নাট্যকার, সংগীতস্রষ্টা, সম্পাদক এবং চিত্রশিল্পী
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (জন্মঃ- ৪ মে, ১৮৪৯ – মৃত্যুঃ- ৪ মার্চ, ১৯২৫) দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম পুত্র। তার জন্ম হয়েছিল কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর থেকে বারো বছরের ছোটো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁকে উৎসাহ ও সঙ্গ দিয়ে তাঁর প্রতিভার পূর্ণ বিকাশে সহায়তা করেন। তাঁদের দুই দাদা কবি ও দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রথম ভারতীয় আইসিএস অফিসার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বনামধন্য ছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ছোটোবোন স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন বিশিষ্ট লেখিকা ও সংগীতজ্ঞা।
বাল্যকালে দাদা হেমেন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষার ভার নিয়েছিলেন। পরে তিনি সেন্ট পল’স ও মন্টেগু’স স্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৮৬৪ সালে হিন্দু স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও লেখক রমেশচন্দ্র দত্ত ছিলেন তাঁর সহপাঠী। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ফার্স্ট আর্টস পড়ার সময় থিয়েটারে আকৃষ্ট হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেন।
তিনি দেশাত্মবোধক নাটক রচনা করতে শুরু করেন এবং নাটক মঞ্চস্থ করার উদ্দেশ্যে একটি সাংস্কতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন বিদ্বজন-সমাগম নামে ১৮৭৪ সালে। এই প্রতিষ্ঠানটি রবীন্দ্রনাথকে তার প্রথম দিকের নাটক ও নৃত্যনাট্য প্রদর্শনে সাহায্য করে। প্রতিষ্ঠার নবম বছরে তিনি হিন্দু মেলার সম্পাদক নিযুক্ত হন। পুরুবিক্রম পাঞ্জাবের সাহসী রাজা পোরাসএর জীবনী নিয়ে রচিত, যিনি বাংলা ভাষায় পুরু নামে পরিচিত। পুরু আলেক্সাণ্ডারএর মুখোমুখি হন। বেঙ্গল থিয়েটার নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন করে ১৮৭৪ সালে।
১৮৬৭ সালে বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আহমেদাবাদে থাকার সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেতার বাজাতে ও ছবি আঁকতে শেখেন। তিনি ফরাসি ও মারাঠি ভাষাতেও দক্ষতা অর্জন করেন। বিভিন্ন ভাষার বই, বিশেষ করে নাটক তিনি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। ইংরেজি থেকে মার্কাস অরেলিয়াসএর মেডিটেশনস ও শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার অনুবাদ করেন। পিয়েরে লোতি ও থিওফিল গুটিয়ার ছাড়াও তিনি ইতিহাস, দর্শন, ভ্রমণকাহিনী, উপন্যাস ও ছোট গল্প ফরাসি ভাষা থেকে অনুবাদ করেন। ১৮৯৯ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে তিনি সতেরটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃত নাটক বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। এর মধ্যে কালিদাসের ‘’অভিজ্ঞান শকুন্তলম’’ ও ‘’মালতী মাধবা ও সুদ্রকের “মৃচ্চাদিকা” উল্লেখযোগ্য ।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ “ভারতী” নামে একটি নতুন ম্যাগাজিনের প্রস্তাব করেন ১৮৭৭ সালে। দ্বিজেন্দ্রনাথ সম্পাদক থাকলেও মূলত তিনিই পত্রিকাটি চালাতেন। ১৯০২-০৩ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক সংগঠন, সরস্বত সমাজের তিনি অবদান রাখেন। সংগঠন বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ৪৬ খণ্ড সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে প্রচুর অনুবাদও রয়েছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সবসময় তার বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে অনুষ্ঠিত সাহিত্য মজলিশে অংশ নিতেন। অন্যান্য অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরলা দেবী, জগদীন্দ্রনাথ রায়, লোকেন্দ্রনাথ পালিত, শরৎকুমারী চৌধুরানী ও প্রমথ চৌধুরী।
স্ত্রীশিক্ষা ও নারীমুক্তি সে যুগে অপরিকল্লপিত বিষয় ছিল। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে লোকের সমালোচনাকে উপেক্ষা করে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন: তাঁর নিজের নিজের সংসারে পর্দাপ্রথাকে তিনি আমল দেন নি, স্ত্রীকে সকলের সম্মুখে বের করতেন, তাঁকে নিয়ে প্রকাশ্যে সান্ধ্যভ্রমণে বের হতেন এবং নিজের শিক্ষা ও শিল্পরুচি দিয়ে স্ত্রীকে সুশিক্ষিতা করে তুলেছিলেন। তিনি তার স্ত্রীর শিক্ষার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তাকে কলকাতার মাঝে অশ্বারোহণের প্রশিক্ষণ দেন, যা তার সমসাময়িক রক্ষণশীল সমাজবিরোধী।
ছাত্রাবস্থাতেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ থিয়েটারের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি একটি পারিবারিক নাট্যদল গঠন করে নাটক মঞ্চস্থ করতে শুরু করেন। তাঁর জ্ঞাতিভ্রাতা গণেন্দ্রনাথ ১৮৬৫ সালে স্থাপন করেন জোড়াসাঁকো নাট্যশালা। এই নাট্যশালায় প্রথম যে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল, সেটি হল মাইকেল মধুসূদন দত্তের কৃষ্ণকুমারী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই নাটকে অহল্যাদেবী নামে এক সাহসী রানির ভূমিকায় অভিনয় করেন। প্রথম জীবনে নাট্যাভিনয়ে সাফল্য তাঁকে নাট্যকার হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তোলে।
গণেণ্দ্রনাথ হিন্দু মেলার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি অল্পবয়সে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে এ কাজে যুক্ত করেন।
১৮৬৯ থেকে ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক ছিলেন। তিনি ব্রাহ্ম সংগীতকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে আদি ব্রাহ্ম সমাজ সংগীতবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
তার উদ্যোগে একটি গোপন সমাজ “সঞ্জীবনী সভা” প্রতিষ্ঠিত হয়। খুব সম্ভবত ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন রাজনারায়ণ বসু। এই সমাজ ম্যাচের কাঠি তৈরি এবং হাতে পাকানো কাপড় চালু করার চেষ্টা করেন।
সাহিত্য
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক নাটকগুলো হল: পুরবিক্রম (১৮৭৪), সরোজিনী (১৮৭৫), অশ্রুমতি (১৮৭৯), স্বপ্নময়ী (১৮৮২)। হাস্যরসাত্মক নাটকগুলো হল:কিঞ্চিত জলযোগ (১৮৭৩), এমন কর্ম আর করব না (১৮৭৭), হঠাৎ নবাব (১৮৮৪), অলীক বাবু (১৯০০)। অনুবাদসমূহ হল: কালিদাসের অভিগ্ঞান শকুন্তলম ও মালতী মাধবা, সুদ্রকের মৃচ্যতিকা, মার্কাস অরেলিয়াসের মেডিটেশনস, শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার, বাল গঙ্গাধর তিলকের গীতারহস্য।
সংগীত
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শৈশবে বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর কাছে সঙ্গীত বিষয়ে তালিম নেন। তিনি পিয়ানো, ভায়োলিন, হারমোনিয়াম ও সিতার বাজানোতে দক্ষ ছিলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সঙ্গীত বিপ্লবে মূল ভূমিকা ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। সাহিত্য ও সংগীতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গী ছিলেন অক্ষয় চন্দ্র চৌধুরী। পরে রবীন্দ্রনাথ তাদের সাথে যোগ দেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সুরারোপ করতেন ও পিয়ানো বাজাতেন এবং অক্ষয় ও রবীন্দ্রনাথ সুরগুলোতে কথা যোগ করতেন। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য মায়ের খেলায় ব্যবহৃত ২০ টি গানের সুরকার ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
১৮৭৯ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বিনাবাদিনী নামে একটি সঙ্গীত বিষয়ক ম্যাগাজিন চালু করেন যা বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম ম্যাগাজিনগুলোর মধ্যে অন্যতম। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের প্রার্থনার জন্য বেশকিছু গানের সুরারোপ করেন। এদের কিছু কিছু হিন্দুস্তানী ক্লাসিকাল সঙ্গীতের থেকে গৃহীত হয়েছে। ভারতের সঙ্গীতের জন্য ১৮৯৭ সালে তিনি ভারতীয় সঙ্গীত সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।
অঙ্কন
অঙ্কন ও স্কেচ করার দিকে আগ্রহী ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। নিজের পরিবারের অনেক সদস্যের পোর্ট্রেট তিনি অঙ্কন করেন। তার অঙ্কিত রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন প্রকারের স্কেচ আছে। তার প্রায় ২০০০ টি স্কেচ রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু ভারতীতে প্রকাশিত হয় ১৯১২ সালে। উইলিয়াম রথেনস্টেইন তার কাজগুলো দেখে চমৎকৃত হন এবং তার আরো স্কেচ দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ একবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আঁকা প্রচুর পরিমাণ স্কেচ ইংল্যাণ্ডে প্রদর্শনের জন্য নিয়ে যান। রথেনস্টেইন খুশি হয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাজের উপর “টুয়েণ্টি-ফাইভ কলোটাইপস ফ্রম দি অরিজিনাল ড্রয়িংস অফ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর” নামে একটি বই ইংল্যাণ্ডে প্রকাশিত করেন।
ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড
দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে খ্যাত ছিলেন। জার্মানীতে রাসায়নিক নীল উদ্ভাবিত হবার পর তিনি তার নীলচাষের ব্যবসা চালিয়ে নিতে পারেননি। তিনি তার লভ্যাংশ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। সে সময়ে খুলনা ও বরিশালের ভেতর দিয়ে স্টিমার চলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তিনি স্টিমারের শেল বা আচ্ছাদন ক্রয় করেন এবং ইঞ্জিনের সাথে যোগ করে সরোজিনী নামে ১৮৮৪ সাল থেকে চালু করেন। ফ্লোটিলা নামে একটি ইংরেজ কোম্পানিও একই ব্যবসা শুরু করে এবং দ্রুতই সবার ভিতর প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছড়িয়ে পড়ে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আরো চারটি স্টিমার ক্রয় করেন। এগুলো তার প্রতিষ্ঠান থেকে স্বদেশী, ভারত, বাংলালক্ষী ও লর্ড রিপন নামে চালু হয়। উভয় প্রতিষ্ঠানই ভাড়া কমাতে শুরু করে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ব্যবসায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেন, তবে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হন। ১৮৮৯ সালে হুগলি নদীতে যাত্রার সময় স্বদেশী একটি জেটির সাথে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে দ্রুত ডুবে যায়। এমতাবস্থায় ফ্লোটিয়া বাকি তিনটি স্টিমারের জন্য উপযুক্ত মূল্য ঘোষণা করে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেগুলো বিক্রি করে প্রতিদ্বন্দ্বীতা থেকে বেরিয়ে আসেন।
মৃত্যু
রাঁচিতে ৭৬ বছর বয়সে প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে এই প্রতিভাদীপ্ত পুরুষ পরলোক গমন করেন।
4 comments