সাপ দেখে ভয় পায় না এরকম মানুষ হয়ত খুব কমই আছে। এর প্রধানতম কারণ হল তাদের বিষ, যেটা তাদের শিকারকে কাবু করার একটা অস্ত্রও বটে। তবে স্বস্তির বিষয় হল এই যে সব সাপ বিষধর নয়। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ২৬০ টির বেশি সাপের প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায়, যার মধ্যে মোটামুটি ৬০ টি প্রজাতি বিষাক্ত। এখানে আমরা জানব, কিছু কিছু সাপের কামড়ে মানুষ মারা যায় কেন।
সাপের বিষ এমন একটি জৈব পদার্থ যাতে বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন এবং উৎসেচক থাকে। এই প্রোটিন এবং উৎসেচকগুলি সাপের মুখের লালাগ্রন্থি থেকে উৎপন্ন হয়ে বিষথলিতে সঞ্চিত থাকে। সাপের প্রকারভেদ অনুযায়ী সাপের বিষের উপাদান আলাদা আলাদা হয়। সাপ যখন কোনো প্রাণীকে কামড়ায়, তখন সেই বিষথলিতে সঞ্চিত বিষ, বিষদাঁতের মাধ্যমে উক্ত প্রাণীর শরীরে চলে যায় এবং সেখানে গিয়ে তাদের কাজ আরম্ভ করে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, সাপের বিষ শরীরে ঢুকলেই যে তার বিষক্রিয়া আরম্ভ করবে এরকম কোন মানে নেই। সেই বিষ রক্তে মিশলে তবেই সেটা কাজ করে।
এবার প্রশ্ন হল সব সাপের বিষ কি একই ভাবে কাজ করে? আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বিভিন্ন সাপের বিষের উপাদান এক হয় না, তাই তাদের কাজ করার ধরণও আলাদা হয়। দেখা গেছে সাপের বিষ সাধারণত তিনভাবে কাজ করতে পারে – স্নায়ুতন্ত্র কে অচল করে অর্থাৎ নিউরোটক্সিন (neurotoxin) অথবা হৃৎপেশীকে বিকল করে অর্থাৎ কার্ডিওটক্সিন (cardiotoxin) অথবা রক্তকে বিষিয়ে দিয়ে হিমোটক্সিন (haemotoxin)।
কোবরা জাতীয় সাপ (যেমন গোখরো, কেউটে)-এর বিষে স্নায়ুতন্ত্রকে অচল করার জন্য প্রোটিন এবং উৎসেচক থাকে। এই প্রোটিন এবং উৎসেচকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আলফা-নিউরোটক্সিন (α-neurotoxin), ডেনড্রোটক্সিন (dendrotoxin) ইত্যাদি। এগুলি একটা স্নায়ুকোষ থেকে অন্য স্নায়ুকোষে খবর নিয়ে যেতে বাধা দেয়। এর ফলে প্রাণীদেহের স্নায়ুতন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দেয় এবং আস্তে আস্তে সমগ্র দেহ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একটি প্রাণীর প্রায় সবরকম ক্রিয়াকলাপের জন্য তার স্নায়ুতন্ত্রকে ক্রিয়াশীল থাকতে হয়। কোবরা জাতীয় সাপের বিষ এভাবে প্রাণীকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে মেরে ফেলে।
বেশ কিছু কোবরা এবং মাম্বা জাতীয় সাপের বিষ প্রাণীর হৃৎপেশীর ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এই বিষের উপদানগুলি যেমন কার্ডিওটক্সিন -১,২ ও ৩ (cardiotoxin-1, 2 ও 3) রক্তের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডে পৌঁছলে সেখানে হৃৎপেশীর সংকোচন-প্রসারণকে স্তব্ধ করে দেয়। ফলে হৃৎপিণ্ড রক্ত সঞ্চালন করতে পারে না এবং অক্সিজেনের অভাবে প্রাণীর মৃত্যু হয়।
বোড়া জাতীয় সাপ (যেমন চন্দ্রবোড়া)-এর বিষে রক্ত দূষণকারী উপাদান থাকে। এই উপাদানগুলির মধ্যে অন্যতম হল মিউক্রোসেটিন (mucrocetin), মিউক্রোলাইসিন (mucrolysin) ইত্যাদি। এগুলি রক্তে মিশে রক্তের লোহিত কণিকাগুলিকে ভেঙে দেয়, রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দেয়, অথবা কখনো কখনো রক্ত জমাট বাঁধার জন্য যে প্রোটিন প্রাণীদেহে থাকে সেগুলোকেও নষ্ট করে দেয়।
এই তিনধরনের প্রধান বিষাক্ত উপাদান ছাড়াও সাপের বিষে আরও অনেক রকমের উৎসেচকের সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ফসফোলাইপেজ-এ2 (phospholipase-A2)। এটি প্রাণীকোষের কোষপর্দাকে ফাটিয়ে দিয়ে কোষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। কিছু সাপের বিষ কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, কেউ আবার কোষের বিপাকক্রিয়া থামিয়ে দেয়।
মজার বিষয় এই, যে শুধুমাত্র বিষাক্ত সাপের কামড়ে মানুষ মারা যায় এমন নয়, অনেক সময় নির্বিষ সাপও মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়। আসলে সাপ আমাদের মনে এতটাই ত্রাসের সঞ্চার করে যে সাপ দেখলেই আমরা প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই এবং আমাদের হৃৎস্পন্দন অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। ফলে কারোর কারোর ভয়েতে হার্ট অ্যাটাক হয়। সাপের বিষ আমাদের ভয়ের কারণ হলেও এটা মনে রাখতে হবে যে সাপ সাধারণত আমাদের ইচ্ছে করে কামড় দেয় না। সেই বিষ তাদের শিকার ধরার অস্ত্র। তাই ভয় পেয়ে সাপ মেরে না ফেলে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে।
তথ্যসূত্র
- Sanhajariya et al, 2018, Pharmacokinetics of Snake Venom. Toxins (Basel) volume 10
- https://en.m.wikipedia.org/
- https://www.thoughtco.com/
সাপের কামড়ে মানূষের মৃত্যু অনাকাংখিত নয়। কিন্তু বর্তমানে সাপের বিষের সাহায্যে অনেক কিছুই তৈরি করা যায়।
informative article. wish to read more