জি আই

ভৌগোলিক নির্দেশক ।। জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন ।। জি আই

মাঝে মধ্যেই টিভি কিংবা সংবাদপত্রে জি আই ট্যাগ বা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (Geographical Indications) বা ভৌগোলিক নির্দেশক নিয়ে বেশ মাতামাতি দেখা যায়। কিছুদিন আগেই যেমন রসগোল্লার উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গে না ওড়িশায় এই নিয়ে জোর তরজা আমরা দেখেছি দুই রাজ্যের প্রশাসনের মধ্যে। এই লড়াই মূলত জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা জি আই খেতাব পাওয়ার জন্যেই। এই খেতাব বা ট্যাগ পেলে লাভ কি হবে রাজ্যটির সেটি জানার আগে আসুন জেনে নেওয়া যাক এই জি আই ট্যাগ আসলে কাকে বলে।

ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জি আই) মূলত কোন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে উৎপাদিত বা জাত পণ্যকে চিহ্নিত করার নাম বা নির্দেশক। কোন পণ্যের এই জি এই শংসাপত্র পাওয়াকে জি আই ট্যাগ বলা হয়। কোন পণ্যের জি আই ট্যাগ পাওয়ার অর্থ হল সেই পণ্যটির সঠিক গুণমান কেবলমাত্র ওই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক স্থানটিতেই উৎপাদনের ক্ষেত্রেই বজায় রাখা হয় এবং এই গুণমান ঠিক রাখতে প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি মেনে চলা হয়। উক্ত পণ্যটি বিখ্যাত মূলত ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলটিতে জন্ম নেওয়া বা উৎপাদনের কারণেই।

বিশ্বে প্রথম জি আই ব্যবহার বা ভৌগোলিক নির্দেশকের ব্যবহার দেখা যায় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফ্রান্সে যেটি অ্যাপেলেশন ডি’অরিজিন কন্ট্রোলি (AOC) নামে পরিচিত ছিল। কোন পণ্য যেটি কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলেই উৎপাদিত হত এবং ওই অঞ্চলে উৎপাদনের ফলেই সেই পণ্যটি তার গুণমান বজায় রাখতে সক্ষম হত সেই পণ্যটিকে তখন ফরাসী সরকার অনুমোদিত সীল ও স্ট্যাম্প লাগানো শংসাপত্র প্রদান করা হত।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

কোন পণ্যের জি আই প্রাপ্তির অর্থ হল সেই পণ্যটির খ্যাতিকে মূলধন করে যাতে অন্য কোন তৃতীয় পক্ষ অসাধু উদ্দেশ্যে অতি নিম্ন মানের পণ্যের দ্বারা ব্যবসা করতে না পারে তা নিশ্চিত করা এবং প্রকৃত উৎপাদনকারীকে সুরক্ষিত করা আইনিভাবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় দার্জিলিং এর যে অঞ্চলটি দার্জিলিং চা পাতা উৎপাদনের কারণে জি আই প্রাপ্ত হয়েছে সেই এলাকার বাইরে আর কোন চা কে ‘দার্জিলিং চা’ বলা যাবেনা যেমন তেমনি পণ্যগুলির প্যাকেজিংয়ে কোথাও ‘দার্জিলিং টি’ শব্দবন্ধটি উল্লেখ করা যাবে না।

ভৌগোলিক নির্দেশক সাধারণত পাঁচ ধরণের পণ্যের ওপর প্রদান করা হয়ে থাকে – হস্তশিল্প, খাদ্য দ্রব্য, ওয়াইন এবং পানীয়, শিল্পজাত পণ্য এবং কৃষিজাত পণ্য। বিশ্বজুড়ে জি আই ট্যাগের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হল ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (উইপো )। তবে এর সাথে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) ও এই জি আই স্বত্ত্ব রক্ষায় একযোগে কাজ করে থাকে। এই দুই সংস্থাই জি আই স্বত্ত্বের সুরক্ষার জন্য বেশ কতকগুলি চুক্তি করেছে। উইপো কৃত চুক্তিগুলি হল – প্যারিস সম্মেলন, মাদ্রিদ চুক্তি এবং লিসবন চুক্তি। অন্যদিকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কৃত চুক্তিটি হল – ট্রেড রিলেটেড আসপেক্টস অফ ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস (ট্রিপ্স) এগ্রিমেন্ট।

ভৌগোলিক নির্দেশক সাধারণত প্রথাগতভাবে উৎপাদিত পণ্যের ওপর প্রয়োগ করা হয় যা গ্রামীণ, প্রান্তিক বা আদিবাসী সম্প্রদায়ের দ্বারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উৎপন্ন হয়ে আসছে, যেগুলি তাদের নির্দিষ্ট অনন্য গুণাবলীর কারণে স্থানীয়, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক বাজারে খ্যাতি অর্জন করেছে।

১৯৯৯ সালে ভারত সরকার পণ্যের ভৌগলিক নির্দেশক (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইনটি প্রণয়ন করে যা সেপ্টেম্বর ২০০৩ সাল থেকে কার্যকর হয়। ভারতবর্ষের মাটিতে উৎপাদিত কোন পণ্য জি আই ট্যাগ পাওয়ার যোগ্য কিনা সেটি বিচার করে ভারত সরকারের অধীনস্থ ডিপার্টমেন্ট ফর প্রমোশন অফ ইন্ডাস্ট্রি এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেড। ২০২২ সালের মার্চ মাসের হিসেব অনুযায়ী ভারতে এখনো অবধি মোট ৪২০টি পণ্য জি আই ট্যাগ প্রাপ্ত হয়েছে। উইপো দ্বারা প্রকাশিত সর্বাধুনিক ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৮ সাল অবধি পৃথিবীর ৯২টি দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মোট ৬৫৯০০টি সক্রিয় জি আই আছে।

আপনার মতামত জানান