নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র একটি মন্দির। যদিও নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গের অবস্থান নিয়ে অনেক মতানৈক্য আছে, তবে সর্বাধিক প্রচলিত মত অনুসারে এই মন্দির গুজরাট রাজ্যের সৌরাষ্ট্রের উপকূলে দ্বারকা শহর থেকে প্রায় ১৭ কিমি দূরে অবস্থিত। রূদ্র সংহিতায় নাগেশ্বরকে ‘দারুকাবনে নাগেশম’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং শিবপুরাণ অনুযায়ী নাগেশ্বর দারুকাবনে অবস্থিত। তবে এই দারুকাবনের অবস্থান নিয়েই বিতর্ক রয়েছে। কিছু সূত্র দারুকাবন নামের সঙ্গে দেবদারু বনের সংযোগ আছে বলে মনে করে কিন্তু গুজরাটের নাগেশ্বর মন্দির এলাকার আশেপাশে কোনো দেবদারু বনের অস্তিত্ব নেই। অনেকে অবশ্য দারুকাবনের সঙ্গে দ্বারকার নামগত মিলের দিকে ইঙ্গিত করেন। অন্য মতে উত্তরাখন্ডের আলমোড়ার কাছে এরকম দেবদারু বন দেখা যায়, অতএব সেখানকার যোগেশ্বর মন্দিরকে অনেকে নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ বলে মনে করেন। তৃতীয় একটি মতে, মহারাষ্ট্রের হিঙ্গোলি জেলায় বিন্ধ্যের জঙ্গলের নিকটবর্তী আউন্ধা নাগনাথে অবস্থিত মন্দিরটিই নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ। তবে গুজরাটের মন্দিরটিকেই নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গের মন্দির হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় বলেই এখানে সেই মন্দিরকে কেন্দ্র করেই আলোচনা করা হল।
শিবপুরাণ অনুযায়ী একদা ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে দুজনের তুমুল বিবাদ উপস্থিত হয়। সেই বিবাদ সন্তোষজনক পরিণতিতে না পৌঁছে চলতেই থাকলে মহাদেব তখন একটি আলোকরশ্মির স্তম্ভ রূপে তাঁদের দুজনের মাঝখানে প্রকট হন। ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু কেউই সেই আলোকস্তম্ভের আদি ও অন্ত খুঁজে পাননি। শেষমেশ তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই দিব্য জ্যোতিই শ্রেষ্ঠতম। এভাবেই জ্যোতির্লিঙ্গের ধারণাটির উদ্ভব হয়।
বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে অন্যতম হল নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ। এই জ্যোতির্লিঙ্গকে ঘিরে জনপ্রিয় কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। শিব পুরাণে রাক্ষস দারুক এবং তার স্ত্রী দারুকার একটি আখ্যান রয়েছে। দারুক ও দারুকা ষোড়শ যোজন ব্যাপী এক বনে বাস করত (পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে তাদের নাম থেকেই সেই বন দারুকাবন নামে পরিচিত হয়েছিল )। বন থেকে বেরিয়ে রাক্ষস দারুক বাইরে গিয়ে নানারকম অত্যাচার, ভাঙচুর চালিয়ে পুনরায় ফিরে আসত বনে। এরপর দারুকা দেবী পার্বতীকে খুশি করবার জন্য কঠোর তপস্যা করে। দেবী পার্বতী তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দেন যে, যেখানে সে যাবে, সেই বনটিও তাদের পিছন পিছন যাবে। এদিকে রাক্ষসের অত্যাচারে দেবতা, মানুষ সকলেরই জীবন যখন অতিষ্ঠ, তখন দেবতারা শৈবতেজা ঋষি ঔর্বের কাছে আত্মরক্ষার জন্য গেলেন। ঔর্ব রাক্ষসদের অভিশাপ দেন যে, পৃথিবীতে হিংসা করলেই তাদের মৃত্যু হবে। এই অভিশাপ শুনে রাক্ষসরা যখন অসহায় হয়ে পড়ে, তখনই দেবতারা রাক্ষসদের আক্রমণ করে। দেবতাদের হাতে মুখ বুজে তারা আঘাত সহ্য করতে থাকে কিন্তু পালটা কাউকে হত্যা করতে পারে না অভিশাপের ভয়ে। সেই সময় দারুকা এগিয়ে এসে পার্বতীর দেওয়া বরের কথা ঘোষণা করল এবং রাক্ষসদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য সেই বিশাল বন উড়িয়ে নিয়ে এসে সাগরজলের নীচে স্থাপন করল। তারপর সেই সাগরে নৌকাযাত্রীদের ওপর লুটপাট, অত্যাচার শুরু করে রাক্ষসের দল। একদিন জলপথ আটকে বিরাট একটা নৌকাকে আটক করে যাত্রীদের জলের তলায় নিজেদের কারাগারে বন্দী করে রাখল তারা। সেই বন্দীদের মধ্যে সুপ্রিয় নামের একজন বৈশ্য ছিলেন যিনি একনিষ্ঠ এক শিবভক্ত। দিবারাত্র শিবের পূজা করতেন তিনি। একদিন কারাগারের প্রহরীরা দেখল সুপ্রিয়র সামনে এক মূর্তির আবির্ভাব ঘটেছে৷ প্রহরীদের সংবাদে রাক্ষসরাজ দারুক নিজে কারাগারে দেখতে আসে ঘটনাটা। দারুকের আদেশে প্রহরীরা সুপ্রিয়কে হত্যা করতে উদ্যত হলে, সেই কারাগারের মধ্যেই জ্যোতির্লিঙ্গস্বরূপ মহাদেবের আবির্ভাব ঘটল। তারপর পাশুপত অস্ত্রের দ্বারা সমস্ত রাক্ষসকে নির্মূল করলেন মহাদেব। ভক্তদের রক্ষা করবার জন্য শিব সেই স্থানেই অবস্থান করতে লাগলেন এবং নাগেশ্বর নামে পরিচিত হলেন।
আরেকটি কিংবদন্তি অনুসারে, মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভীম একটি দুধ এবং ক্ষীরে ভরা নদী দেখতে পেয়েছিল। বাকি ভাইয়ের নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলে তাঁরা নদীর মাঝে একটি স্বয়ম্ভু লিঙ্গ খুঁজে পেয়েছিলেন। মনে করা হয় ঠিক সেই স্থানেই এই নাগেশ্বর মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল। ভক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে রূদ্রাভিষেকম করে ভগবান শিবকে খুশি করেছিলেন।
নাগেশ্বর মন্দিরটির প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় না৷ তবে প্রচলিত একটি জনশ্রুতি অনুসারে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব যতবারই এই মন্দির ধ্বংস করবার চেষ্টা করেছিলেন ততবারই মৌমাছির ঝাঁক সম্রাটের সেনাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। বর্তমান মন্দিরটি টি-সিরিজের মালিক শিবভক্ত গুলশান কুমার ১৯৯৬ সালে নিজের উদ্যোগে পুনর্নির্মাণ শুরু করেছিলেন। তবে নির্মাণ চলাকালীনই গুলশাল কুমারের মৃত্যু হলে তাঁর পরিবার মন্দির নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করবার দায়িত্ব নিয়েছিল। এই মন্দির পুননির্মাণের ব্যয় বহন করেছিল গুলশাল কুমার চ্যারিটেবল ট্রাস্ট। মন্দিরের ভিতরে সেই কারণেই গুলশান কুমারের ছবিও লক্ষ করা যায়।
এই নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গের মন্দির নিঃসন্দেহে এক সূদৃশ্য স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন। প্রথমত, মন্দিরে ঢোকার পূর্বেই দূর থেকে মন্দিরের একটু পাশেই বিশালাকার ধ্যানমগ্ন এক শিবের মূর্তি দেখতে পাবেন ভক্তবৃন্দ। সেই মূর্তিটির উচ্চতা ১২৫ ফুট এবং চওড়ায় সেটা ২৫ ফুট। মূলত তিনটি স্তরে এই মন্দিরটি বিভক্ত, গর্ভগৃহ, রঙ্গমন্ডপ এবং অন্তরাল। মন্দির প্রাঙ্গনে সপরিবার শিব-পার্বতীর মন্দির দেখা যায়। এই মন্দিরটি শয্যারত একটি মানবদেহের মতো করে পরিকল্পিত। প্রথমেই মহাদ্বার অর্থাৎ মানুষের পা। এটিই মন্দিরের প্রধান ফটক যেখান থেকে ভক্তবৃন্দ মূল মন্দিরে প্রবেশ করেন। মন্দিরের প্রবেশপথটি পশ্চিমমুখী। ফলে ভক্তরা যখন শিব উপাসনা করেন তখন তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই সূর্যের মুখোমুখি হন। এরপরই প্রবেশদ্বার সংলগ্ন বারান্দা, যার একদিকে রয়েছে ভগবান হনুমান এবং অপরদিকে ভগবান গণেশের মূর্তি, যাঁরা আসলে দুটি হাতের প্রতীকরূপে বিরাজ করছেন। এরপর পড়বে একটি সভামন্ডপ যাকে পেট এবং বুকের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। সেটি মূলত আসন সমন্বিত একটি প্রার্থনার হলঘর। ঠিক এরপরের অংশ অন্তরাল নামে পরিচিত। এটি আসলে শিবের বাহন নন্দীর উপাসনাস্থল। মনে করা হয় এটি মূল গর্ভগৃহকে রক্ষা করে। সবশেষে আসে প্রধান জ্যোতির্লিঙ্গের বাসস্থান মূল গর্ভগৃহ, এটি হল মানুষের মাথার প্রতীক। গর্ভগৃহের প্রবেশপথের কাছে দেবী দূর্গার একটি মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। মন্দিরটিতে প্রচুর খিলান, নলাকার বাঁশির আকৃতির অনেকগুলি কলাম, পদ্মাকৃতি অনেক কাঠামো ছড়িয়ে রয়েছে। নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গটি ত্রিমুখী রুদ্রাক্ষ নামে পরিচিত, কারণ লিঙ্গটি তিনমুখ বিশিষ্ট ডিম্বাকৃতি রুদ্রাক্ষের মতো দেখতে। লিঙ্গটিকে জড়িয়ে মাথার ওপর ফনা তুলে রয়েছে রুপালি রঙের একটি সাপ। জ্যোতির্লিঙ্গের ঠিক পিছনদিকে রয়েছে দেবী পার্বতীর একটি মূর্তি। এই জ্যোতির্লিঙ্গটি দক্ষিণমুখী এবং এর পিছনেও একটি কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। নামদেব নামে একজন ভক্ত শিবলিঙ্গের সামনে বসে শিবের নামগান করছিলেন, তখন ভক্তরা তাঁকে শিবলিঙ্গ আড়াল করতে বারণ করে। নামদেব তখন সেই ভক্তদের বলেছিল তাহলে এমন একটি জায়গা তাঁকে দেখিয়ে দিতে যেখানে শিব বিরাজ করছেন না। ভক্তেরা তখন নামদেবকে ধরে দক্ষিণদিকে নিয়ে গেলে সকলে অবাক হয়ে দেখেছিল যে, লিঙ্গটিও ধীরে ধীরে দক্ষিণমুখী হয়ে যায়।
বছরের বিভিন্ন সময়ে এই নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গের মন্দিরে নানারকম উৎসব ধুমধাম করে বিশেষ অনুষ্ঠান, রীতিনীতি-সহযোগে পালিত হয়ে থাকে। প্রথমেই বলতে হয় মহাশিবরাত্রির কথা। ফাল্গুন মাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে বা মার্চ মাসের শুরুর দিকে এই উৎসব পালন করা হয়। এই দিনটিতে নাগেশ্বর মন্দিরে কঠোর বিধিনিষেধ সহকারে বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়, ভক্তরা শিবলিঙ্গকে ফুল দিয়ে সজ্জিত করে দুধ দিয়ে শিবের অভিষেক করে এবং শিবের ভজনের আয়োজন করা হয়ে থাকে। মন্দিরের মাঠে বিরাট মেলাও আয়োজিত হয় এই শিবরাত্রি উপলক্ষে।দ্বিতীয়ত শ্রাবণ মাসের উৎসবের কথা বলতে হয়। এটিকে আসলে মহাদেবেরই মাস বলা চলে। ভক্তরা উপবাস করে মন্দিরে যান, প্রার্থনা করেন শিবের কাছে। বিশেষত শ্রাবণ মাসের সোমবারগুলি হয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেইসময় মন্দিরে ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে।নাগেশ্বর মন্দিরে উদযাপিত আরেকটি উৎসব হল নবরাত্রি। এই উৎসব নয় রাত জুড়ে এক ঐশ্বরিক নারী শক্তির উপাসনার উৎসব। দূর্গাপূজার সঙ্গেই এই নবরাত্রি পালিত হয়। গুজরাটে এই নবরাত্রি অত্যন্ত জনপ্রিয়। নাগেশ্বর মন্দির এই নবরাত্রিতে বিশেষভাবে সজ্জিত হয়ে ওঠে, ভক্তেরা বিশেষভাবে প্রার্থনা জানাতে আসেন মন্দিরে। তখন গরবা এবং ডান্ডিয়া নৃত্যের মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।এই উৎসবগুলি ছাড়াও দীপাবলি, দোল ইত্যাদি জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয় এই নাগেশ্বর মন্দিরে।
বিশ্বাস করা হয়, নাগেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলে ভক্তেরা বিষমুক্ত হন অর্থাৎ নেতিবাচকতা থেকে মুক্তি পান এবং জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। সেই কারণে সারাবছরই এই নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গের মন্দিরে ভক্তদের আনাগোনা লেগেই রয়েছে।
তথ্যসূত্র
- পৌরাণিক গল্পসমগ্র :- শিবপুরাণ, শতদ্রুশোভন চক্রবর্তী, পুস্তক বিপণি, মহালয়া আশ্বিন ১৩৬৪, পৃষ্ঠা :- ৮৮-৯১
- https://deoghar.co/
- https://myoksha.com/
- https://www.thedivineindia.com/
- https://lemonicks.com/
- https://incredibleindiaexplore.com/
- https://www.astroved.com/
- https://thrillingtravel.in/
- https://behindeverytemple.org/