দীপাবলি

হিন্দুদের পালনীয় উৎসবগুলির মধ্যে দীপাবলি (Dipabali) মূলত আলোর উৎসব বলেই পরিচিত। পাঁচদিন ধরে চলা এই হিন্দুদের উৎসব শরৎকালে সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়। শুধু উত্তর ভারত নয়, বসন্তকালে দক্ষিণ ভারতেও পালিত হয় এই দীপাবলি। সাধারণভাবে বলতে গেলে বাঙালিদের পালনীয় দ্বীপান্বিতা কালীপূজা এই দীপাবলিরই অঙ্গ। ভারতের আপামর অবাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে দীপাবলির জনপ্রিয়তা প্রাচীনকাল থেকেই তুঙ্গে। শুধু হিন্দুরাই নয়, বৌদ্ধ, শিখ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীরাও এই দীপাবলি উৎসব পালন করে থাকেন। তবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে এই দীপাবলির তাৎপর্য পৃথক পৃথক। বাংলা বর্ষপঞ্জির কার্তিক মাসে অনুষ্ঠিত হয় এই দীপাবলি।

সংস্কৃত ভাষায় ‘দীপ’ শব্দের অর্থ হল আলোকশিখা বা প্রদীপ। সেই থেকেই এই দীপাবলি উৎসবের নামকরণ হয়েছে বলে জানা যায়। ‘দীপ’ কথার অর্থ আলো আর ‘অবলি’ কথার অর্থ হল সারিবদ্ধ। এই দীপাবলির আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যায় এই আলোকে জ্ঞানের আলো বলেই চিহ্নিত করা হয়। রাজা হর্ষবর্ধনের সময়ে সপ্তম শতাব্দীতে লেখা ‘নাগানন্দ’ নাটকে ‘দীপপ্রতিপদোৎসব’ নামে একটি উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে আলোকমালায় সাজিয়ে তোলা হয় ঘর-বাড়ি। আবার রাজশেখরের ‘কাব্যমীমাংসা’ গ্রন্থেও ‘দীপামালিকা’ নামে একটি উৎসবের উল্লেখ দেখা যায় যার সঙ্গে আধুনিক দীপাবলি উৎসবের বহুল সাদৃশ্য রয়েছে। একাদশ শতাব্দীতে আল বিরুণীর ভারত ভ্রমণের বর্ণনা থেকেও সেই সময়কার দীপাবলি উৎসবের ধারণা পাওয়া যায়। ব্রিটিশ শাসনকালে উইলিয়াম জোনসের লেখা থেকে আশ্বিন-কার্তিক মাসের দীপাবলি উৎসবের চার-পাঁচ দিনের নাম জানা যায় এরকম – ভূতচতুর্দশী যমতর্পণম, লক্ষ্মীপূজা দীপান্বিতা, দ্যুত প্রতিপদ বেলিপূজা এবং ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। হিন্দুরা মনে করেন, চোদ্দো বছর বনবাসে কাটিয়ে রাম, লক্ষণ ও সীতার অযোধ্যায় ফিরে আসার দিনেই পালিত হয়েছিল প্রথম দীপাবলি। দ্বাপর যুগে নরকাসুরকে বধ করে কৃষ্ণের যে বিজয় তা দীপাবলি উৎসবের নরক চতুর্দশী নামে পরিচিত হয়। পদ্মপুরাণে বলা আছে যে, দীপাবলির দিনেই দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে শ্রী বিষ্ণুর বিবাহ হয়েছিল। জৈনরা এই দিনটিতে মহাবীরের নির্বাণপ্রাপ্তির দিন হিসেবে জৈন দীপাবলি পালন করে। শিখরা তাদের গুরু হরগোবিন্দের মুক্তি পাওয়ার দিন হিসেবে দীপাবলির দিনে পালন করেন বন্দি ছোড় দিবস। নেপালের নেওয়ার বৌদ্ধরা বজ্রযানী পন্থায় এই দিনে দেবী লক্ষ্মীর অর্চনা করে থাকেন। নেপালে এই দিনটি ‘তিহার উৎসব’ নামে পরিচিত।

আশ্বিন মাসের অমাবস্যার দুই দিন আগে থেকে শুরু হয় এই দীপাবলি। পাঁচ দিনের উৎসবের প্রথম দিনটি হল ত্রয়োদশী। উৎসবের দ্বিতীয় দিন পালিত হয় ‘ভূত চতুর্দশী’ হিসেবে। বাঙালিরা এইদিন চোদ্দো রকম শাকের মিলিত একটি পদ খেয়ে থাকেন যা ‘চোদ্দো শাক’ নামে পরিচিত। সাধারণভাবে এই শাকগুলির নাম এইরকম – ওল, কেও, বেতো, কালকাসুন্দা, নিম, সরিষা, শালিঞ্চা বা শাঞ্চে, জয়ন্তী, গুলঞ্চ, পটুক পত্র বা পলতা, ভন্টাকি (ঘেঁটু) বা ভাঁট, হিলমোচিকা বা হিঞ্চে, সুনিষন্নক বা শুষুনী বা শুষনি, শেলু বা শুলকা। তবে আয়ুর্বেদ মতে প্রাচীন বাংলায় চোদ্দো শাকগুলি ছিল পালং, লাল, শুশনি, পাট, ধনে, পুঁই, কুমড়ো, গিমে, মূলো, কলমি, সরষে, নটে, মেথি, লাউ অথবা হিঞ্চে। পুরাণ মত অনুসারে ভূত চতুর্দশীতে চোদ্দো শাক খাওয়ার রীতি প্রচলন করেন ঋক্ বেদের বাস্কল বা শাকদ্বীপি ব্রাহ্মণরা। বিজ্ঞানসম্মতভাবে দেখলে বোঝা যাবে যে, দীপাবলির এই মাসটায় ঋতু পরিবর্তনের ফলে নানান রোগের প্রকোপ বাড়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেই জন্য আশ্বিন ও কার্তিক মাস দুটিকে ‘যমদংস্টা’ কাল বলা হতো। চোদ্দো রকম শাকের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা ছিল দারুণ। হয়তো বাঙালিকে এই শাকের গুণাগুণ অন্য কোনোভাবে বোঝাতে না পেরে ধর্মের পালনীয় কর্তব্যের মোড়কের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা থেকেই এই রীতির শুরু। এছাড়াও বাড়ির চোদ্দোটি কোনায় চোদ্দোটি প্রদীপ জ্বালিয়ে পরিবার থেকে ভূত-প্রেতকে দূরে সরিয়ে রাখার রীতিও দেখা যায়। চোদ্দো প্রদীপ জ্বালানোর পেছনে কারণ স্বরূপ মনে করা হয় যে, এই দিন প্রদীপ জ্বালিয়ে পিতৃপুরুষদের বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয় যাতে তারা মা কালীর আগমনের দিন উপস্থিত হয়ে বাড়ির সকল সদস্যকে আশীর্বাদ করতে পারেন এবং নিজেরাও মোক্ষ লাভ করতে পারেন। পাঁচদিনের উৎসবের তৃতীয় দিনে পশ্চিমবঙ্গে সাড়ম্বরে পালন করা হয় কালীপূজা। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত এই পুজোকে দীপান্বিতা কালীপূজো বলে। এর পাশাপাশি আসাম ও ওড়িশাতেও এইদিন কালীর আরাধনাই হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গে এবং বাংলাদেশের কিছু কিছু অংশে কালীপূজার দিন অলক্ষ্মী বিদায় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে লক্ষ্মীপূজাও হয়ে থাকে। চতুর্থ দিন হল ‘বালি প্রতিপদ’ বা ‘গুড়ি পারবা’। এই দিনটি মহারাষ্ট্রে নববর্ষ, অন্ধ্রপ্রদেশে ‘উগাদি’ ও সিন্ধ্রীদের কাছে ‘চেট্টিনাদ’ নামে পরিচিত। এই দিন নববিবাহিত বধূ স্বামীর কপালে মৃত্যুঞ্জয়ী লাল তিলক পরিয়ে আরতির মাধ্যমে তার দীর্ঘায়ু কামনা করে থাকেন। বৈষ্ণবরা আবার এইদিন গোবর্ধন পূজা বা অন্নকূট করে থাকেন যেখানে শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে ১০৮টি পদ রান্না করা হয়। মনে করা হয়, এই দিনেই শ্রীকৃষ্ণ কনিষ্ঠা আঙুলে তুলে ধরেছিলেন গোবর্ধন পর্বত। বাঙালিদের মধ্যেও অন্নকূট উৎসবের প্রচলন রয়েছে। দীপাবলি উৎসবের একেবারে শেষ দিন অর্থাৎ পঞ্চম দিনে অনুষ্ঠিত হয় ‘ভাইফোঁটা’। অমাবস্যার পরে দ্বিতীয় দিনে এই অনুষ্ঠান হয় বলে একে ‘ভ্রাতৃদ্বিতীয়া’ও বলা হয়ে থাকে।


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

অনেকেই মনে করেন বাঙালিরা যাকে দীপাবলি বলে পালন করে, তা অবাঙালি হিন্দুদের কাছে দিওয়ালি হিসেবে পালিত হয়। ঘটনাটা পুরোটা সত্য নয়। দীপাবলি আর দিওয়ালির মধ্যে স্পষ্টত কিছু অমিল আছে। বাঙালিদের দীপাবলি পাঁচদিনের উৎসব যা আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে শুরু হয়ে, ভূত চতুর্দশী, কালীপূজা বা লক্ষ্মীপূজার পরে ভাইফোঁটার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। আর অবাঙালিদের কাছে দিওয়ালি সাধারণত তিন দিনের উৎসব – প্রথম দিনে ধনতেরাস, দ্বিতীয় দিনে ছোটি দিওয়ালি পালন আর সবশেষে হয় ভাইদোজ। ধনতেরাস অনুষ্ঠানটি মূলগতভাবে অবাঙালিদের মধ্যে প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে বাঙালিরাও সানন্দে ধনতেরাস উৎসব পালন করে থাকে। ধনতেরাসের দিনে সোনা-রূপো কেনার চল রয়েছে উত্তর ভারতে। মনে করা হয় এই দিনে ধাতু কিনে ঘরে রাখলে তা শুভ ফলদায়ক।

উত্তর ভারতের হিন্দুরা ছোটি দিওয়ালির দিনটিকে ১৪ বছরের বনবাস থেকে রামচন্দ্রের প্রত্যাবর্তনের দিন হিসেবে পালন করে। তাই এই দিন তারা লক্ষ্মী ও গণেশের পুজো করে সমৃদ্ধি কামনা করে। তবে কালীপূজাই হোক বা দিওয়ালি আলোকসজ্জার পাশাপাশি অপরিহার্য অঙ্গ হল প্রচুর আতসবাজি পোড়ানো। আবার বাঙালিদের মধ্যে যেমন ভূত চতুর্দশীর দিনে বিশেষভাবে চোদ্দো শাক খাওয়ার রীতি রয়েছে, তেমনি অবাঙালিদের মধ্যে দিওয়ালি উপলক্ষ্যে একে অপরকে বিশেষ কিছু খাওয়ার উপহার দেওয়ার রীতি রয়েছে। এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক হল শুকনো ফল – আখরোট, বাদাম, পেস্তা, কাজু ইত্যাদি প্যাকেটবন্দি করে অবাঙালিরা উপহার দিয়ে থাকেন। সমস্ত উত্তর ভারত জুড়েই এই রীতি দেখা যায়। অনেকে ঘিয়ে ভাজা লাড্ডুও উপহার দিয়ে থাকেন। এর সঙ্গেও জড়িয়ে আছে বৈজ্ঞানিক কিছু কারণ। উত্তর ভারত জুড়ে এই সময় থেকেই প্রবল হারে শীত পড়তে থাকে। ঋতু পরিবর্তনের সময় সুস্থ ও নীরোগ থাকার জন্য বাঙালিরা যেমন চোদ্দো শাক খেয়ে থাকে, তেমনি শীতে শরীর গরম রাখতে এই শুকনো ফলগুলি খুবই উপকারী উপাদান হিসেবে কাজ করে। এই সব শুকনো ফল সুস্বাস্থ্যের জন্যেও উপকারী।

মহারাষ্ট্র ও দক্ষিণ ভারতের রীতি অনুযায়ী দীপাবলির দ্বিতীয় দিনে শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামা নরকাসুরকে বধ করেন বলে একে ‘নরক চতুর্দশী’ও বলা হয়। উত্তর ভারতে এই দিওয়ালির প্রাধান্য বেশি হলেও, দক্ষিণ ভারতে নরক চতুর্দশী পালনই ঘটা করে হয়ে থাকে।

দীপাবলিকে উপলক্ষ্য করে বহু জায়গায় বড়ো বড়ো মেলা বসে। মহিলারা রঙিন সাজে সেজে ওঠেন, হাতে মেহেন্দি পড়েন। বলা হয়, বড়দিনকে উপলক্ষ্য করে যেমন খ্রিস্টানদের একটা বিরাট অর্থনৈতিক লেনদেন হয়, তেমনই ভারতে দীপাবলির কয়েক দিন প্রচুর কেনাকাটা করে মানুষজন। নতুন জামা, উপহার, ঘর সাজানোর জিনিস এমনকি অনেকে নিয়ম করে গহনা বা সোনাও কেনেন এই দিনে। ফলে ভারতীয় অর্থনীতিতে এক বিরাট সুখকর সময় নিয়ে আসে দীপাবলি।

8 comments

আপনার মতামত জানান