Bandi Chhor Divas

বন্দি ছোড় দিবস

সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে ঠিক যে দিনটায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দীপাবলি উৎসবে মেতে ওঠেন, সেই দিনেই শিখ ধর্মের অগণিত মানুষ গুরু হরগোবিন্দের স্মরণে পালন করেন ‘ বন্দি ছোড় দিবস ’ (Bandi Chhor Divas)। দীপাবলির দিনে ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট যেমন আলোয় আলো হয়ে থাকে, হরেকরকমের আতসবাজির ঝলকানিতে ভরে ওঠে আকাশ, ঠিক তেমনই শিখদের গুরুদ্বারগুলিতেও জ্বলে ওঠে হাজারো প্রদীপ, শিখ ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে বাড়িতে আলোকদীপ জ্বালানো হয়। এই দিনেই তো মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের বন্দিশালা থেকে ৫২ জন বন্দির সঙ্গে গুরু হরগোবিন্দও মুক্তি পেয়েছিলেন আর তার স্মরণে আজও শিখরা পালন করেন বন্দি ছোড় দিবস । শিখদের ইতিহাসে এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মূলত পাঞ্জাব জুড়ে এই দিবস উদ্‌যাপিত হলেও ভারতের আরো যে যে স্থানে শিখরা আছেন, তারাও এই দিন স্মরণ করেন গুরু হরগোবিন্দকে।

‘বন্দি ছোড়’ কথার আক্ষরিক অর্থ হল – কারাগার থেকে বন্দী কয়েদিদের মুক্তি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুঘল আমলে সম্রাট জাহাঙ্গীর শিখদের উত্থানের বিষয়ে এতটাই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন যে, গোয়ালিয়র দূর্গে তিনি ৫২ জন রাজাকে বন্দি করে রাখেন কয়েক মাস ধরে। শিখদের ষষ্ঠ ধর্মগুরু গুরু হরগোবিন্দও তাঁদের সকলের সঙ্গে বন্দি ছিলেন। এই বিশেষ দিনে তিনি অন্য সকল বন্দি রাজার সঙ্গে দূর্গ থেকে ছাড়া পান। এই দূর্গের কাছেই একটি শিখ গুরুদ্বার ছিল যার নাম ছিল ‘গুরুদ্বার দাতা বন্দি ছোড় সাহিব’। মনে করা হয় এই নাম থেকেই বিশেষ এই দিনের নামকরণ করা হয়েছে। গুরু হরগোবিন্দ সাহেবের বাবা গুরু আর্জান দেব শিখদের পঞ্চম ধর্মগুরু ছিলেন। ১৬০৬ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁকে কারাবন্দি করেন। এমনকি তাঁকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হবার প্রস্তাব দেব জাহাঙ্গীর। তিনি এই প্রস্তাবে অসম্মত হলে পরে তাঁকে বন্দি করা হয় এবং শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার। ঐতিহাসিকরা মনে করেন সমগ্র ভারতে শিখদের উত্থান এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে ভয় পেয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীরের সেনাদের অত্যাচারে মৃত্যু হয় গুরু আর্জান দেবের। গুরু হরগোবিন্দের বয়স তখন মাত্র ১১ বছর। সেই বয়সেই ১৬০৬ সালের ২৪ জুন তাঁকে শিখদের ষষ্ঠ ধর্মগুরুর আসনে বসানো হয়। তিনি তাঁর পিতার উত্তরসূরি রূপে দুটি তলোয়ারকে প্রতীক ধার্য করেন – একটির নাম পিরি আর একটির নাম মিরি। ‘পিরি’ হল আধ্যাত্মিক কর্তৃত্ব স্থাপনের প্রতীক আর ‘মিরি’ হল মানসিক কর্তৃত্বের প্রতীক। গুরু আর্জান দেবকে বন্দি করার কারণে গুরু হরগোবিন্দও মুঘল কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। তিনি শিখ এবং হিন্দুদের একত্রে মুঘলদের বিরোধিতার লক্ষ্যে লড়াই করতে বলেন। শিখ সম্প্রদায়কে সামরিকভাবে শক্তিশালী করে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন তিনি আর তাই গুরু হরগোবিন্দকেও গ্রেপ্তার করেন সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং গোয়ালিয়রের দূর্গে তাঁকে বন্দি করে রাখেন। কীভাবে গুরু হরগোবিন্দ বন্দি হলেন, সেই নিয়েও বিভিন্ন মহলে পৃথক মত রয়েছে। কেউ বলেন, লাহোরের নবাব মুর্তজা খান লক্ষ্য করেছিলেন, গুরু হরগোবিন্দ শিখদের একত্রিত করে রিনি গড়ে তুলেছেন অকাল তখ্‌ত সাহিব। ফলে শিখদের একত্রিত করে সামরিকভাবে শক্তিশালী একটি বাহিনী গঠন করে গুরু হরগোবিন্দ যে তাঁর পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চান, সেই আশঙ্কায় অমৃতসরে গুরু হরগোবিন্দকে বন্দি করতে সম্রাট জাহাঙ্গীর ওয়াজির খান এবং গুঞ্ছা বেগকে পাঠান। কিন্তু ওয়াজির খান তাঁকে বন্দি না করে দিল্লিতে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে দেখা করতে যেতে বলেন। তরুণ গুরু হরগোবিন্দ ওয়াজির খানের কথা শুনে জাহাঙ্গীরের কাছে গেলে ১৬০৯ সালে গোয়ালিয়র দূর্গে গুরু হরগোবিন্দকে বন্দি করেন জাহাঙ্গীর। আবার অন্য একটি জনশ্রুতিতে জানা যায়, শিখ গুরু আর্জান দেবের উপর যে কর চাপানো হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পরে শিখরা এবং গুরু হরগোবিন্দ না মেটানোয় তাঁকে বন্দি করেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। তবে এই মতের যৌক্তিকতা ততটা সবল নয়। অনেকে বলেন ১৬১২ সালে তিনি বন্দি হন, আবার কারো কারো মতে, ১৬১৭ সাল থেকে ১৬১৯ সাল পর্যন্ত তিনি বন্দি ছিলেন গোয়ালিয়র দূর্গে।

সেই দূর্গে বন্দি ছিলেন আরো ৫২ জন হিন্দু রাজা। নিজের সঙ্গে তাঁদেরও মুক্তির কথা বললে সম্রাট জাহাঙ্গীর একটি শর্ত দিয়েছিলেন হরগোবিন্দকে। তিনি বলেছিলেন, যে কয়জন রাজা গুরুর কাপড়ের অংশ ধরে কারাগার থেকে বেরোতে পারবে, ততজনই কেবল মুক্ত হবেন। শোনা যায়, অলৌকিকভাবে প্রত্যেকেই গুরুর কাপড়ের অংশ ধরে বেরোতে সক্ষম হয়েছিলেন। কোনোরকম যুদ্ধ বা বিদ্রোহ ছাড়াই নগরকীর্তনের মতো ‘অখণ্ড পথ’ অবলম্বন করে বাহান্ন জন রাজাকে নিরাপদে মুক্ত করে এনেছিলেন গুরু হরগোবিন্দ।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

সমগ্র ভারতে বিশেষত পাঞ্জাবে গুরু হরগোবিন্দের কারামুক্তির স্মৃতিতে বন্দি ছোড় দিবস পালিত হয়। দীপাবলির মতো এইদিনেও বাড়িতে বাড়িতে আলোকসজ্জায় ভরে ওঠে, গুরুদ্বারগুলিতে প্রদীপ জ্বালানো হয়। আকাশ ভরে ওঠে প্রচুর আতসবাজিতে। শিখ সম্প্রদায়ের মানুষরা বিশেষ শোভাযাত্রা আয়োজন করে এবং বহু অঞ্চলে ‘লঙ্গর’ দেওয়া হয়, অর্থাৎ কাঙাল ভোজন করানো হয়। বৈশাখী, হোলা মহল্লা কিংবা গুরুপরবের মতো এই বন্দি ছোড় দিবসটিও শিখদের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎসব।

2 comments

আপনার মতামত জানান