কথায় বলে ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’। অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে সংসারে ধন-সম্পদ আহরণের পথ যাতে সুগম হয় সেই জন্যেই আদিকাল থেকে লক্ষ্মী দেবীর উপাসনার রীতি চলে আসছে বলে অনেকেই মনে করেন। দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে ধন-সম্পদ, অর্থ প্রাচুর্যের প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে যেন। সৌভাগ্য আর সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদে যেন প্রাচীন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ধানের গোলা ভরে উঠতো সোনার ধানে, পুকুরে-নদীতে ভরে উঠতো মাছ আর সরোবরে ফুটে উঠতো শতদল পদ্ম। গোয়ালে গরু, আস্তাবলে ঘোড়া, খেতে সোনার ফসল আর পুকুরে প্রাণের মাছ-এই সব পেয়েছির দেশে লক্ষ্মীদেবীর আবাহন হতো। আশ্বিন মাসের কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে বহু প্রাচীনকাল থেকে এই কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই বাংলায়। তবে আরেক ধরনের লক্ষ্মীপুজোও পালিত হয় দীপাবলির রাতে। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো র (Laxmi Puja) ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির শিকড়ের টান।
ঋগ্বেদে কিন্তু দেবী লক্ষ্মীর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। প্রাচীন পুরাণেও লক্ষ্মীর উল্লেখ নেই। কিন্তু তার বদলে শ্রীদেবীর উল্লেখ রয়েছে যিনি পদ্মের উপরে অধিষ্ঠিতা। পদ্মাসনা এই শ্রীদেবীই পরে দেবী লক্ষ্মীতে পরিণত হয়েছেন লোকশ্রুতিতে। দেবী লক্ষ্মীকে মনে করা হয় তিনি বিষ্ণু তথা নারায়ণের স্ত্রী। সমুদ্রমন্থনের কাহিনি স্মরণ করলে দেখা যাবে, সেখানে অমৃত মন্থনের ফলে সমুদ্র থেকে উত্থিতা হয়েছিলেন এক পদ্মাসনা দেবী, তিনি লক্ষ্মী নন – দেবী শ্রী। তিনিই সুখ, সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য, সৌভাগ্য সবকিছুর প্রতিভূ। সেই থেকে নানা যুগে নানা মানুষের বিশ্বাসে পরিবর্তিত হতে হতে তিনি দেবী লক্ষ্মীর রূপ নিয়েছেন। আশ্বিন মাসের কোজাগরী পূর্ণিমায় যখন হেমন্তের ধান পেকে উঠতো মাঠে মাঠে, সেই সন্ধ্যায় ভরা জ্যোৎস্নার পেলব কোমল আলোয় ভাসা চাঁদ বণিকের বাংলায় দেবী কোজাগরী লক্ষ্মী নেমে আসতেন মর্ত্যভূমিতে। তাই তাঁর উপাসনার জন্য সারা রাত জেগে থাকতেন ভক্তরা। সেই থেকেই এই পুজোর নাম ‘কোজাগরী’। কোজাগরী কথাটির উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত ‘কো জাগতি’ থেকে যার অর্থ হল- কে জেগে আছো। মানুষের বিশ্বাস পূর্ণিমার রাতে দেবী লক্ষ্মী স্বয়ং মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে দেখেন সকলে জেগে আছে কিনা। যারা জেগে থাকেন তাদেরকে দেবী ধন-সম্পদে ভরিয়ে দেন আর যারা নিদ্রাতুর থাকেন তাদের ধন-সম্পদ অকালেই নিশ্চুপে হ্রাস পেতে থাকে। তাই দেবী লক্ষ্মীর উপাসনা করে সারা বছর আর যাতে কোনো অন্নকষ্ট না থাকে, তাই এই দিন সারা রাত জুড়ে বাড়ির মহিলারা একত্রে লক্ষ্মী পাঁচালি পাঠ করেন, ছড়া কাটেন, দেবীর গুণকীর্তন করেন। হেমন্তের রাতের আকাশে ধীরে ধীরে চাঁদ মলিন হলে দেবী অন্তর্হিতা হন। মূলত আর্যের দেবী হলেও এই সুজলা-সুফলা বাংলায় আপামর মানুষ সেই স্বপ্নের সুখ-সমৃদ্ধি ফিরে পেতে লক্ষ্মীকে আপন ঘরের মেয়ে করে তুলেছে। তাই আজও মহিলারা প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীব্রত পালন করে থাকেন।
এই কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো র দিনে বাড়ির মহিলারা সমগ্র ঘর সুদৃশ্য আলপনা দিয়ে সাজিয়ে তোলেন। আলপনার গুরুত্ব এই পুজোয় খুবই বেশি। খড়িমাটির দেওয়া আলপনায় কখনো পদ্ম, কখনো লতাপাতা, কখনো আবার দেবী লক্ষ্মীর চরণ আঁকেন বাংলার মেয়েরা। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এক প্রবন্ধে বলছেন যে লক্ষ্মীপেঁচা, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আর ধানের ছড়া হল এই আলপনার প্রধান অঙ্গ। বাড়ির সদর দরজা থেকে শুরু করে লক্ষ্মী দেবীর ছোটো ছোটো পদচিহ্ন এঁকে লক্ষ্মীর আসন পর্যন্ত তুলে আনা হয়। কোথাও মূর্তিতে, কোথাও পটে আবার কোথাও বা সরায় দেবীর পূজা হয়ে থাকে। সরা হল মাটির তৈরি ছোটো থালার মতো। লক্ষ্মীর ছবি আঁকা সরাকে বলা হয় লক্ষ্মীসরা। সমগ্র আয়োজনটির মধ্যে লোকায়ত শিল্পের ছাপ স্পষ্ট। প্রাচীন বাংলায় দেবী লক্ষ্মী ছিলেন কৃষিজ সমৃদ্ধির প্রতীক, পরে ধীরে ধীরে বাণিজ্যের প্রসঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে পড়েন তিনি। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় প্রতিমা, সরার পাশাপাশি ব্যবহৃত হয় নবপত্রিকা এবং কলার পেটো। কোথাও কোথাও কলাপাতায় হরিতকী, স্বর্ণমুদ্রা, ধান, পান, কড়ি, হলুদ দিয়ে সাজানো হয় পুজোর স্থান। পঞ্চ অঙ্কুরীয় ব্যবহারের রীতিও লক্ষ করা যায় কোথাও কোথাও। মুগ, মসুর, কলাই, ছোলা, পাকা তালের আঁটি, নারকেল, তিল, ঝুরি, ক্ষীরের নাড়ু ইত্যাদি নানা উপচারে লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা হয়। খই-মুড়ি, গুড়ের মুড়কি, বাতাসা প্রায় সর্বত্রই দেওয়া হয় দেবীকে। তার সঙ্গে আবশ্যিক উপকরণ হল পদ্মফুল, ধানের ছড়া। লক্ষ্মীদেবীর ঘটে এইসময় ঐ ধান, মুদ্রা ইত্যাদি ভরে রেখে দেওয়া হয়। সমগ্র উপচারের মধ্যে দেবী লক্ষ্মীকে উর্বরতার দেবী হিসেবে কল্পনা করা হয়। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর ব্রত-এর মধ্যে লক্ষ্মী ও অলক্ষ্মীর একটি অদ্ভুত পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে। বাঙালিরা তাই এই অলক্ষ্মীকে দূর করে ধরে ধরে লক্ষ্মী দেবীকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যেই আয়োজন করে থাকে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো ।
5 comments