মানুষের দেহকোষে ক্রোমোজোম সংখ্যার পরিবর্তন ঘটলে বা ক্রোমোজোমের গঠনে কোন ত্রুটি দেখা দিলে মানুষের শরীরে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। টার্নার সিন্ড্রোম এর মত এই ধরনের একটি অস্বাভাবিকতার নাম ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোম (Klinefelter’s syndrome)। বিজ্ঞানী এইচ.এফ.ক্লাইনফেল্টার (H.F.Klinefelter) ১৯৪২ সালে প্রথম এই রোগ সম্পর্কে ধারণা দেন।
মানুষের দেহকোষে স্বাভাবিক অবস্থায় ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে যার মধ্যে ৪৪টি হল অটোজোম বা দেহ ক্রোমোজোম এবং বাকি ২টি হল অ্যালোজোম বা সেক্স ক্রোমোজোম। সেক্স ক্রোমোজোম দুটির নাম হল X ক্রোমোজোম এবং Y ক্রোমোজোম। মহিলাদের শরীরে দুটি X ক্রোমোজোম থাকে এবং পুরুষদের শরীরে থাকে একটি X ক্রোমোজোম এবং একটি Y ক্রোমোজোম। এখন কোন জিনগত ত্রুটি বা মিউটেশনের জন্য কোন পুরুষের দেহকোষে যদি একটি অতিরিক্ত X ক্রোমোজোম সৃষ্টি হয়, অর্থাৎ তার শরীরে ৪৬টির বদলে ৪৭টি ক্রোমোজোম থাকে এবং ক্রোমোজোমের গঠন হয় XXY, তবে সেই ব্যক্তি শারীরিকভাবে পুরুষ হলেও তার শরীরে নানা অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। এই অস্বাভাবিকতাগুলিকেই একত্রে বলা হয় ‘ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোম’। প্রতি পাঁচশো জন শিশুর মধ্যে একজনের এই রোগ ধরা পড়ে।
মানুষের ক্ষেত্রে কোন জাইগোট যদি 47, XXY ক্রোমোজোম সমন্বয়যুক্ত হয়, তবে সেই জাইগোট থেকে ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোম বিশিষ্ট সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এই ঘটনার কার্যকৌশল সম্পর্কে দুটি সম্ভাবনার কথা বলা যায়, যথা-
- প্রথম সম্ভাবনায় অস্বাভাবিক গ্যামেট সৃষ্টির মাধ্যমে ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোম দেখা দিতে পারে। পুরুষদেহে গ্যামেট সৃষ্টির সময় সেক্স ক্রোমোজোমে ননডিসজাংশন (nondisjunction) বা ক্রোমোজোমের অসম বণ্টনের কারণে কোন গ্যামেট XY ক্রোমোজোমযুক্ত হতে পারে। এমন পুং-গ্যামেট স্বাভাবিক স্ত্রী-গ্যামেটকে নিষিক্ত করলে XXY ক্রোমোজোমযুক্ত জাইগোট সৃষ্টি হতে পারে। একইভাবে স্ত্রীদেহে গ্যামেট সৃষ্টিকালে সেক্স ক্রোমোজোমের ননডিসজাংশনের জন্য কোনো স্ত্রী-গ্যামেট XX ক্রোমোজোম প্রাপ্ত হতে পারে। এমন স্ত্রী-গ্যামেট স্বাভাবিক পুং-গ্যামেট দ্বারা নিষিক্ত হলে XXY জাইগোট সৃষ্টি হতে পারে যা ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোম বিশিষ্ট সন্তানের জন্ম দেয়।
- দ্বিতীয় সম্ভাবনায় জাইগোট সৃষ্টির পরবর্তী অবস্থায় স্বাভাবিক XY ক্রোমোজোমযুক্ত জাইগোট ক্লিভেজ বিভাজনকালে অসম ক্রোমোজোম বণ্টনের ফলে একটি XXY ক্রোমোজোমযুক্ত ব্লাস্টোমিয়ার তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে অপর ব্লাস্টোমিয়ারটি শুধু Y ক্রোমোজোমপ্রাপ্ত হয় এবং এই কোষটি বাঁচতে পারে না। ফলে XXY যুক্ত ব্লাস্টোমিয়ারটি বৃদ্ধি পায় এবং ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোমবিশিষ্ট পুরুষ তৈরি করে।
- এই রোগের সাধারণ লক্ষণগুলি হল:
শিশুদের ক্ষেত্রে :- - দুর্বল পেশী
- চেষ্টীয় স্নায়ুর (motor nurone) বিকাশের হার কম, ফলে বসা, হামাগুড়ি দেওয়া, দাঁড়ানো ইত্যাদি দেরিতে শেখা
- কথা বলা দেরিতে শুরু হয়
- জন্মের সময় সমস্যা, যেমন শুক্রাশয়গুলি শুক্রথলিতে নেমে না আসা
বয়ঃসন্ধিকালে :- - গড় উচ্চতার চেয়ে বেশি লম্বা
- অন্য ছেলেদের তুলনায় লম্বা পা, ছোট দেহ এবং ভারী নিতম্ব
- অনুপস্থিত, বিলম্বিত বা অসম্পূর্ন যৌন বিকাশ
- যৌনকেশ এবং দাড়ি-গোঁফের পরিমাণ কম
- আয়তনে ছোট শুক্রাশয় ও পুরুষাঙ্গ
- মহিলাদের মত স্তনের বৃদ্ধি হয়, একে বলে ‘গাইন্যকোম্যাস্টিয়া’ (Gynecomastia)
- লাজুক এবং সংবেদনশীল হওয়ার প্রবণতা
- চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি প্রকাশ করতে বা সামাজিকীকরণে অসুবিধা
- পড়া, লেখা, বানান বা গণিত নিয়ে সমস্যা
প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে :- - বীর্যে শুক্রাণুর পরিমাণ কম হয় বা একেবারেই থাকে না।
- যৌন উদ্দীপনা কম
- পেশীবহুল চেহারা অনুপস্থিত
- পেটে অতিরিক্ত মেদ বৃদ্ধি
- এই রোগ হলে রোগীর শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়, যেমন:
- উদ্বেগ এবং মানসিক অবসাদ
- সামাজিক, মানসিক এবং আচরণগত সমস্যা, যেমন কম আত্মসম্মান, মানসিক অপরিপক্কতা এবং আবেগপ্রবণতা
- বন্ধ্যাত্ব
- দুর্বল হাড় বা অস্টিওপোরোসিস (osteoporosis)
- হৃৎপিন্ড এবং রক্তনালীর সমস্যা
- ব্রেস্ট ক্যানসার এবং আরও অন্য ধরনের ক্যানসারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়
- ফুসফুস এবং শ্বসনতন্ত্রের রোগ
- বিভিন্ন বিপাকীয় সমস্যা যেমন- টাইপ টু ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে বেশি কোলেস্টরেল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড
- দাঁতের বিভিন্ন সমস্যা এবং দাঁতের ক্ষয়
- স্নায়ুতন্ত্রের রোগ যেমন অটিজম
- এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রোগ শনাক্ত করার জন্য চিকিৎসকরা বিভিন্ন পরীক্ষার সাহায্য নেন, যেমন-
• হরমোন পরীক্ষা:– রক্ত বা প্রস্রাবের নমুনা অস্বাভাবিক হরমোনের মাত্রা প্রকাশ করতে পারে যা ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোমের লক্ষণ।
• ক্রোমোজোম বিশ্লেষণ :– একে ক্যারিওটাইপ বিশ্লেষণও বলা হয়। এই পরীক্ষা নিশ্চিতভাবে ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোমের উপস্থিতি জানায়। এক্ষেত্রে রোগীর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে তাতে ক্রোমোজোমের আকার এবং সংখ্যা পরীক্ষা করা হয়। - সঠিক সময়ে ধরা পড়লে এই রোগ চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই রোগের চিকিৎসার বিভিন্ন উপায় হল:
a. টেস্টোস্টেরন প্রতিস্থাপন থেরাপি:- বয়ঃসন্ধিকালের সূচনার সময় থেকে টেস্টোস্টেরন প্রতিস্থাপন থেরাপি প্রয়োগ করা যেতে পারে। এর ফলে গৌণ যৌন লক্ষণগুলি প্রকাশিত হয়। এটি হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে পারে এবং মানসিক সমস্যারও উন্নতি ঘটাতে পারে। তবে বন্ধ্যাত্ব সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করতে পারে না। - বুকের পেশি অপসারণ:- যেসব পুরুষের স্তন বড় হয় তাদের ক্ষেত্রে প্লাস্টিক সার্জারি দ্বারা অতিরিক্ত স্তনের পেশি অপসারণ করা যেতে পারে, ফলে বুকের গঠন কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
- স্পিচ থেরাপি প্রয়োগ :- যেসব শিশুর কথা বলতে সমস্যা হয়, তাদের ক্ষেত্রে স্পিচ থেরাপি প্রয়োগ করলে কিছুটা সমাধান হয়।
- কাউন্সেলিং:- শিক্ষাগত এবং মানসিক সমস্যার জন্য শিশুদের কাউন্সেলিং করানো যেতে পারে।
- বন্ধ্যাত্ব সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান :- বেশির ভাগ ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোমের রোগীরাই বন্ধ্যা হন, কারণ এদের বীর্যে শুক্রাণুর পরিমাণ খুবই কম হয় বা প্রায় থাকে না। যেসব ক্ষেত্রে শুক্রাণুর পরিমাণ কম হয়, সেক্ষেত্রে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, এর নাম ‘ইন্ট্রাসাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইঞ্জেকশন’ (Intracytoplasmic Sperm Injection, ICSI)। এই পদ্ধতিতে একটি বায়োপসি করার সূচের সাহায্যে শুক্রাশয় থেকে শুক্রাণু বের করে নেওয়া হয় এবং সরাসরি স্ত্রীর ডিম্বাণুতে প্রয়োগ করা হয়।
- সঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা শুরু হলে ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোমের রোগীরাও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি এই রোগের বন্ধ্যাত্ব সংক্রান্ত সমস্যারও সমাধান করেছে। এই রোগীদের আয়ু সাধারণত স্বাভাবিকই হয়, তবে কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে রোগীদের আয়ু এক বা দুই বছর কম হতে পারে।
তথ্যসূত্র
- উচ্চতর জীববিদ্যা', দ্বাদশ শ্রেণী, সাঁতরা প্রকাশনী, তৃতীয় সংস্করণ, বংশগতি ও বিভেদ, পৃষ্ঠা ২৪৯, ২৫২-২৫৪
- https://www.mayoclinic.org/
- https://www.webmd.com/
- https://rarediseases.info.nih.gov/