পাগলা কানাই (Pagla Kanai) একজন বিখ্যাত বাঙালি আধ্যাত্মিক গীতিকার তথা সুরকার তথা গায়ক যিনি লোকগানের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন জারি, বাউল, মারফতি, ধুয়া এবং মুর্শিদি গানের স্রষ্টা হিসেবে। তিনি জারিগানের একটি বিশেষ প্রকার ধুয়াজারির স্রষ্টা।
১৮০৯ সালের ৮ মার্চ হয়েছিল অধুনা বাংলাদেশের ঝিনাইদহ থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বেড়বাড়ি নামের একটি গ্রামে। পাগলা কানাইয়ের পিতার নাম ছিল কুড়ল শেখ এবং মায়ের নাম মোমেনা বিবি। কানাইয়ের পিতামহ ও প্রপিতামহের নাম যথাক্রমে মেছের শেখ ও ছলিম শেখ। পাগলা কানাইয়ের দিদির নাম শরনারী এবং ভাইয়ের নাম সজল। সজল ছিল কানাইয়ের দলের ‘দোহার’। পাগলা কানাইয়ের নাম পাগলা হল কেন তা নিয়ে প্রবাদ আছে। পাগলা কানাই ছোটবেলা থেকেই ছিলেন দুরন্ত স্বভাবের। তাই বাবা তাঁকে আদর করে ডাকতেন পাগলা মিয়া নামে। মূলত সেই থেকেই তাঁর নামের শেষে স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়ে যায় পাগলা শব্দটি। তিনি শেখ কানাই থেকে হয়ে যান পাগলা কানাই। কানাই খুব ছোট বয়সেই বাবাকে হারান। এর কিছুদিন পর মাকে হারিয়ে তিনি তাঁর ভাই সজল অনাথ হয়ে পড়েন। তখন তাঁরা ঝিনাইদহ মহকুমার কালীগঞ্জ থানার ভাটপাড়া গ্রামে তাঁদের মাসির বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে কানাই মাঠে কাজ করতেন, গরু চরাতেন এবং সাংসারিক কাজ করতেন। এর বিনিময়ে থাকা খাওয়া পেতেন। কিন্তু অল্পদিনের ব্যবধানে পাগলা কানাইয়ের মাসি ও মেসো দুজনেরই মৃত্যু হলে আবার তাঁরা অনাথ হয়ে পড়লেন। এরপর তাঁরা গিয়ে উঠলেন বড় বোন শরনারীর বাড়িতে। সেখানেই তাঁরা মানুষ হতে লাগলেন। পরে নিজের গ্রামেরই এক দরিদ্র কৃষকের কন্যা আমেনা বিবির সঙ্গে কানাইয়ের বিয়ে হয়। কানাইয়ের দাম্পত্যজীবন ছিল অত্যন্ত সুখের। কানাই আমেনার ছিল তিন পুত্রসন্তান। এরা হলেন গহর আলী, বাছের আলী ও ইরাদ আলী। ইরাদ আলী কিশোর বয়সেই মারা যায়। অপর দুজন দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন।
পাগলা কানাইয়ের সেভাবে কোন প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। দু-চারদিন পাঠশালায় গেলেও স্কুলের পড়া আর অগ্রসর হয়নি তাঁর। তিনি তাঁর বিদ্যাশিক্ষা সম্পর্কে এক ধুয়ায় বলেছেন –
বাপ এক গরীব চাষা
ছাওয়াল তার সর্বনাশা
সে আবার পড়তে আসে কেতাব কোরান ফেকা
পাগলা কানাই কয় ভাইরে পড়া হল না শেখা।
তাঁকে সংসার চালানোর জন্য কিছু সময় সাহেবদের নীলকুঠিতে খালাসির কাজ করতে হয়েছিল। মূলত এই সময় থেকেই তাঁর মধ্যে কবিত্বশক্তির উন্মেষ ঘটে। তিনি জারি গান গাইতে এবং ধুয়া রচনা করতে আরম্ভ করেন। তিনি খালাসির কাজ চার বছর করেছিলেন। খালাসির কাজ ছেড়ে দেওয়ার পর কানাই আর কোনো বাঁধাধরা চাকরি করেননি। ক্রমেই কবি হিসেবে তাঁর নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঝিনাইদহ-যশোর এলাকা ছাড়িয়ে তার পরিচিতি সমগ্র বঙ্গদেশ জুড়ে ব্যাপ্ত হয়। কালক্রমে কানাই ধুয়া-জারিগানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলেন। নানা অঞ্চল থেকে গান গেয়ে কানাই ভালো আয় উপার্জন করতে থাকেন। শেষে তাঁর গানের এতই কদর হয়েছিল যে, অগ্রিম টাকা দিয়ে তবে তাঁর তারিখ পাওয়া যেত গানের আসরের।
কানাইয়ের সঙ্গীতজীবনের সূচনাপর্ব নিয়ে নানারকম কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। তিনি নাকি কোনো এক পীর দরবেশের দোয়াতে এমন সুকণ্ঠের এবং রচনাশক্তির অধিকারী হন। সংগীতকার হিসেবে পাগলা কানাই নামে একাধিক ব্যক্তির অস্তিত্ব মেলে। এতে কখনো কখনো বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। যেমন, সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান গ্রন্থে আলোচ্য পাগলা কানাইয়ের পাশাপাশি আরেকজন পাগলা কানাইয়ের উল্লেখ করেছেন। এই দ্বিতীয় পাগলাকানাই ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে নদীয়ায় বিদ্যমান ছিলেন। গুরুর আদেশে তিনি সাধনা করতে গিয়ে পাগল হয়ে যান বলে তার নাম হয় পাগলা কানাই। তিনি আসরে দাঁড়িয়ে গান রচনা করতে ও তা গাইতে পারতেন। এই দুই পাগলা কানাই একই ব্যক্তি কিনা জানা যায়নি।
দুই বাংলাযতেই একাধিক পাগলা কানাইয়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এক পাগলা কানাই উনিশ শতকের শেষে নবদ্বীপে নবদ্বীপের বামনপুকুরে কাছে একটি গ্রামে বাস করতেন। তিনি পরবর্তীকালে মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে জারি ও মার্সিয়া গান রচনা ও গাইতে শেখেন এবং প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কেউ কেউ মনে করেন নবদ্বীপের পাগলা কানাই আর জারিগান রচয়িতা পাগলা কানাই দুজন আলাদা ব্যক্তি।
১৮৮৯ সালের ১২ জুলাই প্রায় ৬৫ বছর বয়সে পাগলা কানাইয়ের মৃত্যু হয় । তাঁর অস্তিম ইচ্ছে অনুসারে তাঁকে বেড়বাড়িরই গ্রামে পথের মাঝে কবর দেওয়া হয়।