সতীপীঠ গন্ধকী

সতীপীঠ গন্ধকী

সতীপীঠ গন্ধকী নেপালের পোখরা থেকে ১২৫ কিমি দূরে নেপাল-তিব্বত সীমান্তে কালী গন্ডকী নদীর উৎপত্তিস্থলে মাসতং-এ অবস্থিত। নদীর উৎসমুখের কুন্ডে মূলত দেবীর বিগ্রহের অবস্থান। এখানে দেবী মূর্তি নেই কোনো, শিলাখন্ডকে দেবীরূপে আরাধনা করা হয়। এই সতীপীঠে অধিষ্ঠিত দেবী গন্ধকী চন্ডী এবং ভৈরব হলেন চক্রপাণি। এই মন্দিরটি ‘মুক্তিনাথ মন্দির’ নামেও পরিচিত।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় গন্ধকী সতীপীঠে সতীর মস্তক এসে পড়েছিল৷ তবে অনেকের মনে করেন এখানে দেবীর দক্ষিণাগন্ড (কপোলা) পতিত হয়েছিল।

এই গন্ধকী শক্তিপীঠের মন্দির অর্থাৎ মুক্তিনাথ মন্দিরের উল্লেখ বিষ্ণুপরাণেও পাওয়া যায়। এটি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থানের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। তিব্বতীয় বৌদ্ধ ঐতিহ্য মতে, তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু রিনপোচে যিনি পদ্মসম্ভব নামেও পরিচিত, তিব্বতে যাওয়ার পথে মুক্তিনাথে ধ্যান করেছিলেন। এই মন্দিরটি হিন্দু ঐতিহ্যের অনেক সাধুদের দ্বারা প্রশংসিত হয়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

দর্শনার্থীরা বিশ্বাস করেন যে মুক্তিনাথ মন্দির সংলগ্ন গন্ডকী নদীতে স্নান করলে সমস্ত পাপ ধুয়ে মোক্ষলাভ হয়। আবার এই নদীতেই ভগবান বিষ্ণুর প্রতীক শালগ্রাম শিলা পাওয়া যায় বলে কথিত আছে। এও বলা হয় যে, কোনো ব্যক্তির অপূর্ণ কোনো ইচ্ছা থাকলে ভক্তি সহকারে দেবী গন্ধকীর পূজা করলে সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়।

মুক্তিনাথ মন্দিরটি বৌদ্ধ প্যাগোডা ধরনে নির্মিত। এই মন্দিরটি মূলত ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। প্রায় ৩৮০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই মুক্তিনাথ মন্দির৷ বিষ্ণুকে উৎসর্গ করা আটটি প্রধান মন্দিরের মধ্যে এটি একটি। অন্য সাতটি হল,  শ্রীরঙ্গম, শ্রীমুষ্ণম, তিরুপতি, নৈমিষারণ্য, থোতাদ্রি, পুষ্কর এবং বদ্রীনাথ। ভগবান বিষ্ণুর একটি লম্বা সোনার তৈরি মূর্তি এখানে লক্ষ্য করা যাবে। মন্দির প্রাঙ্গনে অবস্থিত ১০৮টি ষাঁড়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুখ দিয়ে সর্বক্ষণ জল পড়ে। মন্দিরের কাছেও ১০৮টি জলের ঝর্ণা রয়েছে। এই মন্দিরের নিকটেই রয়েছে বাল্মিকীর আশ্রম, যেখানে বসে বিখ্যাত মহাকাব্য রচনা করেছিলেন তিনি।

যদিও দেবীমূর্তি হিসেবে একটি শিলাখন্ড পূজিত হয় এই সতীপীঠে, তবে সেটিকেও উত্তমরূপে লাল বস্ত্রে সাজিয়ে সোনালি রঙের বড় বড় চক্ষু তাতে স্থাপন করা হয়েছে। বিগ্রহের মাথায় স্বর্ণোজ্জ্বল একটি মুকুটও শোভা পায়।

প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। এই সতীপীঠের দেবীর নাম হল গন্ধকী চন্ডী এবং ভৈরব হলেন চক্রপাণি।

মূলত বছরে দুবার, মার্চ বা এপ্রিল মাসে এবং সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে ধুমধাম করে এই মন্দিরে নবরাত্রি উৎসব পালিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং দেশের বাইরে থেকেও ভক্তের দল এসে ভীড় জমায় তখন৷ এই উৎসব নয়দিনেরও বেশি সময় ধরে উদযাপিত হয়ে থাকে। দেবীকে বিশেষ যজ্ঞ ও পূজাও দেওয়া হয় তখন। এসময় অনেকে মাটি থেকে উৎপাদিত শস্য গ্রহণ করেন না। নবরাত্রি ছাড়াও শিবরাত্রি এখানে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করা হয় ।

আপনার মতামত জানান