদেশই আজকের বীরভূম।এই জেলার রাজধানী সিউড়ি ‘শৌর্য’ শব্দের অপভ্রংশ।

আরও একটি  জনশ্রুতি অনুযায়ী বিষ্ণুপুরের রাজা একবার শিকারে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নিজের রাজ্যের বাইরে পাথরে ভর্তি এক সীমান্ত প্রদেশে প্রবেশ করেন।সেখানে একটি বক দেখতে পেয়ে তাকে শিকার করার উদ্দেশ্যে নিজের নিজের শিকারি বাজ পাখিটিকে বকের উদ্দেশ্যে উড়িয়ে দেন।কিন্তু বক বাজটির দিকে এমন সাহসের সাথে তেড়ে আসে যে রাজা নিরীহ বকের এরকম সাহস দেখে বিস্মিত হন এবং ভাবতে থাকেন সামান্য পাখিই যদি এত সাহসী হয়, তাহলে এখানকার অধিবাসীরা কতই না পরাক্রমশালী।এইভাবে তিনি সেই দেশের নাম দেন বীরভূম।

বীরভূম নামের মত একই ধাঁচের নাম বেশ কয়েকটি জেলায় লক্ষ করা যায়।যেমন মানভূম, মল্লভূম ধলভূম, সিংভূম ইত্যাদি।অনুমান করা হয় মল্ল দের বিভিন্ন সম্প্রদায় কালে কালে মল্লভূমি থেকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে যে যার নিজের নাম অনুসারে মানভূম সিংভূম বীরভূম প্রভৃতি বিভাগ সৃষ্টি করেছিল।

কথিত আছে ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দের আগে এবং পরে সুবর্ণগ্রাম ও লক্ষ্মনাবতীর শাসনকর্তা দীর্ঘদিন ধরে পরস্পর বিবাদে জড়িয়ে ছিলেন । এই রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ‘বীর’ উপাধিধারী এক হিন্দু বীরভূমের পুরনো রাজধানী লক্ষুরে (বর্তমান রাজনগর) আধিপত্য স্থাপন করেছিলেন।এই বীর রাজার নামেই ‘বীরভূম’ নামের সৃষ্টি হয়েছে।

আবার আরেকটি সূত্র অনুসারে আজ থেকে সাত-আটশ বছর আগে পশ্চিম প্রদেশ থেকে বীর সিংহ ও চৈতনা সিংহ নামে দুই ভাই এই অঞ্চলে এসে অসভ্য আদিবাসীদের পরাজিত করেছিলেন। বীরসিংহপুরে নিজের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন বীর সিংহ। এই বীর সিংহই বীরভূমের আদি হিন্দু ক্ষত্রিয় রাজা। এই বীর সিংহ রাজার নাম থেকেই ‘বীরভূম’ নামের কথা কেউ কেউ বলে থাকেন।

বল্লাল সেনের সীতাহাটি তাম্র শাসন থেকে জানা যায়- বীরসেন নামে এক চন্দ্রবংশীয় রাজা ছিলেন। তার  বংশেই সামন্ত সেন বিজয় সেন, বল্লাল সেন ইত্যাদি সেন রাজগণ জন্ম গ্রহণ করেন। অনেকে মনে করেন এই সেন রাজরাই তাদের পূর্ব পুরুষের নাম অনুসারে বীরভূম নাম রাখেন।

কেউ বলেন এই অঞ্চলে বীর নামে এক ধরণের ঘাস প্রচুরহারে জন্মাতো। সেখান থেকেই এই নাম।অনেকে আবার বলে থাকেন সাঁওতালি ভাষায় ‘বির’ শব্দের অর্থ জঙ্গল।সেখান থেকেই এই জঙ্গলময় স্থান বীরভূম হয়েছে।

সুপ্রাচীন বিভিন্ন গ্রন্থগুলিতে বীরভূমকে সব জায়গাতেই রাঢ়দেশ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বীরভূম নামের উদ্ধৃতি মহেশ্বরের কুলপঞ্জিকাতে প্রথম পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের ধারণা অনুযায়ী উত্তর রাঢ় অংশের বীরভূম নামকরণ মহেশ্বরের কুলপঞ্জিকা লেখার সময় খুব সম্ভবত ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যে কার্যকর হয়েছিল।

আপনার মতামত জানান