শিবরাত্রি

শিবরাত্রি ব্রত

ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশ তিথিতে যে ভয়ানক অন্ধকার রাত্রি হয়, সেই রাতেই শিবরাত্রি পালন করা হয়। বলা হয় সব ব্রতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল শিবরাত্রি ব্রত। ব্রতের আগের দিন ভক্তগণ নিরামিষ খায়। ব্রতের দিন তারা উপবাসী থাকে। তারপর রাত্রিবেলা চার প্রহরে চারবার শিবলিঙ্গের পূজা করে। বাংলায় প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী সাধারণত মেয়েরা ভাল স্বামী পাবার আশায় শিবরাত্রি ব্রত পালন করে। কিন্তু শিবরাত্রি শুধুই মেয়েদের জন্য নয়। ছেলেরাও শিবরাত্রি করতে পারে এবং করেও থাকে। তাছাড়া এক জন পুরুষই তো প্রথম শিবরাত্রি করেছিল। বলা হয় ঐ রাত্রে যে ব্যক্তি উপবাস করে শিবের পূজা করে, তার ওপর শিব খুব খুশি হয়। পুরাণ অনুযায়ী শিব নিজেই পার্বতীকে বলেছিলেন এই কথা। জেনে নেওয়া যাক এই ব্রতের পেছনে প্রচলিত কাহিনী।

অনেকদিন আগে বারাণসীতে এক ব্যাধ বাস করত। দিন রাত বনে সে জীবহত্যা করে বেড়াত বলে তার অনেক পাপ জমা হয়েছিল। একদিন একইভাবে শিকারের সন্ধানে বেড়িয়ে সে গভীর বনে ঢুকে পড়েছিল। সারাদিন ধরে অনেক চেষ্টা করেও সে কোনো শিকার করতে না পেরে যখন বাড়ি ফেরার পথ ধরে, তখন অনেক রাত হয়ে গেছিল। সেই রাত ছিল ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর রাত। সারাদিন ধরে কিছু খেতে না পেয়ে এমনিতেই তার অবস্থা কাহিল হয়ে গেছিল, তারপর এত রাতে কোথায় যাবে, আবার বাড়ি গেলেও তো ফাঁকা হাতেই যেতে হবে, কারও জন্য কোনো খাবারও নিয়ে যেতে পারবে না, এইসব ভেবে সে আর বাড়ি ফিরবে না ঠিক করল। তারপর হিংস্র পশুদের থেকে বাঁচতে  কাছেই একটা গাছ দেখে সে তাতে উঠে পড়ল। সারারাত সে ঐখানেই জেগে থাকল। সেই গাছটা ছিল বেলগাছ। গাছের নীচে বহুকালের পুরনো একটা শিবলিঙ্গ ছিল। সারাদিনের কিছু না পাওয়ার কষ্টে ব্যাধের চোখের জল সেই শিবলিঙ্গের মাথার ওপর পড়ল। সঙ্গে তার হাতের নড়াচড়ায় কিছু শুকনো বেলপাতাও শিবলিঙ্গের মাথার ওপর পড়ল। সারাদিন শিকারের পেছনে ছুটতে ছুটতে তার কিছু খাওয়া হয়নি। তাই শিবরাত্রি পালনের শর্তগুলো সে না জেনেই পালন করে ফেলল। এতে তার অজান্তেই শিবরাত্রি পালন হল।

সকালে বাড়ি ফিরে সে তার বউকে রান্না করতে বলে নদীতে স্নান করতে গেল। ফেরার পথে রাস্তায় একজনের সাথে দেখা হল। সে ব্যাধের কাছে কিছু খেতে চাইল, তখন ব্যাধ তাকে নিয়ে বাড়িতে এল এবং তাকে পেট ভরে খাইয়ে নিজেও খেল। এতে করে আবারও তার অজান্তেই শিবরাত্রির ব্রত সে সম্পূর্ণ করল।

কিছুদিন পর যখন ব্যাধের মৃত্যু এসে উপস্থিত হল, তখন যমদূতেরা তাকে নিতে এল। কিন্তু শিবের পাঠানো দূতেদের হাতে পরাজিত হয়ে তারা শিবের দূতের পেছনে পেছনে কৈলাসে এসে উপস্থিত হল। কৈলাসের মুখে পাহারায় থাকা নন্দী তাদের বলল যে ব্যাধ মহাপাপী হলেও  শিবরাত্রি ব্রত পালনে তার পাপ ধুয়ে গেছে। সেই শুনে যমদূতেরা যমলোকে ফিরে গেল।

তারা যমকে সব কথা খুলে বলল। তারা বলল, “আজ থেকে এইসব মহাপাপীদের ওপর আপনার অধিকার যে রইল না। এটা কেমন হল?”
তখন যম তাদের বুঝিয়ে বলল, “যে লোক শিব কিংবা বিষ্ণুভক্ত, যে লোক শিবরাত্রি ব্রত করে বা বারানসীতে মরে, তার ওপর আমাদের অধিকার থাকে না।”

বাংলা তথা পুরো ভারতেই এই দিনটি মহাসমারোহে পালিত হয়। যদিও আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এই ব্রত নারী পুরুষ উভয়দের জন্যই, তবুও প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই ব্রত পালন করলে নাকি নারীর সব কামনা পূর্ণ হয়ে যায় । প্রাচীন যে সমাজে এই ব্রতের প্রচলন হয়, সেখানে মেয়েদের কামনা বলতে, তাদের চাওয়া বলতে সন্তান, স্বামী আর পরিবার।  কুমারী, সধবা বা বিধবা যাই হোক না কেন পরিবারের বাইরে অন্য কিছু চাইবার ভাবনাই তাদের ছিল না। আজ তারা আধুনিক হয়েছে, রীতি বদলে এই ব্রত বাৎসরিক উৎসবের মত রয়ে গেছে। কিন্তু এর পালনে কোনো ভাটা পড়েনি। যদিও আগের থেকে অনেককিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। যেমন সত্তরের দশকে বাংলায় শিবরাত্রি পালনের সাথে সিনেমাহলের একটা আত্মীয়তা ছিল। শিবরাত্রির দিন জেগে থাকতে দর্শকের ভিড় হত সিনেমায়। সেইসময় চড়া দামে টিকিট বিক্রি হত এবং সারারাত চলত সিনেমা। অন্তত তিনটে শো চালাত হল মালিকেরা। শিব-ভক্তরা ব্রত পালনের জন্য রাত জাগত হলে বসেই। এখন সে চল না থাকলেও শিবরাত্রি হলে রাত জাগা বা ব্রত পালনের কোনো খামতি নেই।

তথ্যসূত্র


  1. সংক্ষিপ্ত শিবপুরাণ, গীতাপ্রেস, গোরক্ষপুর, কোটিরুদ্রসংহিতা, পৃষ্ঠা ৩৯৩ - ৪০১
  2. মেয়েদের ব্রতকথা- লেখকঃ আশুতোষ মজুমদার, প্রকাশকঃ অরুণ মজুমদার, দেব সাহিত্য কুটির, পৃষ্ঠা ১৮২
  3. মেয়েদের ব্রতকথা- লেখকঃ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য সম্পাদিত ও রমা দেবী কর্তৃক সংশোধিত, প্রকাশকঃ নির্মল কুমার সাহা, দেব সাহিত্য কুটির, পৃষ্ঠা ১৭৩
  4. https://www.anandabazar.com/editorial/শিবের-মতো-বর-চাইতে-শেখানো-হল-কেন
  5. anandabazar.com/movie-in-shivratri
  6. https://ebela.in/why-is-sivaratri-a-women-s-festival-only-in-bengal
  7. https://bn.wikipedia.org/wiki/shibratri

 

14 comments

আপনার মতামত জানান