নিপা ভাইরাস

বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, অ্যান্থ্রাক্স এর পর আতঙ্কের তালিকায় নতুন সংযোগ নিপা ভাইরাস।গত কয়েকদিনে নিপা ভাইরাসের(Nipah Virus) আক্রমণে কেরলে মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু’-এর রিপোর্ট অনুসারে কেরলের কোঝিকোড় থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে পেরম্বরা থেকেই নিপা ভাইরাস ছড়িয়েছে।

আসলে কী এই নিপা ভাইরাস (Nipah Virus) ?

হু’-এর রিপোর্ট অনুসারে নিপা বা নিভ প্রধানত বাদুর জাতীয় পশুর থেকেই ছড়ায়। এটা এক নতুন ধরনের জুনোসিস(যে রোগ পশুর মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে) যা মানুষ ও জন্তু দু’পক্ষকেই ঘায়েল করে। নিপা অপেক্ষাকৃত নতুন ভাইরাস যা অতি সহজেই ফলখেকো বাদুড়। জাতীয় তৃণভোজী প্রাণীর থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। শুধুমাত্র বাদুর নয়, নিপা শূকরের বর্জ থেকেও ছড়ায়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার নিপাতে প্রথম এই ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়। সেখানে বাড়ির পোষ্য কুকুর, বেড়াল, ঘোড়া, ছাগলের দেহে এই ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ওই অঞ্চলে প্রতিটি বাড়িতেই শূকর প্রতিপালন হয়। গবেষণার পর দেখা যায়, ওই শূকরদের থেকেই নিপার প্রভাব ছড়িয়েছে পোষ্যদের দেহে। এরপর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
২০০৪ সালে নিপা ভাইরাস থাবা বসায় বাংলাদেশে। সেখানে ৩৩জনের মৃত্যু হয় এর প্রভাবে। হু’-এর রিপোর্ট অনুসারে, এখনও পর্যন্ত নিপার প্রভাবে ৪৭৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। যার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৫২ জনের। ২০০১ সালে শিলিগুড়িতে নিপার হামলায় আক্রান্ত হন ৬৬ জন। এর মধ্যে ৪৫ জনের মৃত্যু হয়। মৃতের তালিকায় একজন চিকিৎসকও ছিলেন। ২০০৭ সালের এপ্রিলে নদিয়ায় একই পরিবারের চারজন নিপার ছোবলে প্রাণ হারান। রোগীর রক্ত সংগ্রহ করতে এসে এক ব্লাড কালেক্টরও প্রাণ হারান।শিলিগুড়িতে মৃত্যুর হার ছিল ৬৮ শতাংশ। নদিয়াতে ১০০ শতাংশ।

কীভাবে ছড়ায়?
বাদুড় বা বাদুড়ের বিষ্ঠার সংস্পর্শে আসা ফল খেলে বা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে এই রোগ হতে পারে। আক্রান্ত শূকর বা বাদুড়ের থেকেও সরাসরি মানুষের শরীরে এই ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে।
উপসর্গ:
১) জ্বর, শ্বাসকষ্ট, প্রবল মাথার যন্ত্রণা, বমি বমি ভাব, কাফ মাসলে ব্যথা, কথা জড়িয়ে যাওয়া, মুখমণ্ডলের পেশি সঙ্কুচিত হওয়া।
২) জ্বর বাড়তে থাকলে ভুল বকা শুরু হয়, স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে, মৃগী রোগীর মতো খিঁচুনি শুরু হয়। এনসেফেলাইটিসের লক্ষণ দেখা যায়। আক্রান্ত হবার ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোমায় চলে যায় রোগী।
নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয়ঃ
সরাসরি নিপাহ ভাইরাস নিরাময়ে কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক ভ্যাকসিন এখনও আবিষ্কার হয়নি। রোগের লক্ষণ বিবেচনা করে চিকিত্সকরা সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট দিয়ে থাকেন। তবে প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়—

১. বাদুড় থেকে প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে : পাখি দ্বারা আধা বা আংশিক ফল খাওয়া ও খেজুরের কাঁচা রস পান না করার জন্য ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।
২. মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানো প্রতিরোধে : আক্রান্ত মানুষের সরাসরি শারীরিক সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। রোগীদের ব্যবস্থাপনায় ডাক্তারদের/স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা গ্লাভস ও মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
৩. ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, যেন হাতের মাধ্যমে ভাইরাসটি না ছড়ায়।
৪. রোগী যে পাত্রে খাবার খায় সে পাত্রে খাবার না খাওয়ায় এবং রোগীকে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৩ ফুট দুরত্বে অবস্থান করা।
৫. রোগীর পরিচর্যা করার পর হাত ভালোভাবে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
৬. নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ওই এলাকার মানুষকে আপাতত খেজুর গুড় ও রস, আখের রস, পেঁপে, পেয়ারা, বরইসহ স্থানীয় ফল বা অর্ধেক খাওয়া ফল না খাওয়া। ফলমুল খেলেও ভালভাবে ধুয়ে খেতে হবে।
৭. রোগীর কফ ও থুতু যেখানে সেখানে না ফেলে একটি পাত্রে রেখে পরে তা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৮. লক্ষনগুলো প্রকাশ পেলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিত্সকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

নিপা ভাইরাস (Nipah Virus) রোগের চিকিৎসাঃ
এখন পর্যন্ত এ রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। ঠিকমতো শুশ্রুষা হলেই রোগী বেঁচে যেতে পারে। আর এ জন্য আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। আক্রান্ত রোগীর দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে জীবন রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই রোগের লক্ষণ দেখামাত্রই রোগীকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে দ্রুত।

আপনার মতামত জানান