বিবাহ হল প্রায় সারা বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃত একটি সম্পর্ক যেখানে সাধারণত একটি নারী ও একটি পুরুষ পরস্পরের প্রতি সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিপুল বৈচিত্রময় এই পৃথিবীতে যেমন বিভিন্ন ধরনের মানবগোষ্ঠী বা সমাজ রয়েছে তেমনই গোষ্ঠী বা দেশ ভেদে বিবাহের রীতি নীতিও আলাদা। এমনকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে বিবাহ সম্পর্কিত রীতি-রেওয়াজের। ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যেই বিভিন্ন রীতির বিবাহ প্রথা আছে তবে প্রধানত ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করলে উল্লেখযোগ্য বিবাহ রীতিগুলি হল হিন্দু বিবাহ, মুসলিম বিবাহ, খ্রীষ্টান বিবাহ ইত্যাদি। প্রতিটি রীতিরই আবার জাতি বা স্থান ভেদে অনেক আলাদা নিয়মরীতি আছে। এখানে আমরা পড়ব হিন্দু বিবাহ সম্পর্কিত নানান তথ্য।
পুরাণের দিকে চোখ রাখলে জানতে পারব হিন্দুশাস্ত্রে আট প্রকার বিয়ে কথা উল্লেখ করা হয়েছে –
১। ব্রাহ্ম বিবাহ
২। প্রজাপত্য বিবাহ
৩। আর্য্য বিবাহ
৪। দৈব বিবাহ
৫। অসুর বিবাহ বা আসুরিক বিবাহ
৬। গন্ধর্ব বিবাহ
৭। পিশাচ বিবাহ বা পৈশাচিক বিবাহ
৮। রাক্ষস বিবাহ
উপরে যে আট রকম বিয়ের কথা বলা হলো তার মধ্যে প্রথম চার রকম ব্রাহ্ম, প্রজাপত্য, আর্য্য ও দৈব বিয়ে হয়ে থাকে বিভিন্ন মন্ত্র ক্রমে। প্রজাপত্য বিয়ের চলন আমাদের সমাজে বেশী দেখা যায় যার পোশাকী নাম অ্যরেঞ্জ ম্যারেজ, এই প্রথায় পিতামাতা বা আত্নীয় স্বজনই বিয়ের ব্যবস্থা করে থাকেন।বিভিন্ন মন্ত্র অনুযায়ী বা পদ্ধতি অনুযায়ী উপরের নামকরণগুলি করা হয়েছে৷এ ছাড়া বাকী যে চারটি বিয়ের ধরন আছে, সেগুলির জন্য বর এবং কন্যার নিজের উদ্যোগে হয়ে থাকে। এ গুলিতে পিতামাতা বা আত্নীয় স্বজনের কোন দায়িত্ব থাকে না৷
বাঙালি হিন্দু বিবাহের রীতিনীতি দেখা যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্য এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বসবাসকারী বাঙালি হিন্দুদের বিবাহে। অতীতে বাঙালি হিন্দু সমাজে বাল্যবিবাহের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বর্তমানে বাল্যবিবাহ আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে । বর্তমান কালে নারীর বয়স সর্বনিম্ন আঠারো এবং পুরুষের বয়স একুশ হওয়া প্রয়োজন। তবে বিবাহে পণপ্রথা এখনও বহুল প্রচলিত। যদিও পণপ্রথা নিবারণী আইন বলবৎ আছে। তবুও সমাজে পণপ্রথা উপহার দেওয়া নেওয়ার মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে৷
বিশুদ্ধিকরণেব জন্য হিন্দুদের যে দশবিধ সংস্কার আছে, বিবাহ তার মধ্যে শেষ সংস্কার।উচ্চবর্ণীয় হিন্দু সমাজের বিবাহে প্রধানত দুইটি আচারগত বিভাগ দেখা যায়, যথা – বৈদিক ও লৌকিক। লৌকিক আচারগুলি “স্ত্রী আচার” নামে পরিচিত। বৈদিক আচারগুলির মধ্যে অবশ্য পালনীয় প্রথাগুলি হল কুশণ্ডিকা, লাজহোম, সপ্তপদী গমন, পাণিগ্রহণ, ধৃতিহোম ও চতুর্থী হোম প্রভৃতি । বৈদিক আচারগুলির সঙ্গে লৌকিক আচারগুলির কোনো সম্পর্ক থাকে না৷ লৌকিক আচারগুলি অঞ্চল, বর্ণ বা উপবর্ণভেদে এক এক প্রকার হয়ে থাকে ।নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে লৌকিক আচার তো বটেই বিবাহের মৌলিক আচারগুলির ক্ষেত্রেও সম্প্রদায়ভেদে পার্থক্য দেখা যায়৷ এই লৌকিক আচারগুলি সধবা স্ত্রীদের দ্বারা সম্পাদিত হয়ে থাকে৷ বিবাহের মাধ্যমে নারীর গোত্রান্তর ঘটে সে পিতৃকুলের পরিচয় ছেড়ে স্বামীকূলের গোত্র গ্রহণ করে তাই বিবাহের সময় প্রতিটি নিয়ম যত্ন সহকারে পালন করা হয়ে থাকে৷ হিন্দুনারীর পক্ষে বিবাহ-জীবন চরম সন্ধিক্ষণ, এরূপ সন্ধিক্ষণে যাতে কোন বাধা-বিপত্তি না ঘটে তার উদ্দেশ্যেই আচার অনুষ্ঠান সমূহ পালিত হয়৷
হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী, বিবাহে ছেলে মেয়েটির সমস্ত পালনপোষণের দ্বায়িত্ব নেয় এবং মেয়েটি তাদের সংসারের খেয়াল রাখার দ্বায়িত্ব গ্রহন করে। তাই তো বিবাহের পরবর্তী অনুষ্ঠান হিসেবে ‘ভাত কাপড়’ এর অনুষ্ঠান সম্পাদিত হয়। এইভাবে তারা দুই আলাদা আলাদা মানুষ এক হয়ে নিজেদের বংশ এগিয়ে নিয়ে যায়।
One comment