লক্ষ্মী

কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো ব্রত

আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো পালিত হয়। বলা হয় এই পুজো করলে তার ঘরে রাজলক্ষ্মী,ভাগ্য লক্ষ্মী, কুল লক্ষ্মী ও যশ লক্ষ্মী অচলা থাকেন। তার কোনো কিছুরই অভাব থাকে না। জেনে নেওয়া যাক এই ব্রতের পেছনে প্রচলিত কাহিনী।

এক দেশে রাজা ছিল। তিনি সৎ, ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তার দেশে এক নিয়ম ছিল। হাটে প্রজাদের যে সব জিনিস বিক্রি হবে না, তিনি তা ঠিক দামে তার প্রজাদের কাছ থেকে কিনে নেবেন। এক কামার হাটে একটি লোহার নারীমূর্তি বিক্রি করতে এনেছিলেন কিন্তু সারাদিনেও তা বিক্রি হয়নি। সে রাজবাড়িতে সে কথা জানালে ধর্মপরায়ণ রাজা তা কিনে নেন। সেইদিনই রাত্রে রাজা তার বাড়িতে কান্নার আওয়াজ শুনতে পান, সারা বাড়ি ঘুরে শেষে ঠাকুরঘরে দেখেন এক সুন্দরীনারী বসে কাঁদছে। রাজা তার সামনে গিয়ে বলেন, “কে মা তুমি? কাঁদছো কেন ?”
সে বলে “আমি রাজলক্ষ্মী, তোর বাড়িতে এতদিন ছিলাম,এখন আর থাকতে পারবো না, চলে যেতে হবে তাই কাঁদছি। “
রাজা বিনয় সুরে হাতজোড় করে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন মা আমি কি করলাম?”
সে বলল, “আমি যে আর থাকতে পারবো না। বাড়িতে যে তুই অলক্ষ্মী কিনে এনেছিস।”
তারপর কাঁদতে কাঁদতে রাজলক্ষ্মী চলে গেলেন।

খারাপ মন নিয়ে রাজা জানলার ধারে বসে ছিলেন হঠাৎ দেখলেন একজন নারী বেরিয়ে যাচ্ছে অমনি দৌড়ে গিয়ে রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, “কে মা তুমি? চলে যাচ্ছ কেন?”
সে বলল, “আমি তোমার ভাগ্যলক্ষ্মী তোমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ঘরে অলক্ষ্মী এনেছো থাকতে আর দিলে কই?”
রাজা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। এমন সময় দেখেন আরও এক সুন্দরী নারী বেরিয়ে যাচ্ছে, রাজা তাড়াতাড়ি তার পথ আগলে বললেন “তুমি কে মা?চলে যাচ্ছ কেন?”
সে বলে, “আমি যশলক্ষ্মী তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি।”

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

এই ভাবে একে একে রাজলক্ষ্মী,ভাগ্যলক্ষ্মী আর যশলক্ষ্মী তিনজনে রাজাকে ছেড়ে চলে গেলেন। রাজার চোখে ঘুম নেই, জানলা ধারে বসে থাকতে থাকতে দেখেন একজন পরম পুরুষ আর এক সুন্দরী নারী বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে, রাজা দোর আগলে কে তারা জানতে চাইলে সুন্দরীনারী বলেন আমি কুললক্ষ্মী, ঘরে অলক্ষ্মী আছে তাই তার থাকা হবে না। পরম পুরুষটি জানালেন তিনি  ধর্ম, কিন্তু অলক্ষ্মীর কারণে তাকেও যেতে হচ্ছে। সে কথা শুনে রাজা জিজ্ঞেস করলেন, ” আমার দোষ কি ?ধর্ম রক্ষা করতেই অলক্ষ্মীকে কিনেছি, ধর্মই আমার সম্বল। এই ধর্মবলে আমি রাজলক্ষ্মী,ভাগ্যলক্ষ্মী,যশলক্ষ্মী ,কুললক্ষ্মী সবাইকে যেতে দিয়েছি।আমি ধর্মপ্রাণ, ধর্ম ত্যাগ করিনি,আমি আপনাকে যেতে দেব না।”
ধর্ম দেখলেন রাজার কথাই ঠিক তিনি রয়ে গেলেন। কিন্তু রাজার অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে থাকে, তার সব সুখ হারিয়ে যায়। রানী যে দিন যেমন হয় তাই যত্ন করে রাজাকে খাওয়াতে থাকেন। রাজা খেতে বসলেই পঙ্গপালের মত পিঁপড়ের দল থালার চারদিকে ঘিরে বসত। রাজা রানীকে তার খাবারে ঘি দিতে বারণ করলেন। তিনি খেতে বসেন খাবার থালার চারদিকে পিঁপড়ের দল এসে জড়ো হয় কিন্তু খাবারে তাদের রুচি হয় না। তাই দেখে এক পিঁপড়ে বলে ওই অলক্ষ্মীর জন্য রাজা এমন গরিব হয়েছে যে খাবারে ঘি জুটছে না। তা শুনে রাজা হা হা করে হেসে উঠেন।রানী দেখতে পেয়ে বললেন আপনি এমন নিজের মনে হাসছেন কেন?  রাজাও বলবেন না আর রানীও ছাড়বেন না। রাজা তখন বলেন এই কথা বললেই আমার প্রাণ যাবে, তাও যদি তুমি শুনতে চাও তো বলবো। তাও রানী শুনতে চায় শুনে তিনি বলেন আমি মরলে যদি খুশি হও তাহলে ওই নদীর ধারে চলো বলব। রানী ভাবে কথা বললে আবার কেউ মারা যায় নাকি? তারা নদীর ধারে এসেছে,হঠাৎ এক শিয়ালিনী শিয়ালকে বলে ,ওই দেখো জলে মরা ভেসে যাচ্ছে নিয়ে এসো দুজনে খাওয়া যাবে।তাই শুনে শেয়াল বলে আমি কি রাজার মতো বোকা নাকি যে রানীর কথায় প্রাণ দেব। রাজামশাই সে কথা শুনতে পেয়ে রানীকে সেথায় ফেলে রেখে দৌড় দেয়। রানী কাঁদতে কাঁদতে নদীর ধারে থেকে যান।
এই ভাবে অনেক দিন পার হয়ে যায়।

দেখতে দেখতে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথি এল, রানী দেখলেন নদীর ঘাটে শঙ্খ, ঘন্টা, ধুপ ধুনো দিয়ে কারা কি সব করছে। রানী এগিয়ে এসে মেয়েদের জিজ্ঞাসা করলেন তারা কি করছে, তখন তারা বলে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো করছে। এবং সঙ্গে এও জানায় এই পুজো করলে অলক্ষ্মী দূর হয়, মা লক্ষ্মীর কৃপাদৃষ্টি লাভ হয়। তাই শুনে রানী তাদের কাছ থেকে রং মাখানো পিটুলি চেয়ে লক্ষ্মী গড়ে নারিকেল,চিড়ে, তালের ফোঁপর দিয়ে পুজো করলেন। তারপর গল্প গান করে সারারাত জেগে কাটালেন।

ওই দিকে রাজবাড়িতে যে লোহার অলক্ষ্মী ছিল সকাল হতেই তা কোথায় গেল কেউ জানতে পারলো না। ধর্ম এসে রাজাকে বললেন, “আপনার অমঙ্গল কেটে গেছে অলক্ষ্মী দূর হয়েছে। আপনি রানীকে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন।”
রাজা পালকি নিয়ে রানীকে ফিরিয়ে আনলেন। তারপর খুব ঘটা করে লক্ষ্মী পুজো করে আবার সব ফিরে পেলেন।এই ভাবে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর মাহাত্য সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।

তথ্যসূত্র


  1. মেয়েদের ব্রতকথা- লেখকঃ আশুতোষ মজুমদার, প্রকাশকঃ অরুণ মজুমদার, দেব সাহিত্য কুটির, পৃষ্ঠা ৭
  2. মেয়েদের ব্রতকথা- লেখকঃ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য সম্পাদিত ও রমা দেবী কর্তৃক সংশোধিত, প্রকাশকঃ নির্মল কুমার সাহা, দেব সাহিত্য কুটির, পৃষ্ঠা ১১০

One comment

আপনার মতামত জানান