সববাংলায়

দোলযাত্রা ।। হোলি

বাঙালির কাছ দোল মানে  শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব। ফাল্গুনী পূর্ণিমা অর্থাৎ দোলপূর্ণিমার দিনই শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসবের আয়োজন করা হয়। রঙ আর আবীরে ভরা এই উৎসব সকল বাঙালির এক প্রিয় উৎসব। বৈষ্ণব ধারণা অনুযায়ী, এইদিন বৃন্দাবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির নিয়ে রাধা ও অন্যান্য গোপীদের সাথে রং খেলায় মেতেছিল। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি বলা হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবিরে স্নান করিয়ে দোলায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রায় বের করা হয়।

বাংলায় যা দোল, সারা ভারতে এমনকি সারা বিশ্বে তার পরিচিতি ‘হোলি’ নামে। ‘হোলি’ শব্দটির উৎপত্তি ‘হোলিকা’ থেকে। হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর পত্নী দিতির পুত্র দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু’র বোন। পুরাণ অনুসারে হিরণ্যকশিপু ছিলেন মুলতান এর রাজা।হিন্দু পুরাণের অন্যতম ‘স্কন্দপুরাণ’ গ্রন্থের ‘ফাল্গু্নমাহাত্ম্য’ অংশে হোলিকা ও প্রহ্লাদের গল্প বলা হয়েছে। ব্রহ্মার বরে হিরণ্যকশিপু এমন ক্ষমতা পান যাতে কোন দেবতা, কোন মানুষ, কোন পশু, কোন অস্ত্র তাকে মারতে পারবে না। মাটি, কিংবা জল কিংবা শূণ্য কোথাওই তার মৃত্যু নেই। দিন কিংবা রাত,ভিতর এবং বাহির সব অবস্থাতেই সে অবধ্য। সজীব এবং নির্জীব কোন কিছুই তাকে মারতে পারবেনা। এই অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে হিরণ্যকশিপু সমস্ত দেবতা ও মানুষদের অবজ্ঞা করতে শুরু করেন। হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ছিল বিষ্ণুর ভক্ত। প্রহ্লাদ বিষ্ণুকে নিজের পিতার ওপরেও স্থান দিচ্ছে দেখে হিরণ্যকশিপু ভীষণ রেগে যান। ক্রুদ্ধ হিরণ্যকশিপু বোন হোলিকাকে আদেশ দেন প্রহ্লাদকে আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য। হোলিকা ছোট্ট প্রহ্লাদকে নিজের কোলে বসিয়ে নিজের ও প্রহ্লাদ উভয়ের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। প্রহ্লাদ এক মনে বিষ্ণুকে ডাকতে থাকে। হোলিকা নিজে বরপ্রাপ্ত ছিলেন যে আগুনে পুড়ে তার মৃত্যু নেই। সুতরাং প্রহ্লাদ পুড়লেও তার যে কোন ক্ষতি হবেনা একথা বলাই যায়। কিন্তু আগুন জ্বলা মাত্রই সব হিসেব গেল উল্টে। প্রহ্লাদ অক্ষত থেকে গেল কিন্তু হোলিকা দগ্ধ হয়ে গেলেন। ক্রুদ্ধ হিরণ্যকশিপু প্রাসাদেরই একটি থামকে দেখিয়ে প্রহ্লাদকে জিজ্ঞেস করেন তার বিষ্ণু যদি সত্যিই সব জায়গায় উপস্থিত থেকে থাকেন তাহলে এই থামেও তিনি উপস্থিত থাকবেন। প্রহ্লাদ উত্তরে বলে অবশ্যই থাকবেন। উনি তো সর্ববিরাজমান। হিরণ্যকশিপু রাগে প্রায় অন্ধ হয়ে ঐ থামটিকে প্রচন্ড আঘাত করলে বিকট শব্দে থাম টি টুকরো টুকরো হয়ে যায় ও তার মধ্যে থেকে বিষ্ণু ‘নৃসিংহ অবতার’(নৃসিংহ অবতার কারণ এটি না পুরোপুরি দেবতা, না পুরোপুরি মানুষ না পুরোপুরি জন্তু)রূপে বেরিয়ে এসে হিরণ্যকশিপুকে গোধূলি লগ্নে(কারণ এটা না পুরোপুরি দিন না পুরোপুরি রাত), চৌকাঠে(কারণ এটা না পুরোপুরি ভিতর না পুরোপুরি বাহির)দাঁড়িয়ে নিজের ঊরুর(কারণ এটা না পুরোপুরি মাটি, না পুরোপুরি জল, না পুরোপুরি শূণ্য অবস্থা)ওপর শুইয়ে নখ(কারণ এটা না পুরোপুরি সজীব না পুরোপুরি নির্জীব) দিয়ে বুক চিরে বধ করেন। রাস্তায় রাস্তায় আমরা এইদিন যে চাঁচোড় জ্বালাতে দেখতে পাই আসলে দুষ্টের বিনাশ শেষে যা কিছু শুভ এটি তার উদযাপন। প্রাচীন কালে মানুষ এই চাঁচোড় থেকে পাওয়া ছাই নিজেদের গালে মাখত। কালক্রমে রঙ এসে ছাই এর স্থান দখল করে নেয়।

আরও পড়ুন:  জগন্নাথের নবকলেবর

তবে মথুরা বৃন্দাবনের ব্রজভূমিতে আবার হোলি খেলার উৎপত্তিটা একেবারেই আলাদা। এখানে হোলি এক বিশাল উৎসব যা প্রায় ১৬ দিন ধরে চলে। রঙ খেলার উৎপত্তি হিসেবে এখানে যে কারণটা খুব প্রচলিত তা যে অবশ্যই কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কৃষ্ণের গায়ের রঙটা ছোট থেকেই কালচে নীল। সেই যে ছোটবেলায় পূতনা রাক্ষসীর স্তন পান করতে গিয়ে শরীরে বিষ ঢুকল সারা জীবনের জন্য গায়ের রঙটাকে একেবারে নীল করে দিল। কৃষ্ণ যত বড় হতে লাগলো তার চিন্তা তত বাড়তে লাগলো এই ভেবে যে তার এই গায়ের রঙই অপরূপা রাধা কে তার থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। মা কেও তার এই দুশ্চিন্তা কথা সে না বলে থাকতে পারেনি। কানের কাছে এই বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ বলতে থাকলে বিরক্ত মা কৃষ্ণকে বলেন যে রঙ তার ভালো লাগে সেই রঙ সে যেন গিয়ে রাধার গালে মাখিয়ে দেয়। কৃষ্ণ রাধার গালে সেই রঙ মাখিয়ে দিলে রাধার উজ্জ্বল রূপ ফিকে হয়ে যায়। রাধার গায়ের রঙ কৃষ্ণের মতই হয়ে ওঠে। তাদের মিলনেও আর কোন বাধা থাকে না। রাধার গালে এই রঙ মাখিয়ে দেওয়ার ঘটনাকেই বৃন্দাবনবাসীরা হোলি হিসেবে পালন করে। এই গল্পটি ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে সুদূর গায়না, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, এবং মরিশাস অবধি ছড়িয়ে পড়েছে।

হোলি যে কত প্রাচীন একটি হিন্দু উৎসব তা বোঝা যায় মহাকবি কালিদাসের লেখায় এর উল্লেখ দেখে। হর্ষবর্ধন রচিত ‘রত্নাবলী’তেও এর উল্লেখ আছে। ইউরোপ থেকে আগত ব্যবসায়ীদের মাঝেও যে এর জনপ্রিয়তা কতটা ছিল তা বোঝা যায় অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে হোলি শব্দটির ক্রমবিকাশ দেখে। যেমন

‘Houly’ (১৬৯৮),

‘Huli’ (১৭৮৯),

‘Hoolee’ (১৮২৫),

Holi’ (১৯১০-)

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এর নামকরণ একেকরকম। যেমন

গুজরাত– ধুলেতি

উত্তর প্রদেশ– লাঠ মার হোলি

আরও পড়ুন:  দেবীর বোধন

উত্তরাখণ্ড– কুমায়নি হোলি

বিহার– ফাগুয়া

ওড়িশা– দোলা

আসাম– ফাকুয়া

গোয়া– শিগমো

মহারাষ্ট্র– শিমগা

মণিপুর– ইয়াওসাং

কেরালা– উক্কুলি/মাঞ্জাল কুলি

নেপাল– ফাগু

বাংলা– দোলযাত্রা (দোলায় চেপে শ্রীকৃষ্ণ যাত্রা করেন বলে এই দিনটিকে দোলযাত্রা বলা হয়ে থাকে। বৈষ্ণব ধারণা অনুযায়ী, এইদিন বৃন্দাবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির নিয়ে রাধা ও অন্যান্য গোপীদের সাথে রং খেলায় মেতেছিল। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি বলা হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবিরে স্নান করিয়ে দোলায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রায় বের করা হয়। শান্তিনিকেতনে নাচগানের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৫ সালে এই উৎসবের উদ্বোধন করে। আদিবাসী ও অন্যান্যদের নিয়ে শুরু করা সেই দিনের উৎসব এখন বাঙালির কাছে দোলের সমার্থক। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে দোলের সময় শান্তিনিকেতন আলাদা এক আকর্ষণ।)

“দোলযাত্রা ।। হোলি” তে 9 টি মতামত

  1. […] সংক্রান্তি, বামন জয়ন্তী, রামনবমী, দোলযাত্রা, রথযাত্রা  ইত্যাদি উৎসব ধুমধাম করে […]

  2. […] থাকে। এইসমস্ত উৎসব-অনুষ্ঠান ছাড়াও, হোলি, নবরাত্রি ইত্যাদি উৎসবগুলিও […]

  3. […] করা হয়।এই উৎসবগুলি ছাড়াও দীপাবলি, দোল ইত্যাদি জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয় […]

  4. […] উৎসবে সামিল হত আদিবাসীদেরও। মূলত দোল পূর্ণিমার আগে এই বসন্ত উৎসব পালন করা হয়। বসন্ত […]

  5. […] আজ দোল উৎসব। বাঙালির কাছ দোল মানে শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব। ফাল্গুনী পূর্ণিমা অর্থাৎ দোলপূর্ণিমার দিনই শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসবের আয়োজন করা হয়। রঙ আর আবীরে ভরা এই উৎসব সকল বাঙালির এক প্রিয় উৎসব। বৈষ্ণব ধারণা অনুযায়ী এইদিন বৃন্দাবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির নিয়ে রাধা ও অন্যান্য গোপীদের সাথে রং খেলায় মেতেছিল। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি বলা হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবিরে স্নান করিয়ে দোলায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রায় বের করা হয়। বিস্তারিত পড়ুন এখানে https://sobbanglay.com/sob/holi_doljatra/ […]

  6. […] মন্দির। এই মন্দিরে রামনবমী বা দোলযাত্রা প্রভূতি অনুষ্ঠানে প্রচুর ভিড় হয়ে […]

  7. […] যেকোন সময় মায়াপুরে আসা যায়। তবে দোলপূর্ণিমা, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, রাস ইত্যাদি […]

  8. […] হয় একটি বিপুল জনপ্রিয় উৎসব, যার নাম ‘হোলি‘। পশ্চিমবঙ্গে ‘দোলযাত্রা’ বা […]

  9. […] প্রতিটি হিন্দু ও বৈষ্ণবের মননে। দোল পূর্ণিমার সঙ্গেও যেমন সেই একই রাধা-কৃষ্ণের […]

আপনার মতামত জানান

copyright © 2017-22, Sobbanglay. All rights reserved.
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

বাদল সরকারের জীবনী দেখুন

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন

বিপত্তারিণী ব্রত নিয়ে দেখুন এই ভিডিওতে



ছবিতে ক্লিক করুন