প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশে কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। একইরকমভাবেই সমগ্র বিশ্বের মধ্যে একটি অন্যতম পালনীয় দিবস হল বিশ্ব অ্যানাস্থেশিয়া দিবস (World Anesthesia Day)।
প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর সারা বিশ্ব জুড়ে ‘ বিশ্ব অ্যানাস্থেশিয়া দিবস ’ পালিত হয়। চিকিৎসাক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের সময় রোগীকে অচেতন করতে প্রথম ডাই-ইথাইল ইথারের ব্যবহার হয় ১৮৪৬ সালে এবং এই দিন থেকেই বড়ো ও জটিল চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে চেতনানাশক ব্যবহারের রীতি চালু হয়। ১৮৪৬ সালের সেই দিনটিকে স্মরণ করতেই সারা বিশ্ব জুড়ে এই বিশেষ দিনটি পালিত হয়। বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতিতে চেতনানাশক এক অতি প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য উপাদান হয়ে উঠেছে। এই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও তার সফল প্রদর্শনের ইতিহাসকে মনে রাখতেই বিশ্ব অ্যানাস্থেশিয়া দিবস পালন করা হয়ে থাকে বিশ্ব জুড়ে।
১৯০৩ সাল থেকে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে বিশ্ব অ্যানাস্থেশিয়া দিবস পালিত হয়ে আসছে। এর ঐতিহাসিক তাৎপর্যের দিকটি বিচার করতে গেলে প্রথমেই জানতে হবে, ১৮৪৬ সালের ১৬ অক্টোবর তারিখেই বস্টনের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটালে ইথারের সাহায্যে প্রথম সার্জিকাল অ্যানাস্থেশিয়ার প্রদর্শন করা হয়। আর সেই ঘটনাই এই বিশেষ দিবস পালনের একমাত্র কারণ। ঠিক সেই দিন ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের বুলফিঞ্চ বিল্ডিংয়ে গিলবার্ট অ্যাবট নামের একজন রোগীর চোয়াল থেকে একটি টিউমার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারিত করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন ডাক্তার জন কলিন্স ওয়ারেন। রোগীর চারপাশে উপস্থিত ছিল নিস্তব্ধ জনতা। এই সময়েই একটি কাচের গ্লাসে ইথারে ডোবানো স্পঞ্জ নিয়ে প্রবেশ করেন উইলিয়াম থমাস গ্রিন মর্টন। রোগী সেই ইথার নিশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করেন এবং ধীরে ধীরে রোগীর অস্ত্রোপচার শুরু হলেও কোনো ব্যথা অনুভব করেননি তিনি। কিন্তু বেঁচেই ছিলেন রোগী গিলবার্ট অ্যাবট। সেই থেকেই চিকিৎসাক্ষেত্রে চেতনানাশকের ব্যবহার শুরু হয়। প্রথমে মানুষের মনে অবিশ্বাস থাকলেও খুব দ্রুত এই আবিষ্কারের খবর ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র এক মাসের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য শহরে এবং গ্রেট ব্রিটেনেও ইথার ব্যবহৃত হতে শুরু করে। প্রথম প্রদর্শনের পাঁচ মাসের মধ্যে ১৮৪৭ সালের ২২ মার্চ ইথারের ব্যবহার শুরু হয় কলকাতা সহ ভারতের অন্য জায়গাতেও। ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের যে ঘরে এই ইথারের প্রথম প্রদর্শন হয়েছিল সেখানে বর্তমানে এই ঘটনার স্মারক হিসেবে স্থাপিত হয়েছে ‘ইথার ডোম’ এবং মর্টনের স্মৃতিতে বস্টন পাবলিক গার্ডেনের কাছেই স্থাপিত হয়েছে ‘ইথার মনুমেন্ট’ যা ‘দ্য গুড সামারিটান’ নামেও পরিচিত। উইলিয়াম থমাস গ্রিন মর্টনের স্মৃতিতে মাউন্ট অবার্ন সমাধিস্থলে তাঁর সমাধির উপরে বস্টনবাসীরা একটি মনুমেন্ট গড়ে তোলে। মর্টনের সেই ইথার চেতনানাশক যদিও বহু বিবর্তনের ফলে আজকের উন্নত অবস্থায় এসেছে। তাঁর হাত ধরেই চিকিৎসাক্ষেত্রে অ্যানাস্থেশিওলজির জগতে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। অনেক আগে কোনো অঙ্গ বাদ দিতে গেলে বা বড়ো ধরনের অস্ত্রোপচার করার সময়ে চেতনানাশক ব্যবহৃত হতো না, যার ফলে রোগীকে প্রবল যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো। এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেক সময় রোগীরা মারাও যেতো। চেতনানাশক হল এমন এক রাসায়নিক পদার্থ যার নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগের ফলে অস্ত্রোপচারকালে রোগীর অনুভূতি লুপ্ত হয় এবং ব্যথা অনুভূত হয় না। চেতনানাশক কোনো রোগীকে সাময়িকভাবে অচেতন করে দেয় যা চিকিৎসায় সুবিধে এনে দেয়। চিকিৎসার প্রকার, অস্ত্রোপচারের ধরন, রোগীর বয়স, লিঙ্গ, পূর্বের রোগের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় খেয়াল রেখেই চেতনানাশ বিশেষজ্ঞরা নির্দিষ্ট পরিমাণের চেতনানাশক প্রয়োগ করে থাকেন। সেই দিক থেকে মর্টনের এই প্রয়োগ সত্যই প্রশংসনীয়।
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ সোসাইটিস অফ অ্যানাস্থেশিওলজিস্টস তথা ডব্লিউএফএসএ (WFSA) কর্তৃক সারা বিশ্ব জুড়ে এই দিনটি পালিত হয়। কমবেশি দেড়শোটি দেশ থেকে প্রায় একশো চৌত্রিশটি অ্যানাস্থেশিওলজিস্টদের সংগঠন এই উদ্যাপনে সামিল হয়। বর্তমানে কোনো হাসপাতালেই ইথার ব্যবহার করা না হলেও মর্টনের কাজকে সকলেই স্বীকৃতি জানায়। আজকের বিশেষ এই দিনটিকে সামনে রেখে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে, হাসপাতালে কিছু সভা, সেমিনার, অনুষ্ঠান ইত্যাদি আয়োজিত হয়ে থাকে। WFSA প্রতি বছরই সারা বিশ্ব জুড়ে চেতনানাশক সরবরাহকারী চিকিৎসকদের এই বিশেষ দিনে সম্মানজ্ঞাপন করে এবং তাঁদের এই পেশাকে সম্মান জানায়। কিন্তু এত বছর পরেও মাত্র ৫০ কোটি মানুষ পুরো পৃথিবীতে এই চেতনানাশকের পরিষেবা গ্রহণ করতে সম্মত হন। এর কারণ অজ্ঞানতা এবং অসচেতনতা। ফলে এই বিশেষ দিনের মধ্য দিয়ে জনসচেতনতা প্রচারের চেষ্টা করে ডব্লিউএফএসএ। প্রতি বছর এই উদ্দেশ্যে এই সংস্থা চেতনানাশকের বিভিন্নপ্রকার পরিষেবাকে তুলে ধরে মানুষের সামনে। রোগীর সুস্থতা এবং অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সময়ে তার ভালো থাকা পুরোটাই নির্ভর করে অ্যানাস্থেশিওলজিস্টের উপর। এই দিনেই প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যাণ্ডে পালিত হয় জাতীয় অ্যানাস্থেশিয়া দিবস। সমগ্র বিশ্বের মধ্যে একমাত্র এই দুটি দেশেই চেতনানাশক ব্যবহার একেবারে সুরক্ষিত ও নিরাপদ। এখানে প্রতিটি অ্যানাস্থেশিওলজিস্ট অত্যন্ত সুপ্রশিক্ষিত। প্রতি বছরই এই বিশেষ দিনে এই দুটি দেশেই হাসপাতালের সামনে আলাদা কাউন্টার খোলা হয় যেখানে চেতনানাশ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক ইত্যাদির প্রদর্শনী হয়, চিকিৎসকেরাও সেখানে উপস্থিত থাকেন। সাধারণ মানুষের প্রতিটি সরাসরি প্রশ্নের উত্তর দেন তারা। সংবাদমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম বিভিন্ন উপায়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে চেতনানাশক সম্পর্কে সচেতনতা বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করা হয় অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যাণ্ডে।
প্রতি বছর নিয়মিতভাবে কোনো বিশেষ প্রতিপাদ্যকে (theme) সামনে রেখে এই দিনটি পালন করা না হলেও ২০২০ সালে ‘অকুপেশনাল ওয়েলবিইং টু অ্যানাস্থেশিওলজিস্টস ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ (Occupational Wellbeing to Anaesthetiologists World Wide) এই মর্মে একটি প্রকল্প চালু করা হয় সমগ্র বিশ্ব জুড়ে যেখানে চেতনানাশ বিশেষজ্ঞের পেশায় আসীন চিকিৎসকদের পেশাগত সমস্যার নিবারণের উপায় প্রচার করা হয়। সবসময় চিকিৎসার কারণে রাসায়নিক নির্ভরতা, মানসিক দুরাশা ইত্যাদি থেকে মুক্তি পেতে WFSA কর্তৃক কিছু উপায় সাব্যস্ত করা হয় যার মধ্যে নিয়মিত হারে অবসর নেওয়া, সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলা, উর্ধ্বতনদের সঙ্গে মানসিক চাপের ব্যাপারে আলোচনা করা, কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনের সুষম ভারসাম্য বজায় রাখা, কাজের সময় পুরো দিন জুড়ে ঠিকঠাক খাবার ও পানীয় গ্রহণ ইত্যাদি রয়েছে।