কেদারনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের (Kedarnath Jyotirlinga) মন্দিরটি ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের মন্দাকিনী নদীর কাছে গাড়ওয়াল হিমালয় রেঞ্জে অবস্থিত। এই মন্দিরটি যেমন বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের মধ্যে একটি, তেমনই উত্তর হিমালয়ের চার ধাম তীর্থস্থানের মধ্যেও এটি প্রধান একটি তীর্থ, আবার পঞ্চকেদারের অন্তর্গত পাঁচটি শিবমন্দিরের মধ্যে কেদারনাথকেই প্রথম হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। তাই হিন্দুদের কাছে এই মন্দিরের গুরুত্ব অপরিসীম। নৈসর্গিক তুষারাবৃত পর্বত এবং তৃণাচ্ছন্ন উপত্যকার মাঝখানে এই কেদারনাথ মন্দিরটি অবস্থিত। এখানকার চরম আবহাওয়ার কারণে জনসাধারণের জন্য মন্দিরটি এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে খোলা থাকে। বাকি সময় বরফাচ্ছন্ন হওয়ায় এখানে যাওয়া যায় না।
শিবপুরাণ অনুযায়ী একদা ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে দুজনের তুমুল বিবাদ উপস্থিত হয়। সেই বিবাদ সন্তোষজনক পরিণতিতে না পৌঁছে চলতেই থাকলে মহাদেব তখন একটি আলোকরশ্মির স্তম্ভ রূপে তাঁদের দুজনের মাঝখানে প্রকট হন। ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু কেউই সেই আলোকস্তম্ভের আদি ও অন্ত খুঁজে পাননি। শেষমেশ তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই দিব্য জ্যোতিই শ্রেষ্ঠতম। এভাবেই জ্যোতির্লিঙ্গের ধারণাটির উদ্ভব হয়।
কেদারনাথ মন্দির নিয়ে বেশ কিছু কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে। একটি কিংবদন্তী অনুসারে কেদারনাথ মন্দিরটি মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। সেই কাহিনী অনুসারে, মহাভারতের পান্ডবরা তাঁদের আপন ভাই কৌরবদের হত্যা করার পর শিবের কাছে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিলেন। এই সঙ্কল্প নিয়ে শিবের সন্ধানে প্রথমে তাঁরা বারাণসী গিয়েছিলেন। তবে ভ্রাতৃহত্যার মত পাপ করার ফলে ভগবান শিব তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে চাননি এবং গাড়োয়াল অঞ্চলে একটি ষাঁড়ের ছদ্মবেশে লুকিয়ে ছিলেন। সেখানে শিব লুকিয়ে ছিলেন বলে তা গুপ্তকাশী নামে পরিচিত হয়েছে। একদিন সেখানে দ্বিতীয় পান্ডব ভীম একটি ষাঁড়কে দেখে সেই ষাঁড়টিকে শিব বলে চিনতে পারেন। ভীম তার লেজ এবং পিছনের পা ধরেছিলেন। তখন ষাঁড়টি পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে গাড়োয়াল অঞ্চলের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কেদারনাথে ষাঁড়ের কুঁজটি পড়েছিল, তুঙ্গনাথে পড়েছিল বাহু, রূদ্রনাথে পড়েছিল মুখ, মধ্যমহেশ্বরে পড়েছিল নাভি এবং পেট এবং চুল পড়েছিল কল্পেশ্বরে। এইভাবেই শিবের উপাসনার জন্য এই পাঁচটি জায়গায় পাঁচটি মন্দির বা পঞ্চকেদার তৈরি হয় এবং পঞ্চকেদার পান্ডবরাই তৈরি করেছিলেন বলে মনে করা হয়। এরপর পান্ডবরা কেদারনাথে পাপ থেকে পরিত্রাণের জন্য ধ্যান করেছিলেন এবং এখান থেকেই স্বর্গরোহিনী নামক পথ দিয়ে স্বর্গে গিয়ে মোক্ষলাভ করেছিলেন। এখানে জেনে রাখা ভাল যে মহাভারতে কিন্তু কোথাও এই কেদারনাথের উল্লেখ নেই।
অন্য এক কিংবদন্তী অনুসারে বিষ্ণুর জনপ্রিয় দুই অবতার নর ও নারায়ণের তপস্যায় মুগ্ধ হয়ে শিব তাঁদেরকে বর চাইতে বললে তাঁরা শিবকে জ্যোতির্লিঙ্গরূপে কেদারনাথে অবস্থান করবার আবেদন জানিয়েছিলেন। স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী, কেদারনাথ হল সেই স্থান যেখানে শিব তাঁর জটা থেকে পবিত্র গঙ্গাকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে
কেদারনাথ তীর্থের পুরোহিতরা এই অঞ্চলের প্রাচীন ব্রাহ্মণ যারা তাঁদের পূর্বপুরুষ নর-নারায়ণ এবং দক্ষিণ প্রজাপতির সময় থেকেই পূজা করে আসছেন। এও প্রচলিত রয়েছে যে, পান্ডবদের নাতি রাজা জনমেজয় তাঁদেরকে পুরো কেদারনাথ অঞ্চল দান করেছিলেন।
কেদারনাথের আদি মন্দির পান্ডবরা তৈরি করেছিলেন বলে মনে করা হলেও বর্তমান মন্দিরটি অষ্টম শতাব্দীতে হিন্দুগুরু আদি শঙ্করাচার্য দ্বারা নির্মিত বলে জানা যায়। যদিও এই নিয়েও কোনও তথ্যপ্রমাণ নেই। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে শঙ্করাচার্য এই কেদারনাথের কাছেই এক পাহাড়ে মারা গিয়েছিলেন। মতান্তরে কাঞ্চিপূরমে তাঁর মৃত্যু হয়। শঙ্করাচার্যের স্মৃতির উদ্দেশ্যে কেদারনাথ মন্দিরের পিছনে একটি সমাধিমন্দির স্থাপিত রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষতির কারণে বহুবার মন্দিরের সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ হয়েছে। সর্বশেষ সংস্কারটি ২০১৩ সালের বিধ্বংসী বন্যার পরে হয়েছিল।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,৫০০ মিটারেরও বেশি উচ্চতায় এই মন্দিরটি অবস্থিত এবং বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের মধ্যে এটিই সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত। কেদারনাথ মন্দিরটির গড়ন স্থাপত্যশৈলীরও এক অসাধারণ নিদর্শন। লক্ষ করলে দেখা যাবে কেদারনাথের মন্দিরটির আকৃতি অনেকটি শিবলিঙ্গের মতো। মন্দিরটি ৮৫ ফুট উঁচু, ১৮৭ ফুট লম্বা এবং চওড়ায় প্রায় ৮০ ফুট। মন্দিরের দেওয়াল ১২ ফুট পুরু শক্ত পাথর দিয়ে তৈরি। মন্দিরটি ৬ ফুট উঁচু একটি স্তম্ভের ওপর নির্মিত। মন্দিরটি কেবল বড় বড় ও ভারী পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে, সিমেন্ট ব্যবহার করা হয় নি এখানে। মন্দিরের ছাদটি একটি মাত্র পাথর দিয়েই নির্মিত। বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন এই মন্দিরের পাথরের গায়ে অসংখ্য হলুদ রেখা। তাঁদের মতে, এগুলি সম্ভবত মন্দিরের গায়ে জমে থাকা তুষারের ধীর গতিতে সরে যাওয়ার ফলে তৈরি হয়েছে। মন্দিরের সিঁড়িতে পালিভাষায় লেখা লিপি খোদিত করা রয়েছে। প্রবেশদ্বারের সম্মুখে শিবের বাহন নন্দীর একটি মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের সামনে একটি হলে পার্বতী এবং পঞ্চপান্ডবের ছবি রয়েছে। কেদারনাথ মন্দিরের ভিতরের প্রথম হলটিতে পাঁচ পান্ডব, কৃষ্ণ, নন্দী অর্থাৎ শিবের বাহন ষাঁড়টির এবং বীরভদ্রের (শিবের রক্ষকদের একজন) মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। মূল হলটিতে দ্রৌপদী এবং অন্যান্য আরও কয়েকজন দেবতার মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। ভিতরের দেওয়ালে নানা পৌরাণিক কাহিনী খোদিত রয়েছে। মন্দিরের ভিতরে পূজার জন্য রয়েছে একটি গর্ভগৃহ এবং তীর্থযাত্রীদের জন্য রয়েছে একটি মন্ডপ। এখানকার জ্যোতির্লিঙ্গটি ত্রিভুজাকৃতি পিরামিডের মতো দেখতে। মূল মন্দিরের পিছনে শঙ্করাচার্যের সমাধি রয়েছে।
কেদারনাথ মন্দিরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রথমেই আসে শিবরাত্রির কথা। ফাল্গুন মাসে এই মহা শিবরাত্রির তিথি উপস্থিত হয়। মহাধুমধাম করে কেদারনাথে এই উৎসবটি উদযাপন করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, এই দিনেই ভগবান শিব তান্ডব নৃত্য করেছিলেন। এরপর আসে শ্রাবণীর অন্নকূট মেলার কথা। সাধারণত রাখীবন্ধনের আগেরদিন এই উৎসব পালিত হয়। স্থানীয় লোকেরা নতুন ফসলকে কেন্দ্র করে এই উৎসব উদযাপন করে। এই দিনে সদ্য কাটা ধান ভগবান শিবকে তারা নিবেদন করে, যা প্রসাদম নামে পরিচিত। এছাড়াও পুরো জ্যোতির্লিঙ্গটি সদ্য কাটা ভুট্টা, গম, ডাল ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়। ভক্তেরা এইসময় মন্দির দর্শনে যান এবং শিবলিঙ্গে জল ঢেলে প্রার্থনা করেন।
গণেশ চতুর্থী কেদারনাথে পালিত আরও একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব। প্রধানত সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে এটি উদযাপিত হয়ে থাকে। গণেশ যেহেতু শিবের পুত্র ছিলেন, তাই গণেশভক্তরাও এইসময় কেদারনাথে ভ্রমণ করেন এবং সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করে থাকেন। কার্তিক পূর্ণিমা হল আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব, যা কেদারনাথে অনুষ্ঠিত হয়। কার্তিক মাসে অর্থাৎ নভেম্বর বা ডিসেম্বরেই সাধারণত, পূর্ণিমার সময় এই উৎসব পালিত হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, এইদিন ভগবান শিব জ্যোতির্লিঙ্গরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বদ্রি-কেদার উৎসব এখানকার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। সাধারণত জুন মাসে এটি উদযাপিত হয়। প্রায় আট দিন ধরে সমগ্র অঞ্চলটিতে জমকালো নানা অনুষ্ঠান চলতে থাকে। এসময় উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সঙ্গীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী এবং চিত্রশিল্পীরা এসে ভিড় করেন এখানে। এরপর দীপাবলির কথাও বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন। এইসময় শুধু মন্দির নয়, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিকেও রঙিন ফুল দিয়ে সাজানো হয়। মন্দিরকে ঘিরে প্রায় ৫,০০০টি প্রদীপ জ্বালানো হয়, যা মন্দিরের অন্ধকারতম কোণটিকেও আলোকিত করে তোলে।
সমাধি পূজার কথাও এখানে বলা প্রয়োজন। মন্দিরের পিছনে অবস্থিত শঙ্করাচার্যের সমাধিটিকে মন্দিরের সমাপনী দিনে পূজা করা হয়ে থাকে। সঙ্গীত ও শোভাযাত্রা-সহকারে এই উৎসব উদযাপিত হয়। সমাধি পূজার পর মন্দিরের দরজা সেই মরশুমের জন্য বন্ধ হয়ে যায় এবং মন্দিরের প্রধান বিগ্রহটিকে উখিমঠে স্থানান্তরিত করা হয় ও সেখানেই তার সেবাকার্য চলে। রুদ্র অভিষেক হল কেদারনাথ মন্দিরের একটি নিত্যকর্ম। এটি একটি বিশেষ পূজা যা ভগবান শিবের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য রোজ করা হয়ে থাকে। এইসমস্ত উৎসব-অনুষ্ঠান ছাড়াও, হোলি, নবরাত্রি ইত্যাদি উৎসবগুলিও কেদারনাথে ধুমধাম করে পালিত হয়ে থাকে।
এই কেদারনাথ মন্দিরটি হিন্দুদের কাছে অপরিসীম আধ্যাত্মিক তাৎপর্যমন্ডিত এক স্থান। মন্দিরটি হিমালয়ে অবস্থিত হওয়ায় তার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কেবল ভারত থেকেই নয়, সারা বিশ্ব থেকে ভক্তরা এখানে আসে।