শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (Shyama Prasad Mukhopadhyay) ছিলেন একজন ভারতীয় পন্ডিত ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা। তিনি প্রথম হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ‘ভারতীয় জনসংঘ’ গঠন করেন। ছিলেন হিন্দু মহাসভার সভাপতি এবং জহরলাল নেহেরুর ক্যাবিনেটের অন্যতম মন্ত্রী তিনি ।
১৯০১ সালের ৬ জুলাই কলকাতায় এক উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর বাবা ছিলেন ‘বাংলার বাঘ’ স্যার আশুতোষ মুখার্জী ও মা শ্রীমতী যোগমায়া দেবী। শ্যামাপ্রসাদের পরিবারের আদি নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার জিরাট গ্রামে। পরবর্তীকালে কলকাতার ভবানীপুরে বসতি স্থাপন করেন তাঁরা।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯২১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বিএ ডিগ্রি লাভ করার পর নিজের মাতৃভাষায় অর্থাৎ বাংলা ভাষায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ১৯২৪ সালে বি.এল পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ স্থান লাভ করেন।
১৯২২ সালে ২১ বছর বয়সে সুধাদেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে এক সন্তান অল্প বয়সেই মারা যায়। শ্যামাপ্রসাদের যখন ৩৩ বছর বয়স তখন তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। কিন্তু তিনি আর বিয়ে করেননি।
ছাত্রাবস্থা থেকেই শ্যামাপ্রসাদ তাঁর উপাচার্য বাবাকে শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করতেন। ১৯২৩ সালে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সংস্থা সেনেটে তিনি নির্বাচিত হন। এই সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। এমনকি তাঁর পড়াশোনার পাটও তখনও শেষ হয়নি। ১৯৩৪ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনিষ্ঠতম উপাচার্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য থাকাকালীন অনেক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। এই সময় তাঁর উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে নতুন শাখায় পড়াশোনা শুরু হয়। মহিলাদের জন্য বিশেষ পাঠক্রম এবং গৃহ বিদ্যার পাঠ্য দান তাঁর সময়ে শুরু হয়। এছাড়াও কৃষিবিদ্যা, চৈনিক ও তিব্বতি ভাষার চর্চা ইত্যাদি বিষয় এই সময়ে চালু হয়। স্কুল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিতেও তিনি আলোকপাত করেছিলেন। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হল, ইংরেজি মাধ্যমের আধিপত্য ভেঙে বাংলা মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তিনি ‘বিশিষ্ট প্রফেসর’ হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম বাংলা ভাষায় সমাবর্তনী ভাষণ দিয়েছিলেন। তবে শুধুমাত্র বাংলা ভাষাকেই না, হিন্দি, উর্দু, অসমীয়া প্রভৃতি ভাষাকেও যথেষ্ট প্রাধান্য দিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, জনস্বাস্থ্য, পরীক্ষামূলক মনস্তত্ত্ববিদ্যা, অংক এবং এরোনটিক্স শাখার পঠন-পাঠন শুরু হয়েছিল তাঁরই প্রয়াসে। ১৯৩৮ সালে ৮ আগস্ট উপাচার্য হিসেবে তাঁর সময়সীমা শেষ হয়ে যায়। এই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট তাঁকে সাম্মানিক ‘ডি লিট’ ডিগ্রি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক জীবনেও উচ্চ আদর্শবাদের প্রভাব দেখা যায়। ১৯২৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনী এলাকা থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত হন। পরিষদে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু ১৯৩০ সালে কংগ্রেস প্রতিবাদ জানিয়ে পরিষদ বর্জনের ডাক দিলে তিনি পদত্যাগ করেন। পরে নির্দল প্রার্থী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি পুননির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে তিনি প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচনে লড়েন। ১৯৩৫ সালের গভর্মেন্ট অফ ইন্ডিয়া বা ভারত সরকারের আইন অনুযায়ী এই নির্বাচন হয়েছিল এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই নির্বাচনে জয়লাভ করেন। কংগ্রেস সেইসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে থাকলেও বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সরকার গঠনে রাজি হয়নি। ফলে তিনি এ.কে.ফজলুল হক এর সঙ্গে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এক্ষেত্রে হক ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ। এই সময় বীর সাভারকার তাঁর ওপর গভীর প্রভাব সৃষ্টি করে। তিনি হিন্দু মহাসভায় যোগদান করেন এবং ১৯৩৯ সালে এর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হন। ঠিক তার পরের বছরেই কার্যনির্বাহী সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হয় তাঁকে। ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।
১৯৪১ সালে ফজলুল হক সরকারের ওপর থেকে মুসলিম লিগ সমর্থন প্রত্যাহার করে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে বাংলায় দ্বিতীয় জোট সরকার গঠনে ফজলুল হককে সাহায্য করেন। ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর ফজলুল হকের সরকারে অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন শ্যামাপ্রসাদ। ১৯৪২-এর ২০ নভেম্বর পর্যন্ত ওই পদে আসীন ছিলেন তিনি।
১৯৪২ সালের মার্চে ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার পরে ১৪ জুলাই মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধায় ইংরেজদের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি চেয়ে কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক হয়। ইংরেজরা তা মানতে রাজি না হলে, আইন অমান্য আন্দোলনের পথে নামে কংগ্রেস। ‘আইন অমান্য’ এবং এর পরে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন, দুটোরই বিরোধিতা করেন শ্যামাপ্রসাদ। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনিই ব্রিটিশ শাসকদের আচরণে ক্ষুব্ধ হন। যে ব্রিটিশ সরকারের প্রশংসা করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, তারই কড়া সমালোচনা করে ১৯৪২ সালে পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। এই কারণে শ্যামাপ্রসাদকে ইংরেজবিরোধী জাতীয়তাবাদী বলা হয়ে থাকে।
১৯৪৩ সালে বাংলায় ফজলুল হক ক্ষমতাচ্যুত হন। তারপরে খাজা নাজিমুদ্দিন রক্ষণশীল মুসলিম লিগ সরকার গঠন করলেন। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি, অন্যদিকে বাংলায় দুর্ভিক্ষের হাহাকার। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলেন নাজিমুদ্দিন। হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি রোধ করতেও ব্যর্থ হন নাজিমুদ্দিন। নতুন নেতা হন হুসেন শাহিদ সোহরাওয়ার্দি। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম সংরক্ষিত নির্বাচনী কেন্দ্রগুলি দখল করেছিল মুসলিম লিগ। ‘সাধারণ’ বা অ-সংরক্ষিত আসনগুলি দখল করেছিল কংগ্রেস। কিন্তু হিন্দু মহাসভা হেরে যায়। শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন হিন্দু মহাসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই সভার জাতীয় সভাপতি ছিলেন তিনি।
১৯৪৭ সালের মে মাসে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে চিঠি লিখে বাংলা বিভাজনের প্রস্তাব দেন শ্যামাপ্রসাদ। তিনটি পর্যায়ে ভোট দানের পরে অবশেষে ২০ জুন বাংলাকে হিন্দু এবং মুসলিমপ্রধান এই দুই ভাগে ভাগ করার চূড়ান্ত প্রস্তাব নেওয়া হয়।
১৯৪৭ সালের আগস্টে জহরলাল নেহেরুর উদ্যোগে স্বাধীন ভারতের অন্তর্বর্তীকালীন কেন্দ্রীয় সরকারে স্থান পান শ্যামাপ্রসাদ। কিন্তু পরে ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গাঁধীর হত্যার পরই ২৭ ফেব্রুয়ারি হিন্দুমহাসভা এবং আরএসএসকে নিষিদ্ধ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই পটেল। প্রথমে ১২ জুন, পরে ১০ সেপ্টেম্বর গাঁধীর হত্যায় অভিযুক্তদের সমর্থন করার জন্য হিন্দু মহাসভার ‘সাবস্ক্রিপশন ড্রাইভ’ থেকে বঞ্চিত করা হয় শ্যামাপ্রসাদকে।
রক্ষণশীল হিন্দু হিসেবে, নেহরুর সংস্কার গুলোর কঠোর সমালোচক ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। সেই সময়ে সাংসদ হিসেবেও তাঁর মর্যাদা বেড়েছিল। হিন্দু এবং উদ্বাস্তুদের স্বার্থরক্ষা করেছিলেন তিনি।
নেহরু-লিয়াকত চুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৫০ সালে ক্যাবিনেট থেকে ইস্তফা দেন শ্যামাপ্রসাদ। ওই বছরের অক্টোবরের মধ্যেই হিন্দু মহাসভার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। এই সময় তিনি আরএসএস-এর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। ওই দলের রাজনৈতিক সংগঠন ‘ভারতীয় জন সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠার জন্যও তাঁকে সম্মতি দেওয়া হয়। শেখ আবদুল্লা সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর অসন্তোষ এবং কাশ্মীরের বিশেষ পদমর্যাদা পাওয়ার বিষয়টি আরএসএসের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার ফল বলে বিবেচিত হয়।
১৯৫৩ সালে সরকার ভাঙতে বাধ্য হন নেহরু। ১১ বছরের জন্য শেখ আবদুল্লাকে জেলে পাঠান তিনি। এই ঘটনার কয়েক মাস পরে ৩৭০ ধারা রদ করার জন্য জনসঙ্ঘ, হিন্দু মহাসভা এবং প্রজা পরিষদের যৌথ বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন শ্যামাপ্রসাদ। আবদুল্লার সরকার বিক্ষোভকারীদের কাশ্মীরে প্রবেশে বাধা দিলেও শ্যামাপ্রসাদ কোনও মতে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ১১ মে নিরাপত্তা আইনের আওতায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। প্রথমে তাঁকে শ্রীনগরের সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁর আরও দুই সঙ্গী আয়ুর্বেদ চিকিৎসক গুরু দত্ত বেদ এবং টেক চাঁদের সঙ্গে তাঁকে শহরের বাইরে এক কটেজে রাখা হয়। এইখানে থাকাকালীন জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে জ্বরে ভুগতে শুরু করেন তিনি। কাশ্মীর সরকারের চিকিৎসকেরা বলেন, তাঁর প্লুরিসি হয়েছে। ইঞ্জেকশন ও পেনকিলার দেওয়া হয় তাঁকে। চিকিৎসার ফলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। ২২ জুন ভোরে তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন অর্থাৎ ২৩ জুন ভোর তিনটে চল্লিশ নাগাদ আবারও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েই মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫২ বছর।
পুলিশের হেফাজতে থাকাকালীন তাঁর মৃত্যু নিয়ে জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ ওঠে তাঁদের বিরুদ্ধে। তাঁর মা যোগমায়া দেবী তদন্তের আর্জিও জানান। তবে জওহরলাল নেহরু বা আবদুল্লা কেউই সেই তদন্তের নির্দেশ দেননি। নিরপেক্ষ তদন্তের আর্জিও খারিজ হয়ে যায়। তাই আজও তাঁর মৃত্যুর কারণ রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে।
২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের ১৫০ বছরের অনুষ্ঠানে এসে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেন কলকাতা বন্দর এর নতুন নাম ‘শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দর’। এছাড়াও তাঁর নামে দিল্লিতে কলেজ রয়েছে। দিল্লির একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা এবং ব্রিজ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত। ভারত সরকারের অন্যতম রিসার্চ ফান্ডিং ইনস্টিটিউট CISR তাঁর নামে একটি নতুন ফেলোশিপ-এর সূচনা করেছে। দিল্লি পুরসভার নামও হয়েছে তাঁর নামেই।
One comment