বল্লাল সেন দ্বারা কৌলীন্য প্রথা সৃষ্টির আসল কারণ কি

আমরা জানি বল্লাল সেন বঙ্গদেশে কৌলিন্য প্রথা শুরু করেছিলেন। কিন্তু কেন? আমরা এখানে জেনে নেব কৌলীন্য প্রথা সৃষ্টির আসল কারণ কি।

কৌলীন্য শব্দটির অর্থ হচ্ছে বংশ বা কূল গৌরব। প্রত্যেকেরই বংশ-পদবী আছে এবং সেটা নিয়ে যে গৌরব, যে আভিজাত্য প্রদর্শনের প্রথা, তাই কৌলীন্য প্রথা। প্রশ্ন আসতে পারে যে, “হিন্দু সমাজে কি সেই সত্যযুগ থেকে এ পদবী প্রচলন ছিল?” একটু লক্ষ্য করলেই আমরা স্পষ্ট দেখতে পাবো যে, “রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, বিশ্বামিত্র, দুর্যোধন, দশরথ, শঙ্করাচার্য, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ মহামানবের নামের পেছনে কোন পদবী ছিল না। তাহলে?

১৫১০ সালে আনন্দ ভট্ট রচিত ও ১৯০৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত “বল্লাল চরিত” নামক বইয়ে হিন্দু সমাজে পদবী প্রচলন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে (তথ্যসূত্রঃ সমাজদর্পণ ১৫ বর্ষ, সংখ্যা ১২; জুন ১৯৯৯)। উক্ত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, গৌড়ের বৈদ্য বংশীয় রাজা বল্লাল সেন (১১৫৮-১১৭৯ সাল) নিজ সহধর্মিণী থাকা অবস্থায় অধিক বয়সে পদ্মিনী নাম্নী এক সুন্দরী ডোম নর্তকীকে বিয়ে করেন। এতে দেশজুড়ে রাজার সুনাম বিনষ্ট হয় এবং এ কুকীর্তি নিয়ে প্রজারা সমালোচনা শুরু করে দেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

রাজা এই কলঙ্ক থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সকল সম্প্রদায়ের প্রজাদের এক সম্মিলিত ভোজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। কিন্তু, সকল সম্প্রদায়ের লোকেরা উপস্থিত থাকলেও নমশূদ্র বিপ্রগণ এই ভোজ অনুষ্ঠানে যোগদানে বিরত থাকেন, অর্থাৎ রাজার এই কুকীর্তিকে সমর্থন করে তারা ভোজ সভায় অংশ নেননি। রাজা তাদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হন এবং নমশূদ্র লোকদের চাকরীচ্যুত করেন। শুধু তাই নয়, রাজা তাদের চণ্ডাল বলে গালাগাল করে নগর বন্দর থেকে উৎখাত করে দেন। অন্যদিকে ভোজ সভায় অংশগ্রহণকারী সম্প্রদায়ভুক্তরা রাজার সকল কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে রাজার অনুগ্রহ লাভ করতে যত্নবান হন। রাজাও এসব সম্প্রদায়কে সাহায্য করেন এবং অনেক সম্প্রদায়কে কৌলীন্য বা টাইটেল দান করেন।

এভাবেই, বল্লালসেন পদবী বৈষম্য সৃষ্টি করে হিন্দু সমাজে বিষাক্তবীজ বপন করেছিলো যা বর্ণপ্রথা বা বর্ণভেদকে আরও শক্তিশালী করে। এই বর্ণভেদ আজও আমাদেরকে দুর্বল করে রেখেছে। সেন রাজারা বাঙালি ছিল না। তবুও, পদবী বৈষম্য সৃষ্টি করে বাঙ্গালীদের শাসন করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।

তথ্যসূত্র


  1. অতুল সুর, বাংলার সামাজিক ইতিহাস, কলকাতা, ১৯৭৬।
  2. নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারতীয় জাতি বর্ণ প্রথা, কলকাতা, ১৯৮৭।
  3. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বঙ্গীয় কুলশাস্ত্র, কলকাতা, ১৯৮৯।
  4. নগেন্দ্রনাথ বসু, বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ২ খন্ড, কলকাতা।
  5. বিনয় ঘোষ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
  6. বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস, দুর্গাচন্দ্র সান্যাল, মডেল পাবলিসিং হাউস

One comment

আপনার মতামত জানান