রামপ্রসাদের সেই বিখ্যাত গানটা মনে আছে? ‘ওরে নবমী নিশি না হইও রে অবসান…’। দশমীর বিসর্জনের আগে এ যেন প্রতিটি বাঙালির নিজস্ব আকুতি। প্রতি বছর পুজো আসে, পুজো চলে যায়। দেবী দুর্গা আমাদের ঘরের মেয়ে উমা হয়ে চার-পাঁচদিন কাটিয়ে যান এই মর্ত্যধামে। খুশির জোয়ার ওঠে বাংলায়, খুশির জোয়ার ওঠে বাঙালির ঘরে ঘরে। মহালয়ার পরে দেবীপক্ষের সূচনায় আমরা অধীর অপেক্ষায় বসে থাকি, দিন গুনি পঞ্চমীর আগমনের। তারপর একে একে ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী কেটে যায়, নবমীর মহারাত্রির চাঁদ যেন এক বিষাদের জ্যোৎস্না বিছিয়ে দেয় পৃথিবীতে। দশমী আসে, মায়ের বিসর্জন শেষে আবার হর্ষ-বিষাদ ভুলে আমরা ঘরে ফিরি। বাঙালির জীবনে তাই এই বিজয়া দশমী এক বিষাদের বার্তা নিয়ে আসে। তবে এই দশমীর দিনের মধ্যেও রয়েছে কিছু পৌরাণিক তাৎপর্য।
মহালয়ার মধ্য দিয়ে যে দেবীপক্ষ শুরু হয়েছিল তা লক্ষ্মীপুজোর মধ্য দিয়ে শেষ হলেও এর আগেই দেবী ফিরে যান তাঁর স্বামীগৃহে সুদূর কৈলাসে। আর আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের এই দশমী তিথিতেই দেবী ফিরে যান – এই দিনটিই বাঙালি সংস্কৃতিতে ‘দশমী’ বলে চিহ্নিত। ‘বিজয়া দশমী’ এই নামটির মধ্যে খেয়াল করলে দেখা যাবে দুটি শব্দ আছে ‘বিজয়া’ ও ‘দশমী’। দশমী বলার কারণ খুবই সরল যা আগেই বলা হল। এখন একে বিজয়া দশমী কেন বলা হয় এর একটি বিশেষ ব্যাখ্যা আছে। তার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে পুরাণের কাহিনীতে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে রয়েছে যে আশ্বিন মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে দেবী দুর্গা আবির্ভূতা হয়েছিলেন এবং টানা নয়দিন নয়রাত্রি ধরে মহিষাসুরের সাথে যুদ্ধের পর এই দশমীর দিনেই তিনি মহিষাসুরকে বধ করেন। শুভ শক্তির জয় হয় দশমী তিথিতে। তাই একে বিজয়া দশমী বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে ষষ্ঠীর দিন যে বোধন হয় এর সঙ্গে কিন্তু অসুর-বধের কোনো মিল নেই।
তবে দশমীর তাৎপর্যের এই পৌরাণিক ব্যাখ্যার পাশাপাশি হিন্দুদের দুই মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতেও দশমী তিথি পালনের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা বা কাহিনীরূপ বর্ণিত আছে। আমরা সকলেই জানি রামচন্দ্র সীতা উদ্ধারের জন্য রাবণের সঙ্গে সম্মুখ সমরে যাওয়ার আগে এই শরৎকালেই দেবী দুর্গার আবাহন করেছিলেন। একশো আটটি নীল পদ্ম দিয়ে পূজিতা হয়েছিলেন দেবী শারদীয়া তিথিতে। সেই পুজোটিই আমরা বহন করে চলে আসছি আশ্বিন মাসের ঠিক এই সময়টায়। এই গল্পেই দেখা যায় রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করে রাবণকে পরাস্ত করে সীতাকে নিয়ে যখন রামচন্দ্র ফিরে এলেন অযোধ্যায় সেই দিনটিকে এই দশমীর সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। যদিও উত্তর ভারত, মধ্য ভারত এবং পশ্চিম ভারতে এই দশমীর দিনটিকে ‘দশেরা’ হিসেবে পালন করা হয়। দশেরার দিন রামচন্দ্র অশুভ শক্তির প্রতীক রাবণের মাথা কেটে তাকে পরাস্ত করেছিলেন বলে সেই বিজয়ের অনুষঙ্গ মিশে আছে এই উদ্যাপনে। মহাভারতেও আবার এই একটি অন্য কাহিনী পাওয়া যায়। মহাভারতের বিরাট পর্বে দেখা যাবে পাণ্ডবেরা চোদ্দো বছর বনবাসের পরে এক বছরের অজ্ঞাতবাসের সময় বিরাট রাজার রাজ্যে এসে ছদ্মনামে বাস করছিলেন। একেক পাণ্ডবের একেক ছদ্মনাম ছিল। ইতিমধ্যে কীচক দ্রৌপদীকে লাঞ্ছনা করায় ভীম তাঁকে হত্যা করে ফেলেন এবং এই সংবাদ দুর্যোধন কোনোভাবে জানতে পেরে অনুমান করেন বিরাট রাজ্যেই পাণ্ডবেরা লুকিয়ে আছে। তাই কৌরবেরা সসৈন্যে বিরাট রাজ্য আক্রমণ করে বসেন। ইতিমধ্যে বিরাট রাজার পুত্র উত্তর বৃহন্নলারূপী অর্জুনকে নিয়ে সেই শমী গাছের নীচে গিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করেন এবং সেখানেই উত্তর সব ঘটনা পূর্বাপর জানতে পারেন। দুর্যোধন সহ সমস্ত কুরুবাহিনীর সঙ্গে অর্জুন একা হাতে প্রবল লড়াই করেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, অশ্বত্থামা একযোগে অর্জুনকে আক্রমণ করেন, কিন্তু অর্জুন মহাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে তাদের প্রত্যেককে পরাজিত করেন। মহাসম্মোহনাস্ত্র প্রয়োগ করে তিনি সমস্ত কুরু সৈন্যকে ঘুম পাড়িয়ে দেন। অর্জুনের এই বিজয়ের দিনটি রামচন্দ্রের বিজয়ের দিনের সঙ্গে একইসময়ে ঘটে বলে পৌরাণিক ব্যাখ্যায় বলা হয়। তাই অর্জুনের বিজয়ের সূচক যেমন বিজয়া দশমী, তেমনি রামচন্দ্রের বিজয়েরও। জয় থেকেই এসেছে ‘বিজয়া’।
তবে বাঙালিরা যেভাবে বিজয়া দশমী পালন করে দশেরার রীতি কিন্তু একেবারেই আলাদা। মনে রাখতে হবে দক্ষিণ ভারতে এই দশেরার রীতি চালু নেই। আর্য সংস্কৃতির ব্যাখ্যায় রাম দেবতা হলেও, দ্রাবিড়দের মধ্যে রাবণের এক আলাদা মাহাত্ম্য আছে। তাই রাবণের হত্যার দিন সেখানে পালিত হয় না। বিজয়া দশমীর দিন বাঙালিরা বিষন্ন চিত্তে মা দুর্গাকে প্রথমে বরণ করেন, মিষ্টি খাওয়ান, গালে সিঁদূর মাখান। তারপর মণ্ডপে মণ্ডপে চলে সধবা নারীদের মধ্যে সিঁদূর খেলার উৎসব। মনে করা হয় স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে জীবন অতিবাহিত করার শুভ কামনাতেই এই সিঁদূর খেলার প্রচলন হয়। দেবী দুর্গা ছিলেন সধবা আর তাই তার মতো সকল নারীর ভরা সংসার যাতে অটুট থাকে তাই এই রীতি। তারপর দেবীমূর্তিকে নিয়ে শোভাযাত্রা করে যাওয়া হয় গঙ্গার ঘাটে বা কোনো বড়ো জলাশয়ে। দেবীর প্রতিমা ভাসানো হয় জলে। বিসর্জিতা হন দেবী। তবে হিন্দুরা বিশেষত সকল বাঙালি হিন্দুরা বিশ্বাস করেন দেবীর বিসর্জন হয় না, বিসর্জন হয় প্রতিমার। দেবী আমাদের মাঝে সবসময় বিরাজ করেন। প্রতিমার বিসর্জন শেষে বাড়ি ফিরে পরিবার-পরিজনদের মধ্যে বাঙালিরা মেতে ওঠে পারস্পরিক আলিঙ্গনে। ছোটোরা গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন, সমবয়সীরা আলিঙ্গন করেন আর গুরুজনেরাও ছোটদের প্রাণভরে আসীর্বাদ করে থাকেন। বিষাদ-দুঃখ বিরাজ করে দশমীর বাংলায়। আবার মাকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় নিত্যদিনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়।
3 comments